বনসৃজনের ছোঁয়াতে বদলে যাওয়া ঝাড়বাগদা গ্রাম সবুজায়নের স্বপ্ন দেখাচ্ছে বিশ্বকে
মানুষই যখন সবুজায়ন ধ্বংসের খেলাতে মেতে উঠে পৃথিবীর বিপদ ডেকে আনছে তখন এই মানুষকেই বাঁচাতে হবে গোটা পৃথিবী। মানুষ চাইলে সব পারে। পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম হলো ঝাড়বাগদা। পুরুলিয়া শহর থেকে ৫৫ কিমি দূরে মানবাজার মহাকুমাতে অবস্থিত এই গ্রাম। এই তো বছর কুড়ি আগেও রুক্ষ অঞ্চল ছিল এই গ্রাম। ন্যাড়া ন্যাড়া পাহাড় ও গাছাপালাহীন মরুভূমির মতো অবস্থা ছিল ঝাড়বাগদার।
এখন পুরুলিয়ার ঝাড়বাগদা গ্রাম সবুজভূমিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৯ সাল থেকে এখানকার রুক্ষ প্রকৃতির রূপ বদলাতে গ্রামবাসীরা টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট নামে একটি এনজিওর শরণাপন্ন হন। ওই সংস্থা ততদিনে ঝাড়খণ্ডে বেশ কিছু সবুজায়ন প্রকল্প গড়তে সফল হয়েছে। এই সংস্থার হাত ধরে গ্রামবাসীদের ব্যাপক হারে বনসৃজন ও বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বদলে যায় ঝাড়বাগদা গ্রামের পুরো সৌন্দর্য।
সীমাহীন অরণ্য নিধনের জেরে নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত রুক্ষ, শুকনো ও অনুর্বর ছিল ঝাড়বাগদা। গ্রামের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো তিনটি ন্যাড়া টিলায় গজাত না একটি ঘাসও। শুধু একটি টিলার উপরে কোনও মতে দাঁড়িয়েছিল একটি তালগাছ।
গ্রীষ্মকালে এখানকার তাপমাত্রা থাকতো ৪৭ থেকে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রখর রৌদ্রের দাবদাহে শুকিয়ে যেত গ্রামের সকল পুকুর-দীঘি। জলস্তর প্রচণ্ড নীচে নেমে গিয়ে টিউবওয়েল পর্যন্ত বিকল হয়ে পড়তো। জলের সমস্যার জন্য জমিতে ঠিকভাবে ফসলও ফলত না। পানীয় জল আনার জন্য দুই কিমি পথ হেঁটে গ্রামের মহিলাদের জল নিয়ে আসতে হতো। শুধু জলই নয়, জ্বালানির কাঠ সংগ্রহের জন্য ৫ কিমি হাঁটতে হতো।
গ্রামবাসীদের এখানে এতোটাই কষ্টে দিন কাটাতে হতো যে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। গ্রামবাসীরা নিজেদের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের জন্য একাধিক পদক্ষেপ নিতে থাকে। তারা ৩০০ একর জমিতে প্রায় ৭৫ টি প্রজাতির তিন লাখেরও বেশি চারাগাছ লাগান৷ গাছগুলোর পরিচর্যার জন্য ৪০০ থেকে ৪২৫ টি বাড়ির বাসিন্দারা দিনরাত পাহারা দিতে থাকেন।
জল সংরক্ষণের ব্যাপারেও তারা জোর দিতে থাকেন। এখানকার বেশিরভাগ জমি অসমান থাকার জন্য বৃষ্টির জল দাঁড়াতে পারে না। তাই টিলা বেয়ে বৃষ্টির জল বয়ে যাওয়া আটকাতে গ্রামবাসীরা সমস্ত পাহাড়ি নালার মুখ বন্ধ করে দেন। টিলার মাথায় গভীর গর্ত খুঁড়ে জল সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করা হয়। গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে জমির চরিত্র বুঝে তারা অগ্রাধিকার দিয়েছেন কাঠ, জ্বালানি, পশুখাদ্য ও ফলদায়ী প্রজাতিকে।
আজকে এক সবুজে মোড়া গ্রামের রূপধারণ করে স্বমহিমায় এই গ্রাম। বন্যপ্রাণীদের জন্য তারা জঙ্গলের মধ্যে একটি পুকুরও খনন করেছেন। এখানকার জঙ্গলে এখন বহু বন্যপ্রাণী বসবাস করে। শেয়াল, খরগোশ ও হাতিদের প্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছে এখানকার জঙ্গলটি। এখন এই গ্রামে আর কোনো কষ্টের চিহ্ন নেই গ্রামবাসীদের। গ্রীষ্মকালে উষ্ণতাও অনেকটা কমে গেছে এখানে। ঝাড়বাগদার এমন আমূল পরিবর্তন নজর কেড়েছে কতগুলো জাপানি সংস্থার। যে সংস্থাগুলো গ্রামের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য আর্থিক অনুদানও দিচ্ছে। বাংলার এই গ্রাম আজকে পৃথিবীকে সবুজায়নের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment