অভাবের কাছে যখন হেরে যায় শিক্ষা এমনই এক কঠিন বিষয় নিয়ে ছবি মৌলবী মাস্টার
১৯৪৭ এর আগে অবিভক্ত
ভারতের ফরিদপুরের হোগলাকান্দি গ্রাম যা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত সেখানকার একটি
কাহিনী নিয়েই এই গল্প। তৎকালীন সময়ে ভারতবর্ষের গ্রাম গুলোতে বিদ্যালয় ছিলনা বললেই
চলে। সেই প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার করার জন্য বহু মানুষ পাঠশালা খোলার চেষ্টা
করতেন অসম্ভব লড়াই এর মাধ্যমে। এরকমই একজন মানুষ হলেন মৌলবী মাস্টার। তাঁর লড়াই
নিয়েই এই গল্প। এ গল্পটি রচনা করেন মৌলবী মাস্টারেরই এক ছাত্র শ্রী অনিল কুমার
পোদ্দার। মৌলবী মাস্টার গল্পটি দেখো কি কান্ড নামক বই থেকে নেওয়া। দেখো কি কান্ড
ওয়েব সিরিজের প্রথম গল্প হল মৌলবী মাস্টার।
এই গল্পে যে দিক গুলি
উঠে এসেছে তা হল একজন মৌলবী যিনি তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে মসজিদের কাজের থেকেও যিনি
বেশি করে চিন্তা করছেন গ্রামের ছেলেরা যাতে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে।
দূরে নদী পেরিয়ে ছেলেদের যেতে হয় এসব নিয়ে তাঁর মধ্যে একটা চিন্তার আবেশ যা খুব
গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখন বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও যেভাবে দেখতে পাচ্ছি
সাম্প্রদায়িকতার ছায়া তার প্রতিও একটি বার্তা পৌছায় এই সিনেমাটি।
এই সিনেমায় দেখা যায়
মৌলবী মাস্টার জমিদারের কাছে গিয়ে একটি পাঠশালা খোলার আর্জি জানাচ্ছেন। এবং
জমিদারও অত্যন্ত আনন্দের সাথে সেই পাঠশালা খোলার ব্যবস্থা করে দিয়ে তাঁর লড়াইতে
সাহায্য করছেন। তারপরই এই পাঠশালায় দেখা যাচ্ছে মৌলবী মাস্টার ধারাপাত শেখাচ্ছেন
বা কখনও ছাত্রদের কড়া, গন্ডা এসব গণনা শেখাচ্ছেন।হিন্দু মুসলমান এরকম কোনো
সাম্প্রদায়িকতার কোনো চিহ্নই নেই, সকল ছাত্ররা একসাথে পড়ছেন। পাঠশালায় ছেলেদের
পড়ানো তার সাথে সমান তালে মৌলবী মাস্টার লক্ষ্য রাখছেন কিভাবে ছেলেদের
পাঠশালামুখী করা যায়। ছাত্ররা না এলে কয়েকজন ছেলে দিয়ে তাকে ধরে এনেও ব্যবস্থা
করছেন পড়ানোর এটাকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক চ্যাংদোলা পদ্ধতি বলে থাকেন। এই চ্যাংদোলা
পদ্ধতি খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন দুই পরিচালক। এত চেষ্টার পরও দেখা যাচ্ছে
ছাত্রসংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে তবু হাল ছাড়েননি মৌলবী মাস্টার। জমিদারও ওনাকে
সাহায্য করছেন। ছাত্রসংখ্যা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি ঠেকাতেও জমিদার দশ টাকা মাইনা
দিয়েই গেলেন যাতে তিনি লড়াই করতে পারেন এভাবেই জমিদারও এই লড়াই এর শরিক হয়ে
থাকলেন।শেষ দিকে মৌলবী মাস্টার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এটাই হল গল্পের বুনন।
এবার আসি গল্পের
পরিচালনার কথায়। গল্পটি পরিচালনা করেছেন নাইল
ভট্টাচার্য এবং দেব গোস্বামী কাম টু দ্য পয়েন্ট ইনফোটেইনমেন্টের প্রযোজনায়।এই
গল্পটি শুটিং হয়েছে নদীয়ার শান্তিপুরে কিন্তু সিনেমা দেখে তা বোঝার উপায় নেই।
দেখলে মনে হবে বাংলাদেশেই শুটিং হয়েছে। ড্রোন শট ব্যবহার করা হয়েছে অত্যন্ত নিপুণ ভাবে। সাজসজ্জা, পালকির দৃশ্য, শিশু অভিনেতা নির্বাচন অত্যন্ত নিঁখুত। এই সিনেমাতে
ব্যবহৃত মেঘের কোলে রোদ উঠেছে গানটিও সিনেমাটিকে অন্য একটা মাত্রা দিয়েছে। এছাড়াও
রেডিও ও শঙ্খধ্বনি ও সন্ধ্যা-প্রদীপ দেখানোর সহযোগে একটা সুন্দর সন্ধ্যার দৃশ্যও
অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাছাড়া এস্টাব্লিশিং শট গুলিও বেশ দক্ষতার সাথে
ব্যবহৃত হয়েছে। পুরো সিনেমাটিতেই যেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটা বার্তা দেওয়া
হয়েছে। সিনেমাটি দেখলে একটা রিয়েলিস্টিক ব্যাপার আছে যা পরিচালকরা সুন্দর ভাবে
করেছেন।
সিনেমাটির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন পরিচালক নাইল ভট্টাচার্য। চিত্রনাট্যের দক্ষতার এতটাই পরিচয় রেখেছেন নাইল ভট্টাচার্য যে সিনেমাটি দেখলে আপনি তৎকালীনকার সেই সময়টাতেই প্রবেশ করেছেন মনে হবে।
এবার অভিনয়ের কথায় আসা
যাক। সিনেমার মৌলবী মাস্টারের (মইনুদ্দিন)চরিত্রে অভিনয় করেছেন অরুণ গুহ ঠাকুরতা। ছোটো কর্তা বা জমিদারের চরিত্রে অভিনয়
করেছেন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিবিজানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন জোৎস্না মজুমদার। এছাড়াও বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন কোয়েনা মাইতি, শ্রমনা রায় চৌধুরী, শেখর বিশ্বাস প্রমুখ। প্রত্যেকেরই অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। পুরো সিনেমা দেখে কে সেরা অভিনয় করলো তা
নির্বাচন করতে হলে মাথা খারাপের উজাড় হবে।সিনেমায় ব্যবহৃত শিশুদের অভিনয়, মুখের
বচনভঙ্গি একদম ন্যাচারেল। শিশুদের দৃশ্যগুলি আমাদের শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
অভিনয় আপনাকে যে মুগ্ধ করবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সিনেমার ভয়েস ওভারও
খুব ন্যাচারেল ভাবে করেছেন সহ-পরিচালক দেব গোস্বামী। ডাবিং এর কাজ করেছেন গীত
গোসাইন, সুমন দত্ত ও নাইল ভট্টাচার্য।
এই সিনেমার কস্টিউম ও
মেক-আপ এর কাজটিও ছিল জমকালো। কস্টিউম এর কাজ করেছেন পরিচালক নাইল ভট্টাচার্য।
ইডিটিং এবং সাউন্ড ডিজাইনিং এর কাজ করেছেন সহ-পরিচালক দেব গোস্বামী। সাউন্ড
ডিজাইনিং এর ক্ষেত্রে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কিউ নির্বাচন ও কিউ ব্যবহার করার জায়গা
চিত্রনাট্যের সাথে বেশ মানানসই। এই সিনেমার সাউন্ড ডিজাইনিংটিও বেশ চমৎকৃত করে।
এতে ফটোগ্রাফি করেছেন
দিব্যেন্দু সরকার। অ্যাডিশনাল ফটোগ্রাফির কাজ করেছেন তনয় রায়। অ্যাসিট্যান্স
ক্যামেরার কাজ করেছেন মৃদুল বিশ্বাস, বাপি মাইতি, অমিত দাস, গোপাল গায়েন ও শান্তনু
মন্ডল। ড্রোন ক্যামেরার কাজ করেছেন সৌরভ নীল ও সুনিত দাস। শিল্প নির্দেশনায় ছিলেন বিবস্বান গুপ্ত ও সহযোগিতায় ছিলেন বিপ্লব স্বরাজ, রাম বেরা প্রমূখ।
লাইটিং অ্যাঙ্গেল গুলিও
ফিল্ম ডাইরেক্সেন সায়েন্সের নিয়ম গুলি মেনেই হয়েছে। লাইটের কাজ করেছেন পঞ্চানন
সাহা, তারক সাহা ও বাবাই মান্না।
এই সিনেমাটি পেক্ষাগৃহে
চলার পর কাম টু দ্য পয়েন্ট এন্টারটেইনমেন্টের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলেও এসে গেছে।
সিনেমাটির একটা লিঙ্কও নীচে দেওয়া হল ওখানে গিয়ে এই সুন্দর সিনেমাটি উপভোগ করতে
পারেন।
Post a Comment