Header Ads

বাঙালি বীর ভীম ভবানী নিজের বুকের ওপর তুলে নিতেন বুনো হাতি


বাঙালির বীরগাঁথায় উল্লেখযোগ্য নাম হলো ভীম ভবানী। যার আসল নাম হলো ভবেন্দ্রমোহন সাহা। প্রায়শই বিভিন্ন জায়গাতে আলোচনা হয়ে থাকে যে বাঙালিদের নাকি শরীরে কোনো বলে নেই। বাঙালিরা দুর্বল। বাঙালিদের নাকি কোনোকালেই কোনো বীর ছিলনা। কিন্তু বাঙালিদের বীরগাঁথার ইতিহাস অন্য কথা বলে। বাংলাতে কোনোকালেই বীরের অভাব ছিলনা। বাঙালি বীর হিসেবে যাদের নাম প্রথম সারিতে উঠে আসে তিনি হলেন বাঙালি বীর ভীম ভবানী। 


তিনি কখনো নিজের বুকের ওপর হাতি তুলেছেন। কখনো দু'হাতে চলন্ত মোটরগাড়ির চাকা থামিয়েছেন। কখনো সিমেন্টের পিপের ওপর ৫-৭ জন লোককে বসিয়ে পিপের ধার দাঁতে চেপে শূন্যে ঘোরাতেন। আবার কখনো ৪০ মণ পাথর চাপিয়ে তার ওপর ২০ থেকে ২৫ জনকে বসিয়ে খেয়াল খাম্বাজ গাইতে বলতেন। তিনি এতোটাই শক্তিশালী ছিলেন যে প্রত্যহ পাঁচ মণ ওজনের বারবেল অনায়াসে ভাঁজতেন। 

১৮৯০ সালের তৎকালীন বাংলার কলকাতাতে জন্মগ্রহণ করেন ভীম ভবানী। ভবেন্দ্রমোহন সাহা ছিলেন কলকাতার বিডন স্ট্রীটের বর্ধিষ্ণু সাহা পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা উপেন্দ্রমোহন সাহা মতান্তরে উপেন্দ্রনাথ সাহা ছিলেন বলিষ্ঠ পুরুষ। তিনি ছিলেন পিতার নয় পুত্রের মধ্যে পঞ্চম। ভবেন্দ্রমোহন ছোটো থেকেই ভবানী বলে পরিচিত ছিলেন৷ 

ভবেন্দ্রমোহনের যখন ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়স তখন দেশজুড়ে শুরু হয়েছে স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। এই সময়কালে তিনি হঠাৎ করে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েন৷ তারপর একদিন তাঁর সমবয়সী একটি ছেলে তাঁকে খুব মারধোর করেছিল৷ অপমানিত ভবেন্দ্রমোহন নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিয়ে দৈহিক শক্তি  সঞ্চয়ের জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। অতীন্দ্রকৃষ্ণ বসু ওরফে ক্ষুদিবাবুর কাছে গিয়ে শিখতে লাগলেন কুস্তি। অল্প বয়সেই কয়েকজন নামকরা পালোয়ানদের কুপোকাত করে তিনি সবার নজর কেড়ে নেন। পরবর্তীকালে তিনি পরিচিত হলেন 'ভীম ভবানী' নামে।  

ভীম ভবানী যখন উনিশ, সেসময় ভারতবিখ্যাত প্রফেসর রামমূর্তি তাঁর সার্কাস দল নিয়ে কলকাতায় আসেন।  ঘটনাক্রমে ভীম ভবানীর সাথে  তাঁর সাক্ষাৎ হলে তিনি তাঁকে সার্কাস দলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন৷ মায়ের সম্মতি পাওয়া যাবে না বুঝে ভীম ভবানী বাড়ি থেকে পালিয়ে সার্কাস দলের সঙ্গে রেঙ্গুন পাড়ি দেন এবং সেখান থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে জাভায়। সেখানে এক ওলন্দাজ কুস্তিগীর প্রফেসর রামমূর্তির সঙ্গে লড়তে চাইলে ভীম ভবানীর প্রস্তাব অনুযায়ী তিনি আগে তাঁর সঙ্গে লড়তে রাজী হলেন। মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই ভীম ভবানীর হাতে তিনি কুপোকাৎ।

অবশ্য ভীম ভবানী রামমূর্তির সার্কাসে বেশিদিন থাকেন নি, কারণ তিনি চাইতেন স্বাধীনভাবে তাঁর নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলা দেখাতে। কলকাতায় ফিরে প্রফেসর বোসের সার্কাসে কিছুদিন কাজ করার পর যোগ দিলেন প্রফেসর বসাক-এর বিশ্ববিখ্যাত 'হিপোড্রোম সার্কাস'- এ। এখানে তিনি নিজের মনের মতো খেলা দেখানোর সুযোগ পেলেন। তাঁর খেলাগুলি ছিল যেমন অভিনব তেমনি বিস্ময়কর। যেমন একটি সিমেন্টের পিপের মধ্যে কয়েকজন লোক বসিয়ে পিপেটিকে দাঁতে কামড়ে শূন্যে তুলে ঘোরাতেন। লোহার শিকল দিয়ে তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হলে শরীরের পেশীর চাপে সেগুলি তিনি মটমট করে ভেঙে ফেলতেন। একটি খেলায় তিনি দুহাতে দুটি মোটরগাড়িকে আটকে রাখতেন। ভারোত্তলনের খেলায় পাঁচ মণ ওজনের বারবেল তুলতেন অনায়াসে। এছাড়া বুকের ওপর হাতি তোলা তো ছিলই। বুকের ওপর রাখা কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে হাতিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া শুধু নয়, দুঃসাহসী ভীম ভবানী হাতিকে বুকের ঠিক মাঝ বরাবর এক মিনিট দাঁড় করিয়েও রাখতেন।

'হিপোড্রোম সার্কাস'-এর সঙ্গে ভীম ভবানী পূর্ব-এশিয়ার অনেকগুলি দেশ ভ্রমণ করেন। জাপান সম্রাট মাৎসুহিতো তাঁর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে একটি স্বর্ণপদক ও নগদ ৭৫০ টাকা উপহার দেন।

স্বদেশী মেলার সময় সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, অমৃতলাল বসু প্রমুখের সামনে বীরত্ব প্রদর্শন করে তিনি 'ভীম' উপাধি পান৷ অমৃতলাল বসু বলেন, "মহাভারতের ভীম এমনই একজন বীর ছিলেন। তুমি দেখিতেছি কলিকালের ভীম। আজ হইতে আর তুমি তো শুধু ভবানী নহে, তুমি ভীম ভবানী!"

ভীম ভবানীর খাদ্যতালিকা ছিল বেশ চমকপ্রদ। তিনি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ২০০ গ্লাস বাদামের শরবত ও এক ছটাক গাওয়া ঘি খেতেন। এরপর প্রাতঃরাশে তিনি খেতেন দুই সের মাংস। মধ্যাহ্নে তিনি খেতেন সাধারণ ডাল ভাত৷ অপরাহ্নে খেতেন দুই বা আড়াই টাকার ফল, ৫০ গ্লাস বাদামের শরবত ও এক সের মাংস। সবশেষে রাত্রিবেলায় তিনি আধ সের আটার রুটি ও তিন পোয়া মাংস খেতেন৷ তিনি অত্যন্ত সহজ সরল জীবনযাপন করতেন৷ তিনি ছিলেন অকৃতদার। তিনি তাঁর ছোট ভাইদের শরীরচর্চার প্রশিক্ষক ছিলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে তাঁর ভাইয়েরা অসামান্য শারীরিক ক্ষমতার অধিকারী হন। 
 
দেশে ফিরে এসে তিনি নানান জায়গায় শক্তি প্রদর্শন করতে থাকেন। ভরতপুরের মহারাজের কথায় তিনি তিনটে চলন্ত মোটরগাড়ি টেনে রাখেন। একটি গাড়িতে মহারাজ বসেছিলেন, অন্য দু'টিতে ইংরেজ রেসিডেন্ট ও রাজমিস্ত্রী। গাড়িগুলোর পিছনে দড়ি বাঁধা হল৷ একটি দড়ি ভীম ভবানী কোমরে বাঁধলেন, বাকি দু'টি ধরে রইলেন দুই হাতে। গাড়ি চালু হল, কিন্তু এক ইঞ্চিও নড়তে পারল না। বিস্মিত মহারাজা এক হাজার টাকা পুরস্কার দিলেন ভীম ভবানীকে। মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরকে খুশি করতে বুকের ওপর তিনি তুলেছিলেন বুনো হাতি। 

অসীম ক্ষমতার শক্তিধারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ১৯২২ সালে এ পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে বিদায় নেন। অথচ তিনিই ছিলেন দেশের শরীরচর্চার একজন রোল মডেল৷ তিনি শরীরচর্চার  জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগিয়েছিলেন। তবুও আজকে ভীম ভবানী নামটি বাঙালির কাছে একটি আত্মবিস্তৃত নাম।

প্রতিবেদন- সুমিত দে

তথ্যসূত্র- সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, লাইভমিন্ট ডট কম, ব্যায়ামে বাঙালি : অনিলচন্দ্র ঘোষ। 


  

No comments