Header Ads

বাংলা কমিকসের জাদুকর নারায়ণ দেবনাথ পাচ্ছেন 'পদ্মশ্রী'


তিনি বাংলার এক কিংবদন্তি কমিকস শিল্পী। যিনি আমাদের শৈশবকে নানান কমিকসের ভিড়ে ভরিয়ে দেন। 'নন্টে-ফন্টে', 'হাঁদা ভোঁদা', 'বাঁটুল দি গ্রেটে'র মতো অসাধারণ সৃষ্টি প্রায় সব বাঙালির পছন্দ। তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের সবার প্রিয় ব্যক্তি নারায়ণ দেবনাথ। ইতিমধ্যেই 'বাঁটুল দি গ্রেট', 'হাঁদা ভোঁদা' ও 'নন্টে-ফন্টে' অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করেছে। 


নারায়ণ দেবনাথের ছেলেবেলার আইকন ছিলেন হলিউড সিনেমার 'টারজান।' তিনি ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতেন বড়ো হয়ে একজন বডিবিল্ডার কিংবা গায়ক হবেন। যদিও ১৯৪০ সালে তিনি ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ থেকে ফাইন আর্টসে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি বেছে নেন বাণিজ্যিক গ্রন্থ অলংকরণ শিল্পীর জীবিকা। তাঁর প্রথম কমিকস আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত বিমল ঘোষের কাহিনী অবলম্বনে রবীন্দ্রজীবনী 'রবি ছবি'। এরপর তিনি একে একে নিয়ে আসেন 'হাঁদা ভোঁদা', 'বাঁটুল দি গ্রেট', 'শুঁটকি আর মুটকি', 'পটলচাঁদ, 'নন্টে-ফন্টে', 'কৌশিক রায়', 'বাহাদূর বেড়াল', 'ডানপিটে খাঁদু', 'কেমিক্যাল দাদু', 'বটুকলাল' এর মতো জনপ্রিয় কমিকস্ চরিত্র।  

পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর লেখা ও আঁকা কমিকস সব বয়সের বাঙালিকে মাতিয়ে রেখেছে। কমিক স্ট্রিপ ছাড়াও তিনি শিশু-কিশোরদের উপন্যাসও অলঙ্করণ করেছেন। বিশ্বের দীর্ঘতম কমিক স্ট্রিপ হিসেবে তাঁর 'হাঁদা ভোঁদা' বিশ্বরেকর্ড করেছিল। 

বাংলা কমিকসের জগতে নারায়ণ দেবনাথের আগমন ঘটে দেব সাহিত্য কুটিরের সম্পাদকমণ্ডলীর উৎসাহে। তাঁর প্রথম কমিকস 'হাঁদা ভোঁদা' নামটিও তাদের প্রস্তাবিত। সে সময় বাংলা কমিকস্ বলতে ছিল এক মাত্র প্রতুলচন্দ্র লাহিড়ীর আঁকা শেয়াল পন্ডিত, যা তখন যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হত। 'হাঁদা ভোঁদা' প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠকদের সমাদর পায় এবং শুকতারা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। শুরুতে নারায়ণ দেবনাথ নিজেই 'হাঁদা ভোঁদা'য় অঙ্কন ও কালি বসানোর কাজ করতেন। পরবর্তীকালে তা গ্রেস্কেলে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়।  
 
তিনি 'হাঁদা ভোঁদা' যখন শুরু করেছিলেন তখন বাংলা ভাষায় কমিকসের আবেদন প্রায় ছিল না বললেই চলে। অনেকটা একা হাতেই একটি জয়যাত্রার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি, যা অব্যাহত থাকে তাঁর পরের প্রতিটি সৃষ্টিতেই। বিশেষত 'বাঁটুল দি গ্রেট'-এর মাধ্যমে বাঙালি শিশুদের মাঝে কমিকপ্রীতির অভূতপূর্ব  জোয়ার আসে। 

সাহিত্যঙ্গনে তিনি তাঁর অবদানের স্বরূপ বহু স্বীকৃতি পেয়েছেন। একে একে তিনি অর্জন করেছেন 'সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার', 'বিদ্যাসাগর পুরস্কার' আর পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় সম্মান 'বঙ্গবিভূষণ'। একমাত্র ভারতীয় কার্টুনিস্ট হিসেবে তিনি ডি.লিটও অর্জন করেছেন। আর এবার তিনি সম্মানিত হতে চলেছেন 'পদ্মশ্রী' পুরস্কারে৷ শিল্পজগতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তাঁকে ভূষিত করা হচ্ছে এই সম্মানে। সকল বাঙালির কাছে এ এক গর্বের বিষয়।

নারায়ণ দেবনাথ গবেষক শান্তনু ঘোষ নারায়ণ দেবনাথের 'পদ্মশ্রী' পাওয়ার প্রসঙ্গে লিটারেসি প্যারাডাইসকে জানান যে,  "নারায়ণ দেবনাথের জন্ম ১৯২৫ সালে। এই ২০২১ এ দাঁড়িয়ে ওনার বয়স এখন ৯৬ হলো। এই বয়সে এসে ভারত সরকারের এতো বড়ো সম্মাননা তিনি পাচ্ছেন একজন বাঙালি শিল্পী হিসেবে যার মূল পরিচয় হচ্ছে  গ্রন্থ-চিত্রণ শিল্পী বা Book Illustration Artist এবং কমিকস্ শিল্পী। প্রথম কথা হচ্ছে চিরকালই সব দেশে জীবিত শিল্পীরা সম্মান পান কম। যদিও ব্যতিক্রমী শিল্পীও আছেন যারা জীবিত অবস্থাও সম্মানিত হয়েছেন। ইতিহাস তার সাক্ষী। নারায়ণ বাবু আজকে ৯৬ বছর বয়সে নিজের হাতে পুরস্কারটি তুলে ধরবেন; তার আত্মীয়, নাতি-নাতনী এবং ওনার যারা গুণমুগ্ধ তাদের পরিগোষ্ঠিত হয়ে সকলের সঙ্গে এই নিয়ে উনি আলোচনা করবেন৷ এই যে উনি দেখছেন, বিষয়টা অনুভব করছেন, ওনার ভেতরে যে অ্যাড্রেনালিন সিক্রেশন হচ্ছে এটার কোনো জবাব হতে পারে না।

নারায়ণ বাবু ১৯৫০ সাল মানে ওনার যখন ২৫ বছর বয়স তখন থেকেই তিনি ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। উনি প্রথমে যেটা করতেন তা হলো গল্পের সঙ্গে ছবি আঁকতেন যাকে আমরা Book Illustration বলি। ২০১৫ পর্যন্ত কম-বেশি প্রায় ৬৫ বছর ধরে উনি ফ্রিল্যান্সই করেছেন, কখনো কিন্তু কোনো সংস্থাতে উনি চাকরি করেন নি। তিনি কখনো ভেবেও দেখেন নি কাল কী হবে। উনি দুটো জিনিস করতে খুব ভালোবাসতেন। এক তিনি ছবিটা মন দিয়ে আঁকতেন যার জন্য উনি সাহায্য নিতেন মূলত অবজারভেশনে, বিভিন্ন বই, পত্র-পত্রিকা, সংবাদ পত্র থেকে রেফারেন্স ছবি দেখা। উনি অনেক সময় নিজের মেয়েকে শাড়ি পরা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে বলেছেন 'মিনু একটু ঘুরে দাঁড়া তো'। মানে ঐ শাড়ির ভাঁজ বা শাড়ির অবয়বটা উনি আঁকবেন বলে। বা কখনো কোনো বিদেশি বইয়ের কোনো রেফারেন্স নিয়েছেন যে সাহেবে র সুট টাই পরলে ঠিক কেমন লাগবে। আনন্দবাজার পত্রিকার দ্বিতীয় পাতার কর্ণারে রিপ কার্বি ও অরণ্যদেব কমিক্স স্ট্রিপ বেরোতো। উনি সেগুলো কেটে কেটে একটা খাতায় পেস্টিং করে রাখতেন। ওখান থেকে বিভিন্ন অ্যাকশন মুভমেন্টের রেফারেন্স নিতেন যেমন কেউ বন্দুক চালাচ্ছে, কাউকে ঘুষি মারছে। এভাবে তিনি অধ্যাবসায় করতেন। দুই, উনি খুব খাদ্যরসিক। তেলেভাজা, ভালো মাছ ও ভালো সব্জি খেতে উনি ভালোবাসেন। আগে তিনি নিজের হাতে বাজার করতে ভালোবাসতেন৷ ওনার জগৎ এই দুটোর পরে আরেকটি জিনিসে সীমাবদ্ধ ছিল তা হলো অ্যাকশন সিনেমা দেখতে উনি ভালোবাসতেন। উনি বরাবরই ভীষণ লাজুক, মুখচোরা, বিনয়ী ও ভদ্র। ওনাকে দেখে কেউ বুঝতে পারবেন না অ্যাডভেঞ্চার সিনেমা যেমন রবিনহুড, টারজান এবং নতুন সিনেমার মধ্যে ব্রুস লি ও জ্যাকি চ্যানের সিনেমা ওনার মুখস্থ। 

তিনি ওপর থেকে খুব শান্ত, বিনয়ী আর ভেতরে একজন অ্যাডভেঞ্চারার৷ এহেন নারায়ণ দেবনাথ ৯৬ বছর বয়সে গিয়ে যখন 'পদ্মশ্রী'র মতো পুরস্কার পাচ্ছেন তখন ওনার ভেতরে অতোটা উত্তেজনা হচ্ছে কিনা সন্দেহ আছে। ওনার বয়স তো অনেক হয়েছে, উনি তো ছবি আঁকতে খুব ভালোবাসতেন কিন্তু এখন সেই ছবি আঁকার উৎসাহটা তাঁর সবে বন্ধ হয়েছে। ওনার যে খুব সুখস্মৃতি নিয়ে জীবন গেছে তা নয়, অনেক জায়গা ও অনেক প্রকাশনা থেকেই উনি ওনার প্রাপ্য আর্থিক সম্মান পাননি। আবার শেষ জীবনে এসে অনেক কিছুই পেয়েছেন। বছর দশক আগে তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ ছিলেন, একদম মৃতপ্রায় অবস্থা। আমাদের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওনাকে বেলভিউ হাসপাতালে রাজ্য সরকার থেকে ওনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান 'বঙ্গবিভূষণ' (২০১৩) দেওয়া হয় তাঁকে, যেটা মূলত প্রবীণ নাগরিক শিল্পী, লেখকদের প্রদান করা হয়। একই বছরে তিনি 'বাল সাহিত্য একাডেমী' পুরস্কারও পান। এইসব নানান সম্মানে তাঁকে ভরিয়ে দেওয়া হয়। ওনার প্রাণশক্তিই হচ্ছে এই ছোটো ছোটো উৎসাহ। 

পরবর্তীকালে মনে করাতে চাই, ব্রাত্য বসু যখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন সেই সময় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সিলেবাসে প্রজেক্ট পেপারের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো বড়ো সাহিত্যিকদের পাশে একজন কমিকস্ শিল্পীকে স্থান দেওয়া সত্যিই ওনার জীবনের বড় পাওয়া। আমি মনে করি, এটা ওনার একক সম্মান নয়, কেননা খুব কম গ্রন্থ অলঙ্করণ শিল্পী ও বুক কভার আর্টিস্ট আছেন যারা বাংলাতে কাজ করেন তাদের একটাই বক্তব্য কী পেলাম? নারায়ণ বাবু এসব কথা কিন্তু জীবনে কখনো ভাবেন নি। ৯৬ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষ সচরাচর বাঁচে না। আজকে ৯৬ বছরে দাঁড়িয়েও তিনি কী পেলাম এটার হিসেব রাখেন না। আমি যে কাজটা করবো সেরা কাজ করবো তাতে কী পেলাম আর না পেলাম আই ডোন্ট কেয়ার। এই যে তাঁর লার্নিং, তাঁর জীবনের ভাবনা, তাঁর জীবনের ফিলোজফি, তাঁর জীবন দর্শন নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের প্রেরণা জোগাবে বলে আমার মনে হয়।"

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments