অন্য উত্তমের আখ্যান
আজ ২৪ শে জুলাই,২০২০। ১৯৮০ সালে আজকের দিনেই আপামর বাঙালির মন কাঁদিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছিলেন বাঙালির 'একমাত্র' মহানায়ক উত্তম কুমার। তাঁকে নিয়ে লিখতে বসলে যেমন অনেক গুরুগম্ভীর বিশেষণ মাথায় আসে, তেমনি মাথায় আসে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেক বিতর্ক, উত্তম সুচিত্রা জুটির রসায়ন, মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গলের মত উত্তম বনাম সৌমিত্র নিয়ে বাঙালির চিরকালীন তর্ক। কিন্তু না, আজ উত্তম হারানোর দিনে এগুলোর কোনটা নিয়েই আলোচনা করবো না এই প্রতিবেদনে। বরং তাঁর অভিনীত এমন কিছু ছবির কথা বলবো যেগুলোতে উত্তম কুমারের ছকভাঙা অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছে।
১৯৭৫ সালে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়ের কাহিনী অবলম্বনে পীযূষ বোসের পরিচালনায় উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত 'বাঘ বন্দী খেলা' ছায়াছবিটি মুক্তি পায়। এই ছবিতে মহুয়া রায়চৌধুরী, পার্থ মুখার্জী, অসিত বরণ প্রমুখরাও অভিনয় করেন। আসলে এই ছবির কথাই সর্বপ্রথম মনে পড়ল এই কারণেই - যে উত্তম কুমারকে বাঙালি তার রোম্যান্টিক নায়ক হিসেবে দেখে এসেছে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে এমন একটি নেগেটিভ চরিত্রে তিনি যে অভিনয় করবেন তা প্রায় অভাবনীয়। খেতে বসে মাংসের বাটিতে দু'পিস মাংস গুণে কম পাওয়ায় স্ত্রীর ওপর অত্যাচার করছেন এমন দৃশ্য উত্তম কুমারের সিনেমাতে কল্পনা করা দুঃসাধ্য। নিজেকে রাজনীতির জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে নিজের ছেলেকেও ঠকাতে পিছপা হন নি তিনি। আসলে এই ছবিতে তাঁর ক্রূর, নিষ্ঠুর খলনায়কোচিত অভিনয় প্রমাণ করেছে যে তিনি যেকোনো ধরণের চরিত্রেই সমান সাবলীল। 'হোটেল স্নো ফক্স', 'বহ্নিশিখা', 'আলো আমার আলো', 'গড় নাসিমপুর', 'কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী' ইত্যাদি ছবিতে নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করলেও 'বাঘ বন্দী খেলা'য় ভবেশ ব্যানার্জীর চরিত্রটি আমার মতে উত্তম কুমার অভিনীত শ্রেষ্ঠ নেগেটিভ চরিত্র।
এরপর চলে আসি অবধূতের উপন্যাস অবলম্বনে অভিনেতা-পরিচালক বিকাশ রায়ের পরিচালনায় ১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত উত্তম-সাবিত্রী অভিনীত ছায়াছবি 'মরুতীর্থ হিংলাজ'-এর কথায়। এই ছবিতে 'থিরুমল'-এর চরিত্রে উত্তম কুমারের ছকভাঙা অভিনয় অবিস্মরণীয়! সমস্ত তীর্থযাত্রীরা যখন হিংলাজ মন্দিরের গুহার কাছে পৌঁছে নিজেদের পাপ স্বীকার করে পুজো দিচ্ছিলেন তখন কুন্তী ( সাবিত্রী চ্যাটার্জী ) তাঁর প্রেমিক থিরুমলকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানান ভগবানের কাছে। ঠিক তখনই পাহাড়ের উল্টোদিক থেকে 'হাহা' অট্টহাস্যে ফেটে পড়া উন্মাদ থিরুমলের চরিত্রে উত্তম কুমারের অভিনয় চিরদিন বাঙালির মনে গেঁথে থাকবে। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, অনিল চ্যাটার্জী, পাহাড়ি সন্যালের অনবদ্য অভিনয়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান এ ছবির সম্পদ।
এবার আসি অগ্নিশ্বর ছবির কথায়। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত এই ছবিতে দেশপ্রেমিক, আপাত কঠোর দরদী ডাক্তারের ভূমিকায় উত্তমকুমারের অভিনয় সত্যিই মনে রাখার মত। এই প্রসঙ্গে বলি স্বাধীনতা সংগ্রামীর ভূমিকায় ছোট্ট একটি চরিত্রে সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের নজরকাড়া অভিনয় আমায় বাকরুদ্ধ করে।
আপনারা অনেকেই হয়তো 'মঞ্জরী অপেরা' (১৯৭০) সিনেমাটি দেখেছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে অগ্রদূতের পরিচালনায় উত্তম-সাবিত্রী অভিনীত এই ছবিতে একজন প্রথাগত যাত্রাপালার নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন মহানায়ক। এই সিনেমাটি না দেখে থাকলে বুঝতে পারবেন না মঞ্চ অভিনেতা হিসেবে উত্তম কুমার কতটা উচ্চ মানের। তাইতো নায়ক হিসেবে খ্যাতির মধ্যগগনে থেকেও 'শ্যামলী' নাটকে অভিনয় করেন। সুধীন দাশগুপ্তের সুরে মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্তের গাওয়া গানগুলি এ ছবির সম্পদ।
সত্যজিৎ রায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জুটির হাত ধরে বাংলা সিনেমায় গোয়েন্দা গল্পের যে জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল তা এখনো অব্যাহত। ফেলুদা থেকে মিতিন মাসি বাংলা সাহিত্যের অসংখ্য গোয়েন্দা চরিত্র বাংলা সিনেমায় বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। কিন্তু শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় উত্তম কুমার অভিনীত 'চিড়িয়াখানা' (১৯৬৭) ছবিটি বোধহয় বাংলা গোয়েন্দা সিনেমার জগতে মাইলস্টোন হয়ে আছে। চিরাচরিত রোমান্টিক, পাশের বাড়ির ছেলে সুলভ ইমেজ থেকে বেরিয়ে এসে ক্ষুধাধার, বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় অন্য উত্তম কুমারকে চিনিয়েছিল। ১৯৬৭ সালে 'এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' ও 'চিড়িয়াখানা' ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন (তখন এই পুরস্কারের নাম ছিল 'ভরত') শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে এবং সত্যজিৎ রায় শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পান।
এরপর আর একটা সিনেমার কথা বলবো যেখানে উত্তম কুমার নিজেকে ভেঙে চুরে নতুন রূপে আবির্ভুত হয়েছিলেন। হিরেন নাগ পরিচালিত 'থানা থেকে আসছি'(১৯৬৫) সিনেমায় ইন্সপেক্টর তিনকড়ি হালদারের ভূমিকায় উত্তম কুমার যেন তথাকথিত আধুনিক সমাজের বিবেকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।অনেকেই আক্ষেপ করেন উত্তম কুমার কেন আরো বেশি করে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় কাজ করলেন না। আমি আবার খুব সুস্বাদু হলে একপিস মাছেও সন্তুষ্ট হই। বুঝতেই পারছেন আমি 'নায়ক'(১৯৬৬) ছবিটির কথা বলছি। "এই ছবিতে নায়ক অরিন্দম ধীরে ধীরে টাকার পাহাড়ে ডুবে যাচ্ছে" আমার মনে হয় হলিউডে হলে শুধু এরকম একটা স্বপ্নদৃশ্যের জন্যই অস্কার পেতে পারতেন উত্তম কুমার। শুধু তাই নয় কথা সাহিত্যিক শংকরের উপন্যাস অবলম্বনে অরবিন্দ মুখার্জীর পরিচালনায় উত্তম কুমার, অঞ্জনা ভৌমিক, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় অভিনীত 'চৌরঙ্গী'(১৯৬৮) ছবিতে শাহজাহান হোটেলের রিসেপসনিস্ট স্যাটা বোসের ভূমিকায় উত্তম কুমারের অভিনয় চির স্মরণীয় হয়ে আছে। অঞ্জনা ভৌমিকের সঙ্গে 'কখনো মেঘ' নামের একটি ডিটেকটিভ ছবিতে ও 'রৌদ্রছায়া' নামের আরেকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন মহানায়ক।
অভিনেতা উত্তম কুমারের পরতে পরতে সাজানো ছিল নানা স্তর। সপ্তপদী, পথে হলো দেরি, হারানো সুর ইত্যাদি ছবিতে যেমন আম বাঙালির রোল মডেল রোমান্টিক উত্তম কুমার, তেমনি উপরে অনেক সিরিয়াস ছবির কথা আলোচনা করলাম। সিরিয়াস ছবির তালিকায় বন পলাশীর পদাবলী, স্ত্রী, গৃহদাহ, এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, আমি সে ও সখা, এখানে পিঞ্জর, নিশিপদ্ম, ঝিন্দের বন্দী, সাহেব বিবি গোলাম, বিচারক, সন্ন্যাসী রাজা ইত্যাদি ছবির নাম অবশ্যই রাখতে হবে। কিন্তু উত্তম কুমার রসবোধ, কমেডি অভিনেতা হিসেবে তার প্রতিভার কথা আলোচনা না করলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। দেওয়া নেওয়া, সেই চোখ, ব্রজবুলি, মৌচাক, ধন্যি মেয়ে, রাজা সাজা ইত্যাদি ছবি দেখতে বসলে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। শুধু তাই নয় ব্যক্তি জীবনেও ভীষণ রসিক মানুষ ছিলেন উত্তম কুমার। খুব ভালো গানও গাইতে পারতেন তিনি। প্রায়শই বন্ধু বান্ধবদের আড্ডা জমে উঠতো তার উদাত্ত গলায় গেয়ে ওঠা গানে। শুধু তাই নয়, বসুশ্রী হলের বৈশাখী জলসায় অনেক প্রথিতযশা সংগীত শিল্পীর সাথে সাথে মহানায়কের গান শুনতে আসা শ্রোতাদের ভিড় সামলানো কঠিন হতো। যাইহোক প্রয়াণ দিবসে বাংলা ও বাঙালির ম্যাটিনি আইডল, মহানায়ক উত্তম কুমারকে স্মরণ করলাম আমার পছন্দের কয়েকটি সিনেমা দিয়ে সাজানো এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে।
Post a Comment