Header Ads

ভারতের মহিলা চিত্রশিল্পীদের পথিকৃৎ সুনয়নী দেবী


চিত্রশিল্পে শুধু বাঙালি পুরুষেরাই নয়, অনেক বাঙালি মহিলাও চিত্রশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সমাজে মহিলাদের স্ত্রী-জননী-গৃহিণীর মধ্যেই আবদ্ধ রাখা হয়। মহিলারা বন্দী থাকেন খাঁচার পাখি হয়ে। আমাদের দেশে অনেক মেয়েকে পড়াশোনা করার সুযোগ দেওয়া হয়না। বহু মেয়েকে আঠারো বছর পেরোতে না পেরোতেই সংসার গড়ার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়৷ প্রাচীন যুগে নারীদের জন্য পর্দাপ্রথার প্রচলন ছিল। কোনো নারী বাড়ির বাইরে বেরোতে পারতেন না। সমাজ তাদের কঠিন গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা অসহায়। 



নারীরা খাঁচার পাখির মতো বাড়িতে বন্দী থাকলেও তাদের বাঁচার লড়াই সমাজকে অনেক কিছু শেখায়। গৃহিণীর শিকলে বদ্ধ থেকেও অনেক নারীই স্বাধীন ভাবে নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে সফল হয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় বাংলাতে অনেক মহিলা শিল্পী পুরুষদের সঙ্গে শিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নিলেও তাঁদের পেশাদার হিসেবে গণ্য করা হয়নি। দক্ষতার মানদণ্ডে উচ্চ স্থান পেলেও আজও তাঁদের গায়ে অপেশাদার গৃহবধূর তকমা লাগানো আছে৷ 

১৮৭৯ সালের কলকাতায় প্রথম দেখা গিয়েছিল পঁচিশ জন মহিলা শিল্পীদের এক চিত্রপ্রদর্শনী। তারও প্রায় ৫০ বছর পর ক্যালকাটা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুল তার দরজা খুলেছিল ছাত্রীদের জন্য। হারান চন্দ্র মিত্রের তনয়া গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর চিত্রচর্চা নজর কেড়েছিল লর্ড মিন্টোর সহধর্মিণীর। তাঁরই তত্ত্বাবধানে গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর চিত্র স্থান পায় অস্ট্রেলিয়ার এক চিত্রপ্রদর্শনীতে৷ গগন ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন সুনয়নী দেবীও তাঁর দাদাদের মতোই চিত্রচর্চায় বেশ তুখড় ছিলেন। তিনিও এই প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর ছবিতে উঠে এসেছিল আটপৌরে নারী ও ঘরকন্নার চিত্র। পটচিত্রে অঙ্কিত নানান দেবদেবীর চিত্র। সুনয়নী দেবী আপন খেয়ালে ছবি আঁকতেন। তিনিই বাঙালি মহিলা চিত্রশিল্পীদের পথিকৃৎ।

সেকেলে মেয়েরা বাড়িতে গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় যেমন মেয়েরা বাড়ির কাজ করতো তেমনই কাজের ফাঁকে অবসর সময়ে তাদের চিঠি লেখা ও উপন্যাস পড়ার একটা চল ছিল। কেবল চিঠি লেখা বা উপন্যাস পড়াই নয়, সেকেলের অনেক মেয়ে ময়ূরের পালক দিয়ে কাগজে ছবিও আঁকতেন। তখনকার দিনে যারা আভিজাত্য সম্প্রদায়ের মেয়ে ছিলেন তারা একটু পশ্চিমী কায়দাকে অনুসরণ করতেন৷ তাদের কাছে ঘোড়ায় চড়া, ইংরেজিতে কথা বলা ও পিয়ানো বাজানোর মতোই ছবি আঁকাটাও ছিল তাদের অন্যতম নিদর্শন। সেযুগেই ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য ভঙ্গ করে হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর স্ত্রী মেয়েদের ছবি আঁকা শিখিয়েছিলেন৷ অতএব ছবি আঁকার চেষ্টা সুনয়নী দেবীর কাছে নতুন ছিলনা। তাও তিনি নিজের বশে হয়ে উঠেছিলেন একজন স্বশিক্ষিত চিত্রশিল্পী। কোনো প্রথাগত প্রশিক্ষণ ছাড়াই চিত্রশিল্পী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁর শিল্পী ভাই অবনীন্দ্রনাথ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ ও সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিরিশ বছর বয়সে তিনি ছবি আঁকা শুরু করেন৷ 

মহীয়সী চিত্রশিল্পী নারী সুনয়নী দেবীর জন্ম হয় ১৮৭৫ সালের ১৮ ই জুন জোঁড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। যে ঠাকুরবাড়ি ছিল বাংলার এক সভ্রান্ত ঠাকুরবাড়ি। যে বাড়িকে সেকেলে প্রতিভার আঁতুড়ঘর বলা হতো। সাহিত্য চর্চা, সংগীত চর্চা থেকে শুরু করে জলসা, নাটক ও চিত্রকলা নিয়ে ঠাকুরবাড়িতে চর্চা হতো। এমন পরিবেশে থাকলে যে-কোনো মানুষের চিন্তাধারা সহজেই পরিবর্তিত হয়ে যায়৷ সুনয়নী দেবী রূপে লক্ষী গুণে সরস্বতী হয়ে ঠাকুরবাড়ির কোল আলো করে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। সভ্রান্ত পরিবারে একটু প্রতিভা থাকলেই জীবন হয়ে ওঠে সোনায় সোহাগা। তবে এটাও ঠিক কেবল প্রতিভা থাকলেই হয়না, সেই প্রতিভাকে স্বতন্ত্র ভাবনাতে কাজে লাগাতে পারলে তাহলেই একজন শিল্পী হওয়া যায়। যেটা সুনয়নী দেবী করে দেখিয়েছিলেন। 

বাংলার মহীয়সী নারীদের তালিকায় যত জন নারীর নাম উল্লেখ আছে তাদের মধ্যে সুনয়নী দেবীও অন্যতম নারী৷ সমাজে হাজার বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও সুনয়নী দেবীর মতো নারীদের স্থান ছিল সবার উপরে। নারীশক্তিকে ভরসা জোগিয়েছেন এনারাই। সুনয়নী দেবী ঠাকুরবাড়িতে বারো বছর কাটিয়েছিলেন কারণ মাত্র বারো বছর বয়সে রাজা রামমোহন রায়ের নাতি রজনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে তিনি আবদ্ধ  হয়েছিলেন। তাঁর পিতৃগৃহের মতো পতিগৃহও ছিল সভ্রান্ত পরিবারের অন্তর্গত। বলা ভালো সুনয়নী দেবীর বিবাহের মাধ্যমে রাজা রামমোহন রায়ের পরিবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের সঙ্গে আত্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে ছিলেন সুনয়নী দেবীর পিতৃব্য। 

সুনয়নী দেবীর চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর ছবিতে কোনো রঙের আড়ম্বর ছিলনা, তাঁর ছবিগুলো ছিল লৌকিক সারল্যের স্পর্শ মাখানো আর সহজ সরল মনে মানুষের টানা টানা কালো দুটি চোখে আপন দৃষ্টি। তাঁর ছবির জগৎ ছিল রূপকথা, পাঁচালী, পুরাণ, মহাকাব্য, নকশী কাথা, বাউল ও আরব্য রজনীর গল্প। তাঁর উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত চিত্র হলো নবাব খাজা আহসানউল্লাহ কন্যা মেহের বানু খানমের চিত্র, হরপার্বতী, অনারীশ্বর ও রাধাকৃষ্ণের একাধিক ছবি৷ যদিও তাঁর তুলীর টানে রাধাকৃষ্ণ, শিব, লক্ষ্মীর সংখ্যাই বেশি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোনের ছবি থেকে কখনো তাঁকে কোনো সংশাপত্র দেননি, তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন তাঁর বোনের ছবির আঁকার যা দক্ষতা তাতে দেশ-বিদেশ একদিন সম্মান জানাবে তাঁকে। এই বিশ্বাস সফলও হয়েছিল৷ দেশ-বিদেশে তাঁর পট আঙ্গিকে আঁকা ছবি স্থান পেয়েছে বিভিন্ন মিউজিয়ামে৷ বাংলা ও ভারতের ফোক আর্ট তাঁর হাত ধরে অনন্য রূপলাভ করেছিল৷ 

সুনয়নী দেবীর জীবদ্দশায় তাঁর আঁকা ছবি নিয়ে ভারতে কোনো চিত্রপ্রদর্শনী না হলেও  ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট ইউরোপে তাঁর চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল বহুবার। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম সুনয়নী দেবীর অঙ্কিত মেহের বানু খানমের চিত্র দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন৷ পরবর্তীকালে এ চিত্র নিয়ে তিনি 'খেয়াপারের তরণী' নামে একটি কবিতার জন্ম দিয়েছিলেন। 'মোসলেম ভারত' পত্রিকায় তাঁর ছবি প্রকাশিত হতে থাকে নিয়মিত৷ ২০১৩ সালে জার্মানির বাওহাউস ডেসাউতে এক চিত্র প্রদর্শনীতে সুনয়নী দেবীর আঁকা ছবি রাখা হয়েছিল। সুনয়নী দেবীর মতো দক্ষ নারী চিত্রশিল্পী বর্তমানে সম্ভবত নেই বললেই চলে। 



তথ্যসূত্র - নন্দীমৃণাল ব্লগ, ডিডব্লু পত্রিকা, ই-বাংলা লাইব্রেরি

No comments