রামকিঙ্কর বেইজের তথ্যচিত্র বানানোর তাগিদে অসুস্থ শরীরে পায়ে হেঁটে বোলপুর গেলেন ঋত্বিক ঘটক
"আমি যদি ছবি আঁকতে পারি, তাহলে কোনো সমস্যাই নেই। বর্তমান শিল্পীদের মূল সমস্যা হলো কাজ করার স্বাধীনতা ও ইচ্ছে। বিয়ে না করলেও ঘরবাঁধার সুখ শিল্পের কাছেই মিটে যায়। জীবনে নারীর প্রয়োজন আছে, কারণ পুরুষ প্রকৃতির সৃষ্টি। মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির লীলাকে আমি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। ঈশ্বর যদি প্রকৃতিকে নিয়ে খেলেন, মানুষ কেন খেলবে না? অতএব পিকাসো কথিত প্রকৃতিকে পুনঃনির্মাণ করতে গিয়ে শিল্পী তাকেই অপমানিত করে- এ বচন আমি মানি না৷ আমার প্রকৃতি মায়া। প্রকৃতিতে মায়ার খেলা চলে৷ প্রকৃতিতে যা আছে তার থেকে আনন্দ নাও। সৃষ্টি করো। শিশু জন্ম নেওয়া এক অর্থে পুনর্জন্ম সৃষ্টি করা।" সেকালের ও একালের শিল্পীদের সমস্যার প্রসঙ্গে একথা বলেছিলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ।
চিত্রশিল্প জগতের এক স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান ছিলেন রামকিঙ্কর বেইজ। যিনি একজন অসামান্য প্রতিভাবান ভাস্কর। ভাস্কর্য শুধু নয়, তেল রং, জলরঙে বহু চিত্র এঁকেছেন তিনি। ছবিগুলি প্রধানত প্রকৃতিকেন্দ্রিক। সিমেন্ট আর বোলপুরের কাঁকর-মাটি মিশিয়ে তিনি খোলা জায়গায় তৈরি করেছিলেন কিছু বিশালাকৃতি ভাস্কর্য। যার ভিত্তিভূমিতে রচিত হয়েছে সাধারণ গ্রামীণ মানুষের জীবন। তাঁর উন্মুক্ত কয়েকটি কাজ হল 'হাটের পথে', 'সাঁওতাল দম্পতি', 'সুজাতা' ইত্যাদি।
রামকিঙ্কর বেইজ জীবনের প্রাকৃতিক উৎসকে সাড়া দিয়েছিলেন। মানব মনের ব্যক্তিত্ব, দেহের ভাষা এবং সাধারণ মানব নাটকে খুব আগ্রহী ছিলেন। আধুনিক পশ্চিমা ও শাস্ত্রীয় শিল্প ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য বিষয়। তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্যকলার অন্যতম অগ্রপথিক। তবে ভিসুয়াল আর্টে তাঁর প্রথম বর্ণপরিচয় ঘটে। ছোটোবেলা থেকেই নানান উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বাড়ির চারপাশে। গ্রামে কুমোরদের ঠাকুর গড়ার দৃশ্য তিনি স্বচক্ষে অনুভব করতেন। কুমোরদের ঠাকুর গড়া থেকে নিজেও মূর্তি বানানোর কাজে লেগে পড়তেন। ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। এই সময়কালে তিনি ওয়েল পেইন্টিং এর কাজে তুখড় হয়ে ওঠেন।
তিনি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে শান্তিনিকেতনে আসেন। এখানেই পরিচয় ঘটে নন্দলাল বসুর সহিত। ধীরে ধীরে তিনি নন্দলাল বসুর সাথেও কাজ করা শুরু করে দেন। শান্তিনিকেতনে তিনি শিল্পসত্ত্বার যথার্থ মুক্তির পথ খুঁজে পান। তিনি স্ব-চিন্তায় একমনে ছবি আঁকতেন ও মূর্তি গড়তেন। তাঁর প্রথম ওপেন এয়ার ভাস্কর্য হলো 'সুজাতা'। তাঁর ওয়েল পেইন্টিং চিত্রের নাম হলো 'গার্ল অ্যান্ড দ্য ডগ।'
যে সমস্ত মানুষ প্রথাগত শিক্ষার বাইরে বেরিয়ে সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে দেশ-বিদেশে আলোড়ন তুলেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম রামকিঙ্কর বেইজ। অনেকে বলেন পাড়া গাঁয়ে থাকলে নাকি কোনো উন্নতি হয়না, পাড়া গাঁয়ে নাকি ভূতের বসবাস এভাবে শহরের এলিট সম্প্রদায়ের মানুষেরা বেশ কিছু অভিযোগ তোলেন। এসব ভ্রান্ত অভিযোগ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন রামকিঙ্কর বেইজ৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। রবি ঠাকুর ভালোবেসে তাঁকে শান্তিনিকেতনের 'এক অন্যরকম বাসিন্দা' বলে সম্বোধন করতেন। বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে সোনার চামচ মুখে না নিয়ে জন্মেও আশার আলো হয়ে ওঠেন তিনি।
রামকিঙ্কর বেইজের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে স্বয়ং ঋত্বিক ঘটক তথ্যচিত্র বানানোর জন্য বোলপুরে ছুটে আসেন অসুস্থ শরীর নিয়েও। ক্ষণজন্মা এক অস্থির মানুষ ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। চলচ্চিত্রকে যিনি যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। দেশভাগের যন্ত্রণা ও জন্মভূমির শিকড়ের টান এক একটা ফ্রেম হয়ে ধরা দিতো তাঁর ছবিতে। 'অযান্ত্রিক', 'মেঘে ঢাকা তারা', 'কোমলগান্ধার', 'সুবর্ণলতা' প্রভৃতি ছবি বানিয়ে তিনি অমর হয়ে আছেন বাঙালির কলিজায়। তাঁর শেষ জীবনে রামকিঙ্কর বেইজ তাঁকে আকর্ষণ করেছিল।
ঋত্বিক ঘটক রামকিঙ্করকে খুঁজে নিয়েছিলেন তাঁর ফ্রেমে, গতির নৈরাজ্যে। রামকিঙ্করের ভেতরে আভ্যন্তরীণ অশান্তিকে ডকুমেন্টারির মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছিলেন। এই তথ্যচিত্রে বাস্তববাদ, শিল্প ও শিল্পীর আকাঙ্খা, জীবনবোধকে তুলে ধরা হয়েছিল৷ রামকিঙ্কর বেইজের কর্মকাণ্ড তাঁকে খানিকটা মানসিক শান্তি দিয়েছিল।
মানবজীবন আর প্রকৃতিকে সেতুবন্ধণের মাধ্যমে গ্রথিত করতেন তাঁর মূর্তি গড়ার মাধ্যমে। তাঁর পরিমিত ভাবনা আরও বেশি প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে ঋত্বিক ঘটকের অ-মুক্তিপ্রাপ্ত রামকিঙ্কর বেইজের ওপর বানানো তথ্যচিত্রটি। ঋত্বিক ঘটক ঠিক করেন আলগা ধানঝাড়া শরীরে তিনি যা বলবেন সবটাই ক্যামেরাতে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে শ্যুট করা হবে। রামকিঙ্কর বেইজ ঋত্বিক ঘটকের কথামতো ঠিক তাই-ই করে গেলেন। রামকিঙ্কর বেইজ অনুভূতির কথা বলতে লাগলেন। মুখে তাঁর নেই হাসির কল্লোল, নেই কোনো গাম্ভীর্য ভাব। তিনি আপন মনে বলে চলেছেন কত শত জানা-অজানা কথা। তাঁর কথাকে গ্রাম্য বা শহুরে কোনোটাই বলা যাবে না৷ তিনি একজন উন্নত চরিত্রের বক্তাও ছিলেন। তিনি বলছেন আর ঋত্বিক ঘটক ক্যামেরার পাশে বসে আপন দৃষ্টিতে দৃশ্য নির্ধারণ করছেন৷
শ্যুটিং এর ফাঁকে ফাঁকে কথাও চলতে থাকে দুজনের মধ্যে খোয়াই নদীর পাড়ে। ঋত্বিক ঘটক রামকিঙ্করের সাথে আড্ডা দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে রামকিঙ্কর মেকি ছিলেন না৷ রামকিঙ্করের ভেতরে তিনি এক অসীম প্রতিভাময় পৃথিবীকে দেখেছিলেন। রামকিঙ্কর বেইজের সাথে এতোটাই মাটির শিকড়ের যোগাযোগ ছিল যে ঋত্বিক ঘটককে আকর্ষণ করতে তিনি বাধ্য। ঋত্বিক ঘটক শরীরের সবস্র অসুস্থতা ভুলে গিয়ে রামকিঙ্কর বেইজকে পর্দাতে নিয়ে আনতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে এই কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। ১৯৭৬ সালে এ বাংলাকে বিদায় জানিয়ে পরলোকে পাড়ি দিয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক। এটাই ছিল ঋত্বিক ঘটকের শেষ কাজ। কেবল রামকিঙ্কর বেইজের টানে তিনি মৃত্যুকেও অবজ্ঞা করেছিলেন৷ এমনই শক্তিশালী প্রাণবন্ত শিল্পী ছিলেন রামকিঙ্কর বেইজ।
তথ্যসূত্র- বিপ্লব মাঝির জার্নাল, পরবাস
Post a Comment