Header Ads

গ্রীষ্ম হোক বা বর্ষা পাল এন্ড কোম্পানি আজও ভরসা জোগায়


বঙ্গে বর্ষা নেমেছে। যখন তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে পড়ছে। এই বৃষ্টিতে অনেকে ভিজতে ভালোবাসেন। কিন্তু এই বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে সকলের। রাস্তায় যাতায়াত করবার সময় কোনোমতেই শরীর ভেজানো যাবেনা৷ কাজেই বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে ছাতা ব্যবহার করতে হবে আমাদের। বর্ষা আসা মানেই শুরু হবে ছাতার নানান গল্প। এই ছাতা নিয়েই যখন কথা উঠলো তখন খবরের শিরোনামটা ছাতা দিয়েই শুরু হোক। 


বোরোলীন, শালিমার তেলকে বঙ্গ জীবনের অঙ্গ বলা হয়। এর পাশাপাশি আরো একটি বস্তুকে বঙ্গ জীবনের অঙ্গ বলা হয়, তা হলো কে.সি পালের ছাতা। আজও সেই ছাতা রমরমিয়ে বিক্রি হয়। তারই একটি বিজ্ঞাপন যেন চিরনতুন। প্রতিটি কোম্পানি ব্র্যান্ডিং এর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রতি বছর মাসে মাসে আলাদা বিজ্ঞাপন বানায়। অথচ কে.সি পালের ছাতার গত পঁচিশ বছরে কেবল একটাই বিজ্ঞাপন। একই বিজ্ঞাপনেই দশকের পর দশক ধরে ব্যবসা ধরে রেখেছে কে.সি পাল। এই বিজ্ঞাপনটির মান ছিল যথেষ্ট উন্নত। এই বিজ্ঞাপনের শেষে বলা হয় গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা কে.সি পালই ভরসা। আর বাস্তবেও তাই। কে.সি পালের ছাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় পড়ন্ত বৃষ্টিতে হেঁটে চলার মজাই আলাদা। 

সস্তা দামে মজবুত বাঁট সহকারে কে.সি পালের ছাতার জুড়ি মেলা ভার। বর্ষাকালে তাদের বাজার থাকে জমজমাট। সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ছাতা শহরের রাস্তায় রাজনৈতিক মিছিলের জন্য কে.সি পালের দোকান থেকে ছাতা কিনে নিয়ে যাওয়া হয়। সস্তা মূল্যে তাদের ছাতা পাওয়া যায় বলেই সকলেরই কে.সি পালের ছাতাই বেশি পছন্দ। পরাধীন ভারত, ব্রিটিশরা চারিদিকে বোমা নিক্ষেপ করছে। শ্যামবাজার ও খিদিপুরেও বোম পড়েছে। বহু মানুষ বোমার ভয়ে কলকাতা ছেড়ে পালাচ্ছেন। এমতাবস্থায় তুলসীদাস পাল নিজের ব্যবসা গোটানোর কথা ভাবলেন। তিনিও ছাতা বিক্রিরই কাজ করতেন। তাঁর ছেলে কার্তিক চন্দ্র পাল বাবার ব্যবসাকে হাতছাড়া করতে দেননি৷ এই কে.সি পালের ছাতার প্রথম দোকান খোলা হয়েছিল ১৯৪২ সালে বড়বাজারের পুরুষোত্তম রায় স্ট্রিটে।

একের পর এক দোকান তখনকার হ্যারিসন রোড, আজকের এম.জি রোড ও পুরুষোত্তম স্ট্রিটে কে.সি পালের দোকান খোলা হয়। অল্পদিনের মধ্যেই ব্যবসার আকার বাড়তে থাকে। ব্যবসার বহর বেড়ে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ৫২ বছর বয়সে প্রয়াত হন তুলসীদাস পাল। আজকের তুলসী ভবনের পাশেই তিনি রেখে যান একটি দোতলা বাড়ি৷ কে.সি পাল বাবার নামে নতুন ভবনটির কাজ শুরু করেও সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তাঁর বড় ছেলে অনাথনাথ ও মেজ ছেলে বিশ্বনাথ এ কাজ সম্পূর্ণ করেন। এই বাড়িগুলো বর্তমানে চারতলার৷

কে.সি পালের উত্তরাধিকারীরা ছাতার কাপড়, রিবস, বাট আমদানি করেন তাইওয়ান থেকে। তার কারণ অবশ্যি একটাই৷  সাইকেলের মতো এদেশে একটা ছাতাও বানানো হয়না। ছাতা পুরোপুরি বানাতে গেলে এ দেশে চারটে কারখানা লাগবে। প্রথম কারখানাতে তৈরি হয় ছাতার কাপড়, দ্বিতীয় কারাখানাতে রিবস তৈরি হয়, তৃতীয় কারখানাতে বাঁট বানানো হয় এবং সব শেষে চতুর্থ কারখানাতে সমস্ত উপাদান সংগ্রহ করে পুরো ছাতাটি বানানো হয়। দেশের সকলেই কে.সি পালের নাম শুনেছেন। বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে ছাতার কালচার লুকিয়ে আছে। আর কে.সি পালের ছাতার বাংলাতে এক অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। কে.সি পালের ছাতা কোম্পানি ক্রমশ শতবর্ষের দিকে এগোচ্ছে। টিভির পর্দায় প্রায় পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা কে.সি পালের ছাতার একই বিজ্ঞাপন দেখে আসছি। এই বিজ্ঞাপনের সাথে বাঙালির অনেক স্মৃতি লুকিয়ে আছে৷ 

আজকে কে.সি পালের ব্যবসা বিভক্ত হলেও বদলায়নি মাথার ছাদটা। সেই একই ২৫৪ বাই বি চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের চারতলা 'তুলসী ভবন'। বাড়িটির চেহারা অনেকটা সাবেকি ঠাকুরবাড়িগুলির মতোই। কার্তিকচন্দ্রের সাধের ব্যবসার ঘোড়া আজও দৌড়ে চলেছে। এটাই বা কম কী? হাজার হাজার কোম্পানি ব্যবসার জন্য যেখানে কোটি কোটি টাকা খরচ অ্যাড বানাচ্ছে সেখানে একটা বিজ্ঞাপনেই দশকের পর দশক তাদের ছাতা সকলের মাথায় চেপে রাজত্ব করেছে। প্রাচীন পাল বংশের মতো একালের পাল এন্ড কোম্পানিও নিজেদের সাম্রাজ্য বাংলা জুড়ে টিকিয়ে রেখেছে। বনস্পতি বৃক্ষের মতো কে.সি পালের ছাতা বাঙালিকে ৭৯ বছর ধরে ছায়া দান করছে৷ বাজারে এখন স্টাইল করা বিভিন্ন রকমের অনেক কোম্পানির ছাতা আসছে। তার বিক্রিও কিছুটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা দেখে প্রশ্ন জাগতে পারে আগামী প্রজন্ম কী কে.সি পালের ছাতার ছায়া পাবে? এই সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেই গোটা পূর্ব ভারতে ছাতা ব্যবসায় রাজত্ব করার কথা ভাবছে পাল এন্ড কোম্পানি।  

প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments