Header Ads

বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড ইতিবৃত্ত || অন্তিম পর্ব


আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন বিশিষ্ট রসায়নবিদ, শিল্পপতির পাশাপাশি একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদও বটে। তিনি সর্বদাই ব্যবসার যেমন প্রয়োজনীয়তা বুঝেছিলেন ঠিক তেমনি শিক্ষা প্রসারের গুরুত্বও তিনি সমানভাবে অনুভব করেছিলেন। আর তার ফলেই তিনি মানিকতলার কারখানাতে কারখানার কুলি-মজুরদের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে অল্পবয়সী প্রায় সব কর্মচারীরা সময় মতো পড়াশোনা করতে যেতেন। স্কুলের পাশাপাশি কারখানার সকল কর্মচারীদের জন্য একটি হাসপাতালও ছিল এবং সেই হাসপাতালের চার্জে ছিলেন একজন ডাক্তার। 


শুধু কি কাজ, কাজ আর কাজ? একটু আমোদ-আহ্লাদ করবেন না কর্মচারীরা, করবেন না কর্মচারীরা একটু আমোদ-আহ্লাদ? অবশ্যই করবেন। আর সেই আমোদ-আহ্লাদ করার জন্য একটি ক্লাব ছিল কারখানার মধ্যে। এইসব সুযোগ সুবিধাই এই বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানাকে যেন পূর্ণাঙ্গ শহরে পরিণত করেছে আর সেজন্যই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কথায় উঠে এসেছে,- "কারখানাটিকে একটি পুরো শহর বলা যেতে পারে।" তখনকার দিনে অর্থাৎ কুড়ির দশকে বারশোর মতো কি তার বেশি শ্রমিক বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানায় কাজ করতেন, যাঁদের মধ্যে অনেককেই বিনা ভাড়ায় বাসা দেওয়া হয়েছিল। এর থেকে কর্মীদের প্রতি আচার্যদেবের অসীম ও আন্তরিক ভালোবাসা প্রকাশ পায়। ১৯০৫ সালে মানিকতলায় একটি কারখানা প্রতিষ্ঠার পর বেঙ্গল কেমিক্যালের আরও তিনটি কারখানা বা শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন- ১৯২০ সালে পানিহাটিতে, ১৯৩৮ সালে মুম্বাইতে এবং ১৯৪৯ সালে কানপুরে। মানিকতলার কথা এই প্রবন্ধের পঞ্চম পর্বে ও পানিহাটির কথা সপ্তম পর্বে উল্লেখ করা আছে। যাইহোক, এই কোম্পানির রেজিস্টার্ড অফিস কিন্তু কলকাতার ৬ নং গনেশ চন্দ্র এভিনিউ-এ থাকে।  

তো, এই ছিল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শুরু করে বিশ দশক অব্দির কাহিনী যা পড়ে আমরা বুঝতে পারি, অনুভব করতে পারি আচার্যদেবের আমলে বেঙ্গল কেমিক্যালের স্বর্ণযুগের কথা। দেশ স্বাধীন হবার তিন বছর আগে অর্থাৎ ১৯৪৪ সালের এই জুন মাসেরই ১৬ তারিখে আচার্যদেব আমাদের ছেড়ে পরলোক গমন করেন। সমগ্র দেশবাসীর বিশেষ করে বাঙালি জাতির জন্য রেখে যান বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাকিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে। এই দৃষ্টান্ত থেকে আমরা ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা নিতে পারি। শ্রদ্ধেয় আচার্যদেব বাঙালিকে মানুষের মতো মানুষ করতে চেয়েছিলেন, পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ানো তাঁর মনঃপুত হয়নি। তিনি চেয়েছিলেন বাংলার যুব সমাজ স্বাবলম্বী হোক, নিজেদের পুঁজি ও  বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করে নিজেদের পায়ে নিজেরাই দাঁড়াক। আর তাই উদাহরণ হিসেবে বেঙ্গল কেমিক্যাল সহ বিভিন্ন রাসায়নিক কলকারখানা তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সেই কবে ১৯০৮ সালে জন কুমিং তাঁর "Review of the Industrial Position and Prospects in Bengal" বা বাংলায় শিল্প ও অবস্থানের সম্ভাব্যতার পর্যালোচনা করতে গিয়ে বেঙ্গল কেমিক্যাল সম্পর্কে লিখে গেছেন,- "Enterprise shows signs of resourcefulness and business capacity, which should be an object lesson to capitalists of this province" অর্থাৎ "এই সংস্থাটি সম্পদশীলতা ও ব্যবসায়িক দক্ষতার লক্ষণগুলি দেখায়, তা এই প্রদেশের পুঁজিপতিদের জন্য শেখার বিষয় হওয়া উচিৎ।"


এখানে উল্লেখ্য, স্বাধীনতার আগে আচার্যদেবের আমলে বেশ সফলতার সাথেই চলছিল বেঙ্গল কেমিক্যাল অর্থাৎ বেশ লাভজনক কারখানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু আচার্যদেবের মৃত্যুর পর সেই সফলতার সময় বা স্বর্ণযুগ অনেকটাই ফিকে হয়ে যায় কেননা তখন থেকেই এই কোম্পানিকে এক অস্তিত্বের লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হয়। স্বাধীনতার পর বিশেষ করে ১৯৫০-এর দশক থেকে শুরু করে প্রায় ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে এই কোম্পানি কেবল লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে। ১৯৬৫-র দিকে বাজারের পরিস্থিতি এমনই হয় যা এই কোম্পানির ক্ষেত্রে এক  প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দেয়। এরপর ৭০-এর দশকে এই কোম্পানি এক অন্ধকারময় সময়ের মধ্যে দিয়ে যায়। ১৫ ই ডিসেম্বর, ১৯৭৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে এই কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট চলে যায় এবং ১৯৮০ সালের ওই একই দিনে এই কোম্পানিকে এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় বা পিএসইউ (পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং)-এ রূপান্তরিত করা হয়। এর ফলে এই কোম্পানি এক পুনর্জীবন লাভ করে এবং ১৯৮১ সালে সেই নতুন কোম্পানির নাম হয় 'বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড'। কিন্তু তা সত্ত্বেও তেমন সফলতার মুখ দেখেনি এই কোম্পানি। অনেকবার এই কোম্পানিকে বিক্রি করবার কথাও উঠেছিল। অবশেষে, দীর্ঘ ষাট বছরের অধিক সময় ধরে অনেক লোকসানের পর, ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে নীট আয় ৪ কোটি টাকা লাভের মাধ্যমে এই কোম্পানি সফলতার মুখ দেখে। ২০১৭-১৮ আর্থিক বর্ষে নীট আয় হয় ১০ কোটিরও উপর এবং ২০১৮-১৯ এ তা হয় প্রায় ২৫ কোটি। এই সফলতা আজও এই কোম্পানি বহন করে চলেছে। যদিও অনেক বিভাগ, ওষুধ, রাসায়নিক সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি এই  কারখানাকে তৈরির পথে আচার্যদেবের সময়কার মতো আরও এগিয়ে আসতে হবে।অনেক ওষুধ, রাসায়নিক সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি এই কারখানা যেগুলো আগে তৈরি করত কিন্তু এখন তৈরি করে না সেগুলো আবার তৈরি  করলে ভালো হয়। তবুও এই মুহূর্তে, পর্যাপ্ত কাঁচা মাল বা র ম্যাটেরিয়াল না থাকা সত্ত্বেও, প্রতিদিন অগণিত বা ১০-১৫ লাখ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন প্রস্তুতের মাধ্যমে আশার আলো দেখিয়ে চলেছে বাংলা তথা ভারতের অন্যতম সেরা এই রাসায়নিক কারখানাটি। এখানে উল্লেখ্য এই যে, ভারত স্বাধীনতার বহু বছর আগেই ১৯৩৪ সালে আচার্যদেবের জীবিতকালেই ১৯৩৪ সালে এই কোম্পানি ক্লোরোকুইন প্রথম প্রস্তুত করেছিল।বর্তমানে এই কোম্পানির সারা দেশে নয়টি বিক্রয় কেন্দ্র এবং বিভিন্ন সি এণ্ড এফ এজেন্সি (ক্লিয়ারিং এণ্ড ফরওয়ারডিং এজেন্সি) আছে। বর্তমানে এই কোম্পানি নানান 'হোম কেয়ার' দ্রব্য প্রস্তুত করে থাকে যেমন সাদা ও কালো রঙের ফিনাইল, ন্যাপথালিন এবং ব্লিচিং পাউডার। সুখের কথা, পুজোর আগেই এই কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসতে চলেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। বর্তমানে এটি কেন্দ্রীয় সরকারের   রাসায়নিক ও সার মন্ত্রক বিভাগের অধীনস্থ। এই কারখানার বর্তমান বিভাগগুলি হলঃ- 

অ্যালুমিনিয়াম সালফেট
প্রসাধনী এবং গৃহসামগ্রী
ড্রাগ ও ফার্মাসিউটিক্যাল

আশা রাখা যায়, ভবিষ্যতেও মানবসমাজকে আশার আলো দেখাবে আচার্যদেবের হাতে গড়া এই কারখানাটি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচেষ্টায় ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে এই কারখানা। তাছাড়া,বাঙালিকে ব্যবসা করার এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা হিসেবে এই কারখানা চিরকাল থাকবে তো বটেই! 




তথ্যসূত্রঃ- বেঙ্গল কেমিক্যাল, ছোটদের সেরা বিজ্ঞান রচনা সংকলন- প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সম্পাদনা- শ্যামল চক্রবর্তী, দে’জ পাবলিশিং (মূল লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল শ্রাবণ, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে ভারতী পত্রিকায়)

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়- সুধাংশু পাত্র, দে’জ পাবলিশিং

দেশ বিদেশের বিজ্ঞানী- অমরনাথ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স 

আত্মচরিত- আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়

উইকিপিডিয়া

বেঙ্গল কেমিক্যালের ওয়েবসাইট- http://bengalchemicals.co.in/

এছাড়াও লিটেরেসি প্যারাডাইস, হিন্দুস্থান টাইমস, এই সময়, হেলথ ওয়ার্ল্ড, news 18 সহ নানান ইংরেজি ও বাংলা পত্র-পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল থেকেও তথ্য সংগৃহীত করা হয়েছে। 






No comments