গ্রীনল্যান্ড, সাহারা, আল্পস খ্যাত একালের শঙ্কর অনিন্দ্য মুখার্জীর সাক্ষাৎকার
বর্তমানে বাঙালি এক্সপ্লোরার বললেই যার নাম সবার আগে উঠে আসে তিনি হলেন আমাদের সকলের প্রিয় এক্সপ্লোরার অনিন্দ্য মুখার্জী। তিনি হলেন প্রথম ভারতীয় যিনি সাইকেলে সাহারা মরুভূমি এক্সপ্লোর করেছেন। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড় যাত্রাপথেও তিনি এক্সপ্লোর করেছেন৷ তিনি চীনের ইউনান প্রদেশে একটি নতুন পর্বতমালা আবিষ্কার করেন। তিনি নন্দাদেবী স্যাংচুয়ারির এক নতুন গিরিপথও তিনি আবিষ্কার করেন। এছাড়াও তিনি গ্রিনল্যান্ড, এলব্রুজ, আল্পস পর্বতে পাড়ি দিয়েছেন৷ এই এক্সপ্লোরারের ভ্রমণের কাহিনী জানতে হলে পড়ে ফেলুন এই সাক্ষাৎকার।
লিটারেসি প্যারাডাইস- প্রথম ভারতীয় হিসেবে আপনি সাইকেলে সাহারা অভিযান
করেছেন। এই অভিযান ঠিক কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল আপনার কাছে?
অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়- আসলে 'প্রথম ভারতীয়' হিসেবে 'সাহারা অভিযানে' যাব, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম ছিল না। আফ্রিকার প্রতি আমার একটা অমোঘ
আকর্ষণ গত ১৫ বছর ধরে, সেই কিলিমাঞ্জারো যাবার পর থেকেই তৈরি হয়েছিল। সেই আকর্ষণ
থেকেই সাহারা পার করে সাইকেল চালানোর ধারণাটা জন্ম নিয়েছিল। চলার পথে, ওয়েস্টার্ন
সাহারায়, ইউনাইটেড নেসন্স এর একটা ক্যাম্পে থাকার সময় জানতে পারি সেপথে আমিই প্রথম
ভারতীয়। এই পর্যন্তই। যেকোনো অ্যাডভেঞ্চারেই একটা এলিমেন্ট অফ চ্যালেঞ্জ থাকে।
সেটা না থাকলে আর তাকে অ্যাডভেঞ্চার বলি কী করে। সাহারা যাবার আগে, পড়াশুনো করে
আমার মনে হয়েছিল, এই রাস্তায় চ্যালেঞ্জ হবে দিনের পর দিন, জনমানবহীন, দীর্ঘ পথ পার
হওয়া। সেই সময় যেহেতু আমি নিজেকে একাকীত্বের চ্যালেঞ্জেই ফেলতে চাইছিলাম, তাই সেটা
‘চ্যালেঞ্জিং’ মনে হয়নি, মনে হয়েছিল সেই একাকীত্ব আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তবে
সাইক্লিং শুরু করার কয়েকদিনের মধ্যেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম, সাহারার আসল
চ্যালেঞ্জ হল, সাহারার হাওয়া-হারমাটান।
লিটারেসি প্যারাডাইস- আপনি তো একালের শংকর।
চাঁদের পাহাড় উপন্যাসের নায়ক শংকরের সাথে আপনি নিজের কতটা মিল খুঁজে পান?
অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়- বিভূতিবাবু বাঙালি কিশোর
মননকে একজন দুঃসাহসী চরিত্র উপহার দিয়েছিলেন শংকরের রূপে। সেই থেকে, এক টুকরো করে
শংকর, সব নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি ছেলে-মেয়ের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু, সেটা রয়েছে
মনের মধ্যেই, রয়েছে স্বপ্নবিলাসীতায়। সবারই মনে হয়, যদি এমন হত, তাহলে বেশ হত। কিন্তু,
কাজে সেটা করে দেখানোর খুব বেশী উদ্যোগ আমার চারপাশে অন্তত দেখতে পাই না। থাকলে
হয়ত আজকে আমাদের সমাজের চেহারাটা একটু হলেও অন্যরকম হত। কারণ, আমি মনে করি একজন
প্রকৃত অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়,দুঃসাহসী মানুষ অবধারিত ভাবেই একজন ভাল নাগরিক। সুস্থ
সমাজ গঠনে এরকম মানুষের প্রয়োজন অসীম। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। তোমার প্রশ্নে ফিরে
আসি। দেখো, আমি নিজেকে শংকর মনে করিনা। আমাদের আর্থ-সামাজিক অপ্রাপ্তি গুলোকে
তুচ্ছ করে, একরকম অস্বীকার করে, একটা আপাত দুঃসাহসিক, কিন্তু, অর্থপূর্ণ কিছু করার
মধ্যেই আমি নিজের কাজের স্বার্থকতা খুঁজে পাই। এর মধ্যে কোনও এসকেপিজম নেই, বরং
রয়েছে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া প্রথাগত সমাজ তন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।তাই
গল্পের শংকরের সঙ্গে আমার মিল অন্য কেউ খুঁজে পেলেও, আমি পাই না।ভারতবর্ষের মত দেশে,
কেউ যখন অ্যাডভেঞ্চারকে অবলম্বন করে বাঁচতে চায়, তখন তার কাছে এসব রোমান্টিসিজম
পোষায় না। কারণ, গল্পের মত, প্রকৃত অ্যাডভেঞ্চারের শেষে, নায়কের জন্য কোন গুপ্তধন
অপেক্ষা করে থাকে না।
লিটারেসি প্যারাডাইস-অভিযান আপনার কীভাবে আপাদমস্তক ধারণ করে?
অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়- গত ২০ বছর ধরে,আমি হিমালয়ে বিভিন্ন দল কিংবা
ব্যক্তিকে পর্বতারোহন এবং ট্রেকিং করতে সাহায্য করে আসছি। আমাকে একজন ট্রেকিং এবং
এক্সপিডিসন গাইড বলা যেতে পারে। এটাই আমার মূল জীবিকা। আর একটু আধটু লেখালিখিও
করি।
লিটারেসি প্যারাডাইস- আজাদ হিন্দ বাহিনী যে পথে ভারত আক্রমণ করেছিলেন
সেই পথে আপনি অভিযান করে নতুন কী কী তথ্য পেলেন?
অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়- ২০১৯ সালে, আমি সিঙ্গাপুর থেকে মণিপুর, আজাদ হিন্দ
ফৌজের যাত্রাপথ অনুসরণ করেছিলাম। প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, এই পথে নেতাজী এবং আজাদ
হিন্দ ফৌজের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলি খুঁজে বার করা এবং সেগুলি এখন কেমন আছে দেখা।
কিন্তু, ঘটনাচক্রে, এই পথে একের পর এক, এমন বহু মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়,
যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে আজাদ হিন্দ সেনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এমনও অনেক
মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, যারা আজাদ হিন্দের হয়ে ব্রিটিশ ফৌজের সঙ্গে সম্মুখ সমরে
লড়েছিলেন। যুদ্ধের শেষে মানুষ সাধারনত সেনাপতি কিংবা অফিসারের নামটুকুই জানতে
পারেন। ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনের এই শেষ সশস্ত্র সংগ্রামে, এই মানুষগুলি ছিলেন
সৈনিক মাত্র। ফলে, এঁদের নাম-ধাম নিয়ে কেউ কোনদিন লিখে জাননি। এঁদের খুঁজে
পাওয়াটাই ছিল আমার কাছে গুপ্তধন খুঁজে পাওয়ার সমান।
লিটারেসি প্যারাডাইস- আপনি চিনের ইউনান প্রদেশে একটি পর্বত আবিষ্কার
করেছেন?
এই আবিষ্কারটা আপনার কীভাবে সম্ভব হলো?
অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়- আসলে হিমালয়, বা অন্য কোথাও, যেখানেই কম লোক গেছে সেরকম জায়গা সম্পর্কে
আমার বরাবরই কৌতুহল ছিল বা আছে। হিমালয় পর্বতমালা, তার পূর্ব প্রান্তে যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে,সেটা হল বার্মার (মিয়ানমার) একেবারে উত্তর বিন্দু। সেখান থেকেই আমার কৌতূহলের জন্ম হয়।মানচিত্রে, মিয়ানমারের সেই কাকাবোরাজি রেঞ্জের ডানদিকে তাকিয়ে দেখি আমি ইউনান প্রদেশে পৌঁছে গেছি। সেখানে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায়- তিনখানা বড় বড় নদী (সালউইন, মেকং এবং চিনশা) উত্তর থেকে
দক্ষিণে বইতে গিয়ে, একটা জায়গায় এসে একদম সমান্তরাল ভাবে
বয়ে গেছে প্রায় কয়েকশো কিলোমিটার এবং সেখানে পৃথিবীর অন্যতম গভীর গিরিখাত তৈরি হয়েছে। সেই থেকেই আমি ভাবতে থাকি যদি এই অঞ্চলে যাওয়া যায় এবং টুরিস্টরা যেভাবে যাচ্ছে সেভাবে না
গিয়ে যদি নতুন কিছু এক্সপ্লোর করতে
পারি। তখন আমি যোগাযোগ করেছিলাম ঐ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে যেসব পর্বতারোহীরা কাজ
করছেন তাদের সাথে।একজন ছিলেন অ্যামেরিকান রক ক্লাইম্বার এবং আর
একজন ছিলেন জাপানের। জাপানের অভিযাত্রী তামোৎসু নাকামুরা সান আমাকে একটা রুট সাজেস্ট করেন। আর একজন অ্যামেরিকান
পর্বতারোহী যিনি চীনে থাকেন তিনিও আর একটা জায়গা সাজেস্ট করেন। আমি অ্যামেরিকান
পর্বতারোহী মাইক ডোবির সাজেশনেই আমি ইউনানে এই অঞ্চলটায় যাই এবং গিয়ে খোঁজ করতে
করতে এমন একটা পর্বতমালায় পৌছোই যেটা ছোটো পর্বতমালা কিন্তু যেটার মানচিত্রে কোনো
নাম, ধাম, বিশদ বিবরণ ছিল না।
লিটারেসি প্যারাডাইস- পৃথিবীতে কি এখনও অনেক আনএক্সপ্লোর্ড জায়গা আছে?
অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়- হ্যাঁ এখনও আছে। আনএক্সপ্লোর্ড বলতে ডিজিটালি আনএক্সপ্লোর্ড নয়, গুগল আর্থে তুমি তো সবই দেখতে পাচ্ছো। কিন্তু মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি এরকম জায়গা এখনও আছে। তাই অভিযান অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি পৃথিবীতে। কারণ, কোনও শূন্যস্থানই, তা সে
যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তাৎপর্যবিহীণ নয় বিজ্ঞানের কাছে। আমার প্রাপ্তি এই টুকুই
যে এরকম কয়েকটা শূন্যস্থান পূরণ আমি করতে পেরেছি। ইউনানের কাজটা সম্বন্ধে বিশদে জানতে
হলে এই লিংকটায় যাওয়া যেতে পারেঃ
প্রতিবেদন-অমিত দে
Post a Comment