Header Ads

শতাব্দীর ঐতিহ্য বহন করে স্বমহিমায় আজও দণ্ডায়মান কলকাতার মার্বেল প্যালেস


কলকাতা শহরের বুকে বহুমূল্যের অনেক প্রাসাদ রয়েছে। উনিশ শতকে ও তার আগের সময় থেকে বিভিন্ন প্রাসাদ নির্মিত হচ্ছে। শহরে যতগুলো প্রাসাদ আছে তার মধ্যে সৌন্দর্যে যে-কোনো প্রাসাদকে হার মানাতে পারে কলকাতার মার্বেল প্যালেস। বিশাল এই প্রাসাদ এখন একটি দর্শনীয় স্থান। মহাত্মা গান্ধী রোড মেট্রো স্টেশন ও গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনের মাঝে রাম মন্দিরের ঠিক বিপরীতের রাস্তা ধরে এক মিনিটের হাঁটা পথ। তারপর ৪৬ মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট। উত্তর কলকাতার ৪৬ মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটেই অবস্থিত এই প্রাসাদ। ১৮৩৫ সালে এক ফরাসি স্থপতি নির্মাণ করেন মার্বেল প্যালেস। দীর্ঘ পাঁচ বছরের কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা সম্ভব হয় এই প্রাসাদ। তিনতলা বিশিষ্ট এ প্রাসাদ এক চোখধাঁধানো আকর্ষণীয় স্থান। 


কলকাতার সেরা গ্ল্যামারস্ ঐতিহাসিক স্থান হলো মার্বেল প্যালেস। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতায় ধনী জমিদার ও অভিজাত বাঙালিরা গড়ে তোলেন অসংখ্য সুরম্য ভবন, প্রাসাদ ও বাগান বাড়ি। এমনই একটি সুরম্য প্রাসাদ হলো মার্বেল প্যালেস। বিখ্যাত বাঙালি ব্যবসায়ী-জমিদার নীলমণি মল্লিকের দত্তক পুত্র ছিলেন রাজেন্দ্র মল্লিক। নীলমণি মল্লিক উত্তর কলকাতার মুক্তারাম স্ট্রিটে তাঁর বসতবাড়িতে জগন্নাথ মন্দির তৈরি করান। মার্বেল প্যালেসের অন্দরে জগন্নাথ মন্দিরটি এখনও আছে। রাজেন্দ্র মল্লিক মার্বেল প্যালেসের মালিক ছিলেন। তাঁর মনের ইচ্ছাতেই এই প্যালেস তৈরি হয়। রাজেন্দ্র মল্লিকও ছিলেন একজন বৃহৎ  জমিদার। বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পত্তি থাকার জন্য রাণী ভিক্টোরিয়া তাঁকে রাজা বাহাদুর উপাধি দেন। 

নীলমণি মল্লিক শিশু বয়সেই রাজেন্দ্র মল্লিককে দত্তক নেন। রাজেন্দ্র মল্লিকের যখন তিন বছর বয়স তখন বিপুল সম্পত্তি রেখে দিয়ে মারা যান নীলমণি মল্লিক। মাত্র ষোলো বছর বয়সে ১৮৩৫ সালে তিনি মার্বেল প্যালেস নির্মাণ শুরু করান। নিউক্ল্যাসিকাল স্থাপত্যরীতিতে গড়ে তোলা হয় এই প্যালেস। ১৮৪০ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয় এই প্যালেসের। মার্বেল প্যালেসের সামনে রয়েছে কোরিন্থিয়ান রীতিতে বানানো স্তম্ভ ও কারুকার্য বিশিষ্ট বড়ো বারান্দা। চিনা প্যাভিলিয়নের ধরনে নির্মিত হয়েছে ঢালু ছাদ৷ 

মার্বেল প্যালেসের স্থাপত্যশৈলীর শিল্পকর্মে প্রচুর পরিমাণ ইতালীয় মার্বেল ব্যবহৃত হয়েছে। প্যালেসের সামনে ঘন সবুজ বাগান ও ফোয়ারা, মাতা মেরি, যীশু, সনাতনী দেবতা, ক্রিস্টোফার কলম্বাস, গৌতম বুদ্ধ এবং কিছু সিংহের মূর্তি দ্বারা এটি ভূষিত। ভবনের ভেতরে রয়েছে বাঙালি রীতিতে গড়া ঠাকুরদালান। যে মন্ডপে পুজো হতো। মাঝে মধ্যে যাত্রাপালা ও কীর্তনের আসরও বসতো। অন্দরমহলে পোট্রের্টে আঁকা রাজেন্দ্র মল্লিকের ছবি নজর কাড়ে দর্শনার্থীদের। অন্দরমহলটি দৃষ্টিনন্দিত, সৌন্দর্যময় ও ভাস্কর্যের সমাহারে পরিপূর্ণ। গ্রীক ও রোমান পুরাণের দেবদেবী জিউস, মিনার্ভা, অ্যাপেলো, হেরা, মার্কারি, ভেনাস, কিউপিড যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে শ্বেত পাথরের দেহে। শিল্পীদের ক্যানভাসে আঁকা চিত্রকর্মে ভরা পেইন্টিংও দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করতে পারে। 

রাজেন্দ্র মল্লিক তাঁর স্ত্রীর অনুরোধে মার্বেল প্যালেসের পাশে একটি চিড়িয়াখানা গড়ে তোলেন। এই চিড়িয়াখানা বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্র৷ যেখানে দেখা মেলে চিতাবাঘ, বানর, বনবিড়াল, গন্ধগোকুল, সজারু, কয়েক প্রজাতির হরিণ, নানান প্রজাতির বক, ময়ূর, পেলিক্যান, হাড়গিলা পাখি, মদনা তোতা, ঘুঘু, মালাবার ধনেশ, সোনালী পক্ষী, সারস ও বিভিন্ন প্রজাতির বুনো হাঁসেদের। ১৮৭৮ সালে আলিপুর চিড়িয়াখানা গড়ে উঠলে রাজেন্দ্র মল্লিক ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে পশু ও পাখি দান করেন৷ আলিপুর চিড়িয়াখানার ভেতরে মল্লিক হাউস বলে একটি জায়গা রাখা হয়েছিল৷ 

বাংলা ছবি 'সাহেব বিবি গোলাম' এবং 'স্বয়ংসিদ্ধা'র শ্যুটিং হয়েছিল এই প্যালেসে। এছাড়াও আরো নাম না জানা বহু ছবির শ্যুটিং হয়েছে এখানে। এই প্যালেসের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন রাজেন্দ্র মল্লিকের উত্তরাধিকারীরা। প্যালেসের ভেতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। কেবল প্যালেসের বাইরে ছবি তোলা যায়। এই প্যালেসের বর্তমান বয়স ১৮০ বছর। আজও এতটুকু মরচে ধরেনি প্রাসাদের শরীরে। শতাব্দীর ঐতিহ্য বহন করে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে মার্বেল প্যালেস।


তথ্যসূত্র- অলিগলি ডট কম, ট্রিপসে ব্লগ, ম্যাপসো ইন্ডিয়া  

No comments