Header Ads

ছোট্ট ভোলার আত্মত্যাগের এক নির্মম কাহিনী


যাদের রক্তের বিনিময়ে এ মাটি কেনা হয়েছে তাদের আমরা আজকে ভুলতে বসেছি। কত কত বিপ্লবী শহীদ হয়েছেন স্বাধীনতার যুদ্ধে। সেই হিসেবের কথা আমরা ভেবে দেখিনা। আমরা প্রচণ্ড আধুনিক হয়ে পড়ছি। এতোটাই আধুনিক যে ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা পর্যন্ত আমরা ভুলে যাচ্ছি। তবুও যারা এনাদের মনে রাখতে চান তাদের জন্য আজকের এই প্রতিবেদন৷ আপনারা বিপ্লবী অপূর্ব সেনকে কী চেনেন? ১৯৩১ সালের ১৩ ই জুন তৎকালীন ব্রিটিশদের পোষা গোর্খা সৈন্যের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন অপূর্ব সেন। 


ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী ছিলেন অপূর্ব সেন। ১৯১৫ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ছাত্রডান্ডিতে জন্ম নেন তিনি৷ তাঁর পিতা ছিলেন হরিশ্চন্দ্র সেন৷ তিনি বিপ্লবী হিসেবে প্রথম যোগ দিয়েছিলেন অনুশীলন সমিতিতে৷ তারপর পরবর্তী কালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সদস্য হিসেবে যোগদান করেছিলেন। অপূর্ব সেনের ডাকনাম ছিল ভোলা৷ অনেকেই তাঁকে ভোলা বলে ডাকতেন। এই ভোলা ছিলেন একটি বাচ্চা ছেলে৷ মাত্র পনেরো বছর বয়সেই দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু করেছিলেন। 

পনেরো বছর বয়সে যেখানে বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েদের সঠিক জ্ঞানই হয়না, সেখানে অপূর্ব সেন লড়াই করছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। এতোটাই সাহসী ছিলেন তিনি৷ পনেরো থেকে আঠারো এই বয়স পৃথিবীকে সুন্দর করে চেনার বয়স। তবুও জীবনের সমস্ত আস্বাদ বিসর্জন দিয়ে অপূর্ব সেনদের লড়াই করতে হয়েছে কেবল আমাদের একমুঠো সুখ দেওয়ার জন্য। মৃত্যুভয়কে মৃত্যুঞ্জয়ের মতো মেনে নিয়ে সঞ্জীবনী মন্ত্রে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন তাঁরাই। ক্ষুদিরাম, প্রদ্যোৎ, প্রফুল্লের মতো তিনিও তরুণ বয়সেই শহিদ হয়েছিলেন৷ স্বাধীনতার যুদ্ধে শহিদ তালিকায় রয়েছে অপূর্ব  সেনের নামও৷  

১৯৩০ সালের ১৮ ই এপ্রিল স্বাধীনতার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই দিন  চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সংঘটিত হয়। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ৬৫ জন তরুণ যুবকদের একটি দল প্রস্তুত চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ মুক্ত করার জন্য। চট্টগ্রামের নিকটবর্তী রেলস্টেশনে লাইনচ্যুত হয়ে উল্টে যায় একটি মালগাড়ি। কারা যেন রেললাইনের ফিসপ্লেট খুলে রেখেছিল। ফলে চট্টগ্রামের সাথে পুরো দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ মাস্টারদার সহযোদ্ধারা বানচাল করে দেয় টেলিগ্রাম ও টেলিফোন পরিষেবাকে৷ এরপর আক্রমণ  চালানো হয় ইউরোপীয়ান ক্লাবে। সংগ্রামীদের গুলিতে নিহত হয় বহু ব্রিটিশ পুলিশ। লুঠ করা হয় কার্তুজ, লুইস গান, রাইফেল, বন্দুক সহ নানান অস্ত্র৷ অস্ত্র লুঠ করার পর মাস্টারদা অস্ত্রাগারের সামনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে চট্টগ্রামের অস্থায়ী সরকার গঠন করলেন৷ হঠাৎ লুইস গানের শব্দে কেঁপে উঠলো চতুর্দিক৷ বিপ্লবীরাও ব্রিটিশদের সাথে মেতে উঠলেন গুলির লড়াইতে।  

ছোটো ছোটো দলে যোদ্ধাদের বিভক্ত করে লড়াই শুরু হয়েছিল৷ একদল ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ এবং আরেক দল জালালাবাদ পাহাড়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে৷ দুই ঘন্টার প্রচণ্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন নিহত হন এবং বিপ্লবী যোদ্ধাদের ১২ জন শহীদ হন৷ এনারা হলেন ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, নরেশ রায়, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, হরিগোপাল বল, মতিলাল কানুনগো, প্রভাসচন্দ্র বল, শশাঙ্কশেখর দত্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ এবং অর্ধেন্দু দস্তিদার। তবে সেদিন কোনোক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন অপূর্ব সেন।  

১৯৩১ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সাথে যুক্ত ৩২ জন সংগ্রামীকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ। ঐ বছরের এপ্রিল মাসে এক বিশেষ আদালতে রাজদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত ৩২ জন বন্দির বিচার শুরু হয়। এই সময় মাস্টারটা মাইন ব্যবহার করে আদালতের প্রাচীর উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। তার সাথে আদালত ভবন উড়িয়ে দেওয়ারও পরিকল্পনা করেন৷ পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা নেন কল্পনা দত্ত৷ ৩ রা জুন হামলার দিন ধার্য করা হয়। তবে গোটা পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে পড়েছিল কারণ মাইন বসানোর আগেই বিপ্লবীদের ব্রিটিশরা দেখে ফেলেছিল ৷ 

মাস্টারদার বহু সহযোদ্ধা গ্রেপ্তার হন। মাস্টারদা গা ঢাকা দিলেন। ব্রিটিশ পুলিশ তাঁর সন্ধান করতে লাগলো। চারিদিকে ঘোষণা করা হলো মাস্টারদাকে ধরিয়ে দিতে পারলেই তাকে নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। ১৩ ই জুন পটিয়ার ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে বিপ্লবীরা আশ্রয় নেন। সূর্য সেন, নির্মল সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও অপূর্ব সেন সহ অনেকে মিলিত হন একসাথে। সেদিন রাত্রে প্রচন্ড জ্বর এলো অপূর্ব সেনের। তাই দোতলার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। আচমকা ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন কোনো বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় গোর্খা সৈন্য সমন্বয়ে হানা দেয় তাদের ধরার জন্য। ঘটনাস্থলে  বিপ্লবীদের গুলিতে মৃত্যু হয় ক্যামেরনের। গোর্খা সৈন্যদের গুলিতে মাস্টারদার সহযোদ্ধা নির্মল সেন প্রাণ হারান৷ ঘটনাস্থল থেকে বিপ্লবী অপূর্ব সেন দৌঁড়ে পালানোর সময় বন্দুকের গুলি এসে বিঁধে বসলো তাঁর গায়ে। তিনি লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। মাত্র ষোলো বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন অপূর্ব সেন ওরফে ভোলা। কিন্তু আমাদের জাতির এতোটাই সংকট যে আমরা ভুলতে বসেছি সেদিনের ছোট্ট ভোলাকে।


No comments