বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড ইতিবৃত্ত || চতুর্থ পর্ব
এই বেঙ্গল কেমিক্যালে যোগ দিয়েছিলেন রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০), যাঁকে আমরা বাংলা সাহিত্যে ‛পরশুরাম’ বলে চিনি। এখানে এই রাজশেখর বসুর সম্বন্ধে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক। রাজশেখর বসুকে যদিও আচার্য রায় “প্রেসিডেন্সি কলেজের আমাদের প্রাক্তন ছাত্র” হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছেন তবুও রাজশেখর বসুর নাতনীর পুত্র শ্রী দীপঙ্কর বসু 'পরশুরাম গল্পসমগ্র' গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “অনেকের ধারণা আছে যে, তিনি(রাজশেখর বসু) আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ছাত্র, এ ধারণা ভুল। অবশ্য পরবর্তী জীবনে প্রফুল্লচন্দ্রের সাহচর্যে রাজশেখর উপকৃত হয়েছিলেন, তবে সেটা কর্মজীবনে, ছাত্রজীবনে নয়।” প্রসঙ্গত, এই রাজশেখর বসু ছিলেন রসায়নবিদ্যার একজন কৃতি ছাত্র। ১৯০০ সালে তিনি রসায়নশাস্ত্রে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ. উপাধি লাভ করেছিলেন। সেই সময় বিজ্ঞানে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর হলে যথাক্রমে বি.এ. ও এম.এ. ডিগ্রি দেওয়া হত। যাইহোক, ১৯০২ সালে যদিও বি.এল. পরীক্ষায় পাশ করে রাজশেখর বসু আইন বিশেষজ্ঞ হয়েছিলেন তবুও মাত্র তিন দিন আদালতে গিয়েছিলেন। এই সৎ, সংযত এবং অন্তর্মুখী মানুষটি সারাজীবন সাহিত্যচর্চা ও বিজ্ঞানচর্চাই করে গেছেন। বিজ্ঞান গবেষণাগার ও লেখার টেবিলকেই সাধনার স্থান বলে মনে করেছিলেন আজীবন। এই মানুষটি ১৯০৩ সালে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সাথে সাক্ষাৎ করে বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কস-এ রাসায়নিকের কাজে নিযুক্ত হন। তখন বেঙ্গল কেমিক্যালের অফিস ছিল সারকুলার রোডে।
আচার্য রায় লিখছেন যে, রাজশেখর বসু যখন বেঙ্গল কেমিক্যালে যোগদান করেন অর্থাৎ ১৯০৩ সালে তখন সেই কোম্পানি বেঙ্গল কেমিক্যাল যৌথ-কারবারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তিনি এই ‛যৌথ-কারবার’ বলেছেন কেননা ১৯০১ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল একটি 'লিমিটেড' কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তাই। বেঙ্গল কেমিক্যাল ধীরে ধীরে যে উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি লাভ করেছিল তার পেছনে রাজশেখর বসুর অবদান কম নয়। তিনি তাঁর কৃতিত্ব ও কর্মকুশলতার ব্যাপক পরিচয় দিয়েছিলেন কোম্পানির এই উন্নয়নের কাজে। আচার্যদেব রাজশেখর বসুর পাশাপাশি আরেক বিখ্যাত রাসায়নিকের নাম নিয়েছেন যিনি হলেন সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত (১৮৮০-১৯৭৯)। প্রসঙ্গত, জানিয়ে রাখি যে এই সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত একজন বিখ্যাত আবিস্কারক যিনি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ‛ফায়ার কিং’, ‛সুলেখা ইঙ্ক’ সহ নানা জিনিস আবিষ্কার করেছিলেন। রসায়ন ছাড়াও স্বদেশী আন্দোলনে, কৃষিক্ষেত্রে, খাদি শিল্পে এবং সাহিত্যক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন এই প্রায় শতায়ু লাভ করা বিজ্ঞানী। তিনি ১৯০৫ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানায় সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আচার্যদেব জানান, এই সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তও রাসায়নিক হিসেবে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছিলেন।
বেঙ্গল কেমিক্যাল তার পরীক্ষাকাল পার হয়ে যখন রাসায়নিক কারবারের দুনিয়ায় দাঁড়াবার জায়গা পেল তখন আচার্যদেবরা এই কারখানাকে তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং সঙ্কীর্ণতা থেকে বাঁচানোর জন্য লিমিটেড কোম্পানি করে দিয়েছিলেন। কোম্পানিটি যখন শুরু হয় তখন এই দেশের ডাক্তাররা দেশি ওষুধে তেমন আশা-ভরসা করতেন না। তাই, ওই সময় কোম্পানি যদি কেবল দেশীয় ওষুধ তৈরি করত তাহলে হয়তো ভালো চলত কিনা সন্দেহ। আর এই সন্দেহের জেরে বা লাভ না করার আশঙ্কায় বেঙ্গল কেমিক্যাল দেশীয় ওষুধের সাথে নানা রকম বিলিতি ধরণের পেটেন্ট ওষুধ তৈরি করতে শুরু করেছিল।
Post a Comment