Header Ads

এক মরা নদীর গল্প, যেভাবে সরস্বতী নদী ধ্বংস হয়ে যায়


"যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে, সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে।" সরস্বতী নদীর অবস্থা এখন ঠিক এই রকম। হুগলি নদীর একটি উপনদী ও ভাগীরথী নদীর শাখানদী হিসেবে পরিচিত ছিল সরস্বতী নদী। যা ১৬ শতক পর্যন্ত সক্রিয় ছিল কিন্তু বর্তমানে এই নদী একটি খালে পরিণত হয়েছে। আজকে সরস্বতী একটি মৃত নদীর নাম। অধুনা মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত ছিল এই নদীর প্রধান শহর। পরবর্তীকালে তাম্রলিপ্ত বন্দরের অবলুপ্তির পর হুগলির সপ্তগ্রাম হয় এই নদীর প্রধান বন্দর। হুগলির ত্রিবেণীতে রয়েছে সরস্বতী নদীর মোহনা। বাংলার নদী সরস্বতীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মনসামঙ্গল কাব্যে। এই কাব্য অনুসারে প্রভাবশালী বণিক চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যপোতের সাগরযাত্রার পথটি ছিল --- সপ্তগ্রাম থেকে উজানে ত্রিবেণী হয়ে সাগর। বিশ্বাস করা হয় সরস্বতী অধুনা রূপনারায়ণের খাত বরাবর হয়ে মোহনায় পড়ত তাম্রলিপ্ত বা এখনের তমলুক হয়ে। তখন সরস্বতীর উপনদী ছিল রূপনারায়ণ, দামোদর সহ অনেক নদ-নদী।


হুগলি শহরের কয়েক মাইল দূরে ত্রিবেণী থেকে বার হয়ে বলুহাটি গ্রামের কাছে হাওড়া জেলায় প্রবেশ করে ডোমজুড় ও আন্দুলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাঁকরাইলের নিকট হুগলি নদীতে পতিত হয়েছে। একসময় যে এটি বড়  নদী ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় উঁচু পাড় এবং পাড়ের কাছে মাঝে মাঝে বড় বড় নৌকার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যেত। এই নদীটির মাঝে মাঝে   দহ নামক বড় বড় পুকুর আছে। দহ নামযুক্ত অনেক গ্রামও আছে, যেমন --- মাকড়দহ, ঝাপড়দহ, বন্দরদহ প্রভৃতি। 

দামোদর, রূপনারায়ণ সহ বহ উপনদী শাখানদীর জলধারা নিবিড় ভাবে যুক্ত ছিল এই নদীর সাথে। যার ফলে হুগলি নদীর এই উপনদীটিতে জলও ছিল পর্যাপ্ত। সে কারণে বাংলার দক্ষিণ অংশ ও ওড়িয়ার কিছু অংশে ষোড়শ শতকে সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রধান যাত্রাপথ হিসেবে কাজ করত এই সরস্বতী নদী। তখন এই নদী ছিল পৃথুলা, বহু জনপদের ধাত্রীসমা। 

১৫৬৫ সালে ফ্রেডেরিক সাহেব সুস্পষ্ট ধারণা দেন যে "বেতড়ের উত্তরে সরস্বতীর প্রবাহ অত্যন্ত অগভীর হয়ে পড়েছে, সেজন্য ছোট জাহাজও সপ্তগ্রাম পর্যন্ত যাওয়া আসা করতে পারে না।" 

সপ্তম শতাব্দী থেকে সরস্বতীর উৎপত্তিস্থলে একটু একটু করে পলি জমতে শুরু করে এবং আস্তে আস্তে অষ্টম শতকের পর সরস্বতী নদীর প্রাচীনতর প্রবাহ পথের মুখ ও নিম্নতর প্রবাহ শুকিয়ে যায়। ফলে তাম্রলিপ্ত বন্দরের অবলুপ্তি ঘটে। এরপর প্রধান বন্দর হিসেবে সপ্তগ্রামে সরস্বতী নদীর বাণিজ্য যাত্রার প্রধান বন্দরে পরিণত হয়। কিন্তু নদীর আয়তন হ্রাস ও জলের গভীরতা কমে গিয়ে সরস্বতী নদী নিতান্তই একটি খালে পরিণত হয়। সাথে সাথেই সপ্তগ্রাম বন্দরেরও অবলুপ্তি ঘটে। এখন যে সরস্বতী নদী আমরা বাংলাতে দেখতে পাই তা খাল, ক্ষীণজলের ধারা ও দূষিত জলাশয় আকারে ত্রিবেণী থেকে বেরিয়ে শঙ্খনগর, সপ্তগ্রাম পার করে হারিয়ে গেছে প্রবাহপথ। এর একটি মজে যাওয়া শাখা আন্দুল কলেজের পাশ হয়ে এখনও বইছে। এরপর ক্রমশ বুজে গেছে অথবা আটকে গেছে জনবসতির চাপে, কচুরিপানায় কিংবা মাছের ভেরিতে, নদী গিলে ফেলা ইটভাটায়। 

তথ্যসূত্র- বাঙালীর ইতিহাস (নীহাররঞ্জন রায়), হাওড়া জেলার ইতিহাস (অচল ভট্টাচার্য)

No comments