Header Ads

নজরুলের রাজনৈতিক চেতনার জ্বলন্ত উদাহরণ তাঁর প্রতিষ্ঠিত 'লাঙল পত্রিকা'


১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে প্রথম গান্ধীজির সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। তাঁর আগমন উপলক্ষে নজরুল কবিতা ও গান রচনা করেছিলেন, যা শুনে গান্ধীজি খুবই খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু নজরুল উপলব্ধি করেছিলেন যে, গান্ধীজির আন্দোলনে দেশের স্বাধীনতার পথ সুগম হবে না। তাই তাঁর মন জনগণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই বিষয়টি নিয়ে নজরুল তাঁর বন্ধু কুতবুদ্দীন আহমদ, হেমন্তকুমার সরকার প্রমুখের সঙ্গে আলাপ করেন।


একসময় স্থির হয়, তাঁরা চার জন উদ্যোগী হয়ে একটি দল গঠন করবেন। প্রথমে দলটির নাম ঠিক হয় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত 'লেবার স্বরাজ পার্টি' (The Labour Swaraj Party of the Indian National Congress). এই দলের প্রথম ইশতেহার কাজী নজরুল ইসলামের দস্তখতে প্রকাশিত হয়েছিল।

পার্টি গঠন হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখপত্ররূপে সাপ্তাহিক 'লাঙল' পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে লাঙল-এর প্রথম খণ্ড বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। লেবার স্বরাজ পার্টির অফিসের জন্য কলকাতা ৩৭ নম্বর হ্যারিসন রোডের দোতলায় দু’খানা কামরা ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। এই ঠিকানা থেকেই লাঙল পত্রিকার প্রকাশনা আরম্ভ হয়। লাঙল-এর প্রধান পরিচালক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের নাম ছাপা হতো। আর সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হতো নজরুলের বাঙালি পল্টন জীবনের বন্ধু মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের। শেষের তিনটি সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন শ্রীগঙ্গাধর বিশ্বাস।

লাঙল পত্রিকা–লাঙল ছিল 'শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়' নামে শ্রমিক শ্রেণীর একটি সংগঠনের মুখপত্র। নজরুল এর সম্পাদক হলেও পত্রিকার প্রচ্ছদে তাঁর নাম ছাপা হত মুখ্য পরিচালক হিসেবে, আর সম্পাদক হিসেবে ছাপা হত মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নাম। এছাড়া পত্রিকার প্রচ্ছদে কাঁধে লাঙলবাহী একজন কৃষকের ছবিও থাকত। পত্রিকার প্রথম পাতায় মানুষের মহত্ত্ব প্রচারের উদ্দেশ্যে চন্ডীদাসের একটি উক্তি মুদ্রিত হত।

লাঙলের প্রথম সংখ্যার প্রধান আকর্ষণ ছিল 'সাম্যবাদী' শিরোনামে এগারোটি কবিতার সমাহার। কৃষক, নারী, দিনমজুর, কুলি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর পীড়িত ও নির্যাতিত জীবনের বর্ণনাত্মক এ কবিতাগুলি পরবর্তীকালে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। পত্রিকার এই বিশেষ সংখ্যার প্রায় পাঁচ হাজার কপি ছাপানো হয়েছিল, কিন্তু এর চাহিদা এতই ব্যাপক ছিল যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব কপিই বিক্রি হয়ে যায়।

নজরুল লাঙলের অন্যান্য সংখ্যায়ও নিজের কিছু বিখ্যাত কবিতা প্রকাশ করেন, যেমন 'কৃষাণের গান', 'সব্যসাচী' এবং 'সর্বহারা'। লাঙলে অন্যান্য লেখকের রচনাসমূহের বিষয়বস্তু ছিল তৎকালীন সমাজতন্ত্রী নেতা কার্ল মার্কস, লেনিন বা সোভিয়েত রাশিয়ার রাজনৈতিক গতিধারা, চীনের পুনর্জাগরণ ইত্যাদি।

১৯২৬ সালের ২৩ শে জানুয়ারি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লাঙলের একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তাতে তাঁর জীবনী এবং অপ্রকাশিত কয়েকটি চিঠি স্থান পায়। পত্রিকার লেখকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ ও সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সৌম্যেন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখেন। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়কৃত গোর্কির মা উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ এ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালের ১৫ ই এপ্রিল লাঙলের পঞ্চদশ ও শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এ বছরের ১২ ই আগস্ট মুজাফ্ফর আহমেদ গণবাণী নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন, যার সঙ্গে লাঙল একীভূত হয়ে যায়। গণবাণীও ছিল 'বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলে'র মুখপত্র।

পত্রিকাটি সূচনা থেকেই একটি সমতাভিত্তিক শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণের প্রশ্নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। একারণে ছুৎমার্গের হীন সংস্কৃতি ও বর্ণবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। তারা এ বিষয়ক প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রতিবেদন বা বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যমে জনমানসে প্রগতিশীল চেতনা বিকাশে ছিল যত্নশীল। এ লক্ষ্যেই পত্রিকার প্রথম খন্ডের বিশেষ সংখ্যায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বক্তব্য প্রকাশ করা হয়, যে বক্তব্যে তিনি বর্ণাশ্রয়ী সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করত খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের স্বপক্ষে লিখেন যাঁহারা বর্ত্তমানে বাঙ্গালার চার কোটী ষাট লক্ষের মধ্যে চার কোটী, যাহারা দেশের সার রক্ত, যাহারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া মাটি বর্ষণ করিয়া আমাদের জন্য শষ্য উৎপাদন করে, যাহারা ঘোর দারিদ্র্যের মধ্যেও মরিতে মরিতে বাঙ্গালার নিজের সভ্যতা ও সাধনাকে সজাগ রাখিয়াছে, যাহারা সর্ব্ব প্রকার সেবায় নিরত থাকিয়া আজিও বাঙ্গালার ধর্ম্মকে অটুট রাখিয়াছে, যাহারা আজিও শুদ্ধচিত্তে সরল প্রাণে মর্ম্মে মর্ম্মে বাঙ্গালার মন্দিরে মন্দিরে পূজা দেয়, মসজিদে মসজিদে প্রার্থনা করে, যাহাদের জন্য বাঙ্গালী আজিও বাঙ্গালী, যাহারা মাটি ও বাঙ্গালার জলের সঙ্গে এক হইয়া বাঙ্গালীর জাতীয়তা জ্ঞানে কি অজ্ঞানে সাগ্নিকের অগ্নির মত জ্বালাইয়া জাগাইয়া রাখিয়াছে, যাহাদের আমরা বিলাতি শিক্ষা মোহে, আইন-আদালতের প্রভাবে, জমিদারের খাজনা ন্যায্যভাবে কি অন্যায্যভাবে বাড়াইয়া, প্রলোভন দেখাইয়া, শত অত্যাচার করিয়াও একেবারে নষ্ট করিতে পারি নাই, যাহারা বাস্তবিকই বলীদের একবারে রক্ত মাংস প্রাণ, তাহারা বড় না আমরা বড়? কোন সাহসে কি অহঙ্কারে, তাহাদের জল স্পর্শ করি না? কাছে আসিলে ঘৃণিত কুকুরের-মত তাড়াইয়া দিই? এত অহঙ্কার কিসের? দাম্ভিকতা কেন? ঐ যে বাঙ্গালার কৃষক সমস্ত দিন বাঙ্গালার মাঠে আপনার কাজ ও আমাদের কাজ শেষ করিয়া দিবাবসানে ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে বাঙ্গালার কুটীরে বাঙ্গালায় গান গাহিতে গাহিতে ফিরিতেছে, তাহারা মুসলমান হউক, শূদ্র হউক, চন্ডাল হউক, উহারা প্রত্যেকেই যে সাক্ষাৎ নারায়ণ।

স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর উক্তি বা বাণী বা কবিতাংশ কখনো স্কেচ ছাড়াও ছাপা হতো লাঙল-এ। বিষয় ভিত্তিক ছবি ছাপা হতো চীন রাষ্ট্রগুরু ডা. সান ইয়াৎ, সুভাষচন্দ্র বসু, কার্ল মার্কস, লেনিন-এর। শ্রী নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো ম্যাক্সিম গোর্কির বিখ্যাত রচনা 'মা'। দু-একটি সংখ্যায় চিঠিপত্রও থাকত। আরো থাকত প্রজাস্বত্ব আইনের ধারাবাহিক আলোচনা ও গণ-আন্দোলন সম্বন্ধীয় পুস্তকের আলোচনা ও সংকলন।

প্রতিবেদন- শুভজিৎ নস্কর


No comments