Header Ads

এক মহান চিত্রকরের জীবন দর্শন


রবীন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তি  "তোমার তুলিকা রঞ্জিত করে/ ভারত-ভারতী-চিত্ত/ বঙ্গলক্ষ্মী ভাণ্ডারে সে যে/ জোগায় নূতন বিত্ত।" বাংলা সমসাময়িক শিল্পকলার জলরঙে আঁকা ভারতীয় ঐতিহ্যাশ্রিত বিষয় একটি মূল ধারায় পরিণত হয়েছিল। মূলত অবনীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত ধারার সঙ্গে দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদের মতো আবেগও যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে এই ধারার পাশাপাশি স্বাভাবিকতা আশ্রয়ী, বহুদূর পর্যন্ত ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি তেলরঙের বাস্তবধর্মী ছবির যথেষ্ট সমাদরও ছিল সেইসময়। অবনীন্দ্রনাথের চিত্রচর্চায় ভারতের ধ্রুপদী ও পৌরাণিক অতীত সম্পর্কে যে দ্বিধাহীন ঝোঁক ছিল, তা থেকে সরে এসে তাঁর ছাত্র নন্দলাল বসু নিজের চারপাশের বহমান জীবনকে ছবির বিষয় করে তোলেন। গ্রামীণ প্রকৃতি, সাধারণ এবং দরিদ্র মানুষের জীবন হয়ে উঠলো তাঁর ছবির উপজীব্য বিষয়। 


প্রাথমিক স্তরের পাঠ্য পুস্তকে সহজপাঠের যে চিত্রগুলো লক্ষ্য করা যায় তা সবই নন্দলাল বসুর হাতে বানানো। রবীন্দ্রনাথের লেখনের সঙ্গে চিত্রাঙ্কণের যথার্থ যুগলবন্দীতে নির্মিত 'সহজ পাঠ।' সহজ পাঠের গোড়াতেই বলা আছে- 'নন্দলাল বসু কর্তৃক চিত্রভূষিত, এই বই বর্ণপরিচয়ের পর পঠনীয়।' তাঁর অলঙ্করণে প্রতিটি ছবি যেন জীবন্ত। সহজপাঠের পাশাপাশি ভারতীয় সংবিধান পুস্তকের ছবিও তিনি অঙ্কন করেছেন। ভারতীয় ভাস্কর্যের ইতিহাসে বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুযোগ্য  ছাত্র হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। চিত্রশিল্পে তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার  অধিকারী। চিত্রকলা নিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন 'শিল্পকথা' ও 'শিল্পচর্চা' নামের দুটো গ্রন্থ। যে গ্রন্থগুলো হলো বাংলা চিত্রকলার অপূর্ব নিদর্শন। 

১৮৮৩ খ্রীস্টাব্দের ৩রা ফেব্রুয়ারী তিনি মুঙ্গেরে জন্মগ্রহণ করেন৷ শৈশব থেকে তিনি দেবদেবীর মূর্তি, পুতুল ও নানান কারুকার্য মাটি দিয়ে নির্মাণ করতেন। নিজস্ব ভাবনার আকাশে রঙের আবরণে নিজেকে আবৃত করে স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে তুলির টানে এঁকে ফেলতেন আশ্চর্য সব চিত্র। পড়াশোনার প্রতি তাঁর একেবারেই আগ্রহ ছিলনা। ফলে তিনি এফ.এ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। কিন্তু চিত্রকলার প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আকর্ষণ। সত্যেন বটব্যাল বলে এনগ্রেভিং ক্লাসের এক ছাত্র তাঁকে নিয়ে গেলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। সত্যেন বটব্যাল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে বলে "একে আপনার নিতে হবে।" তৎক্ষণাৎ অবনীন্দ্রনাথ বাবু বললেন "দেখি তোমার হাতের কাজ।" তখন নন্দলাল বসু নিজের হাতে আঁকা শকুন্তলার ছবিটি দেখালেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একেবারেই পছন্দ হলোনা ছবিটি। তিনি অবন ঠাকুরের হাতে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। তিনি আপন মনে আবারো ভাবতে লাগলেন নতুন আর কী বিষয়ে ছবি বানানো যেতে পারে। 'প্রবাসী'র মতো জনপ্রিয় পত্রিকাতে রবি বর্মা, অন্নদা বাগচিদের ছবির সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের ছাপা 'বুদ্ধ ও সুজাতা', 'নল-দময়ন্তী', 'শাহজাহান', 'বজ্রমুকুটে'র মতো ছবি প্রকাশিত হয়েছে। যে কারণে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা নিলে তিনি চিত্র সম্পর্কিত নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন। 

নন্দলাল বসু হাল ছেড়ে দিলেন না। তাঁর মনে তখন একটাই চিন্তা কীভাবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্র হওয়া যায়? কাজেই একদিন একটি সিদ্ধিদাতা গনেশের ছবি এঁকে নিয়ে তিনি গেলেন অবনবাবুর কাছে। খুঁতখুঁতে স্বভাবের চিত্রশিল্পী ঠাকুর পরিবারের সুযোগ্য সন্তান অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অপলক দৃষ্টিতে উপলব্ধি করলেন সেই গনেশের ছবিটি। এরপরই তিনি গ্রহণ করলেন তাঁকে। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একজন নিষ্ঠাবান ও সুযোগ্য ছাত্র হয়ে উঠলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহায়তায় তিনি ভর্তি হলেন কলিকাতা আর্ট কলেজে। এই কলেজের পড়ুয়া থাকাকালীন তিনি কর্ণের সূর্যস্তব, গরুড়স্তম্ভতলে শ্রীচৈতন্য, কৈকেয়ী, শিবমতি, নৌবিহারের মতো দূর্দান্ত সব ছবি এঁকে নিজের প্রতিভার পরিচয় দেন৷ 

তিনি কলেজ জীবন শেষ করে উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ করে উত্তর ভারতীয় ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হন। এরপর তিনি পুরী থেকে কন্যাকুমারী পাড়ি দিলেন৷ গোটা দক্ষিণ ভারত দর্শন করলেন। ১৯১৬ খ্রীস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিচিত্রা সংঘে তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর শিক্ষকতার পাঁচ বছর পর তিনি ১৯২১ খ্রীস্টাব্দে বাঘ গুহার নষ্ট হয়ে যাওয়া চিত্রগুলি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ভগিনী নিবেদিতা রচিত হিন্দু-বৌদ্ধ পুরাকাহিনী বইটির অঙ্গসজ্জা করেন৷ এমনকি জোঁড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির চিত্রকলার তালিকা তৈরিতেও সাহায্য করেন। এরপর ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত পর পর তিন বছর তিনি কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মলনে শিল্প প্রদর্শনী ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দে অনুষ্ঠিত হরিপুরা সম্মেলনে তিনি ধারাবাহিক ভাবে তিরাশিটি পট প্রদর্শন করেন। ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দে তিনি বরোদার মহারাজের কীর্তিমন্দির অলঙ্কৃত করার দায়িত্ব পান। এই কীর্তিমন্দিরের চতুর্দিক এবং শ্রীনিকেতন ও শান্তিনিকেতনের দেওয়াল চিত্র তাঁকে নিয়ে আসে আলোর নীচে। 

চিত্রশিল্পে সারা বাংলা তথা ভারতের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দে বিশ্বভারতী তাঁকে দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৫৪ খ্রীস্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৫৬ খ্রীস্টাব্দে ললিত কলা অ্যাকাডেমির দ্বিতীয় ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ খ্রীস্টাব্দের ১৬ ই এপ্রিল তিনি শান্তিনিকেতনে দেহত্যাগ করেন।


No comments