বাংলা ও বাঙালির গৌরবময় ইতিহাসের জীবন্ত দলিল বহন করে নীললোহিতের 'প্রথম আলো'
আঠারোশো তিরাশি (১৮৮৩) থেকে উনিশশো সাত (১৯০৭)। সময়ের হিসেবে দুই যুগ, কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে সবচেয়ে আলোড়িত অধ্যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে যে অন্ধকার যুগের সূচনা হয়েছিল তা দুশো বছরের বেশিও স্থায়ী হতে পারতো।কিন্তু 'অন্ধকারের উৎস-হতে উৎসারিত আলো' জ্বেলে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন কতিপয় মহামানব। সেইসব নবজাগরিত যুগমানবদের সুবিশাল কর্মকান্ডের সুবিস্তৃত ইতিহাসকে সাহিত্যের শামিয়ানায় একসূত্রে গাঁথার দুঃসাহস সফলতার সঙ্গে দেখিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বর্ণাঢ্য বেগবান 'প্রথম আলো' উপন্যাসে।
উপন্যাসের সূচনা হয়েছে ইংরেজ শাসিত ভারতের এক স্বাধীন রাজ্য ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের রাজপ্রাসাদে বিজয়া দশমীর মহাভোজ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। এবং উপন্যাসের প্রথাগত নায়ক এই বংশের এক কাছুয়ার (রাজার ঔরসে জন্ম দাসীর সন্তান) পুত্র ভরত, রাজ রোষে যার মৃত্যুদণ্ড হয়। কিন্তু দৈবচক্রে তাকে উদ্ধার করে কোলকাতায় নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন রাজবাড়ীর শিক্ষক শশীভূষণ সিংহ। ওই বাড়িতে স্থান পেয়েছিল এক পিতৃমাতৃহীন বালিকা ভূমিসুতা। উড়িষ্যার এই মেয়েটিকে শশীভূষণের মেজদাদা উদ্ধার করেন পুরীর এক পাণ্ডার কাছ থেকে, যার কাছে ভূমিসুতাকে বিক্রি করে দিয়েছিল ওর এক চশমখোর মামা। ভূমিসুতা ও ভরত এই দুই কাল্পনিক চরিত্রকে ঘিরে কাহিনী আবর্তিত হলেও এই মহাকাব্যিক উপাখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র 'সময়'। যে সময় কিশোর রবীন্দ্রনাথকে যৌবনের পরিপক্কতা দিয়েছে, অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার নিবিড় মেলবন্ধনে। সময় যত এগিয়েছে রবির জীবনে প্রাপ্তি ও বিচ্ছেদের অদ্ভুত বৈপরীত্যে আবির্ভাব ঘটেছে ভিন্ন ভিন্ন নারীর। তাই কখনো নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী,কখনো ভাইঝি ইন্দিরা,কখনো ব্যারিস্টার আশু চৌধুরীর ভাগ্নী প্রিয়ম্বদা দেবী প্রভাব ফেলেছেন কবির লেখনীতে। শুধু রবিকবি নন, আর এক যুগাবতার বিবেকানন্দের শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হওয়ার আখ্যান এই উপন্যাস। ভারতবর্ষ নামের এক দেশ ও তার অন্তরাত্মাকে প্রথম সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি, তাইতো আমেরিকার মাটিতে ভারতবর্ষের স্বরূপ চিনিয়েই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি,ফিরে এসেছিলেন দেশের মাটিতে, নিজের দেশের পীড়িত,ক্ষুধার্ত মানুষের ত্রাতার ভূমিকায়।যুক্তিবাদ ও আধ্যাত্মিকতার যে চিরকালীন বিবাদ তার ঊর্ধ্বে উঠে রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা পড়েছিলেন নরেন ছাড়াও আরো কয়েকজন বিখ্যাত মানুষ। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ধন্বন্তরী ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার ও নাট্যাচার্য গিরীশ ঘোষ।তাইতো আপাতদৃষ্টিতে দুর্বিনীত এই ডাক্তার কামারপুকুরের অশিক্ষিত বামুন রামকৃষ্ণের মায়ার বাঁধনে বাঁধা পড়েছিলেন আমৃত্যু। বাংলার নাট্য জগতের মুকুটহীন সম্রাট, গণিকালয়ে রাত কাটানো মাতাল গিরীশ তাঁর সংস্পর্শে এসে ভক্তিরসের প্লাবন ঘটিয়েছিলেন বাংলা থিয়েটারে। পতিতার মেয়ে নট সম্রাজ্ঞী বিনোদিনী তাঁর চরণ তল স্পর্শ করে ধন্য হয়েছিলেন। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারকে বাঙালি কতটা মনে রেখেছেন জানিনা তবে মেয়েদের ডাক্তারি পড়ার প্রয়োজনীয়তা তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন। মূলত তাঁর উৎসাহে ব্রাহ্ম সংস্কারক ব্রজকিশোর বসুর কন্যা কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার হন। জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুও তাঁরই উৎসাহে মাদ্রাজে যান ডাক্তারি পড়তে।যদিও তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি শিক্ষা সম্পন্ন না করেই ফিরে আসেন ও পরবর্তীতে সমাজ সংস্কার ও নারী শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আসলে এমন একটা উপন্যাস নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছি, এমন একটা সময়ের কথা বলতে শুরু করেছি যেখানে পরতে পরতে রয়েছে নতুনের সঙ্গে পুরাতনের সংঘাত, বিজ্ঞানের সঙ্গে আধ্যাত্মবাদের বৈপরীত্য,পরাধীনতার সঙ্গে স্বাধীনতার সংঘাত,মূর্তর সঙ্গে বিমূর্তের বিবাদ। আর এই অচলায়তন ভাঙার লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন এমন কয়েকজন মহামানব যাদের কথা বলতে গেলেই গুলিয়ে ফেলছি বারবার। কোথা থেকে শুরু করি আর কোথায় গিয়ে শেষ করি বুঝে উঠতে পারছি না মোটেই। দুই পর্বে লেখা এই উপন্যাসের প্রথম পর্বে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের ইতিহাস,আদব কায়দা,রাজার আলোকচিত্র,পদাবলী সংগীত, কবিতা লেখা, ছবি আঁকা ইত্যাদির প্রতি দুর্বলতা,রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব,অন্দরমহলের জীবনযাত্রা, পার্বত্য ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ত্রিপুরার বিভিন্ন উপজাতির চরিত্রগত শ্রেণীবিভাগ, সতীদাহ, বাল্য বিবাহ সহ বিভিন্ন কুপ্রথার অবলুপ্তি,শিক্ষা দীক্ষা,স্কুল কলেজ স্থাপন ইত্যাদি ঘটনা প্রবাহ বর্ণিত হয়েছে লেখকের কল্পনার সঙ্গে বাস্তব চরিত্রদের যথাযথ মেলবন্ধনে। রাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের একান্ত সচিব রাধারমণ ঘোষের মুখে প্রথম উচ্চারিত হয় নবীন কবি রবি ঠাকুরের নাম। আবার রাজার মুখেই শোনা যায় সেকালের আরো দুই বিখ্যাত কবি নবীনচন্দ্র সেন ও হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের নাম।বাংলার একমাত্র শাস্ত্রীয় সংগীত ঘরানা,বিষ্ণুপুর ঘরানার বিশিষ্ট শিল্পী তথা বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবি ঠাকুরের সংগীত শিক্ষক যদুনাথ ভট্টাচার্যের (যদু ভট্ট) সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে এই রাজ দরবারেই। শুধু তাই নয় রাজার কোলকাতা বসবাসের ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়েই পাঠক প্রবেশ করে ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলে। রাজবাড়ীর শিক্ষক শশীভূষণের অসুস্থতার কারণে পাঠকের পরিচয় হয় ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের সঙ্গে। তিনি বিখ্যাত ডাক্তার রাজেন্দ্র দত্তের সংস্পর্শে এসে এলোপ্যাথি থেকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার প্রতি অনুরক্ত হন। প্রসঙ্গক্রমে আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার কথা জানাতে পারি। ঘটনাক্রম যতই এগোতে থাকে ভরত জড়িয়ে পড়ে ভূমিসুতার বিড়ম্বিত জীবনের সঙ্গে।এই দুই কাল্পনিক চরিত্রের জীবনের সঙ্গে লেখক মিশিয়ে দেন বাস্তবের মহামানবদের। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি ব্রাহ্মসমাজ, কেশবচন্দ্র সেনের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ (নব বিধান), শিবনাথ শাস্ত্রী,আনন্দমোহন বসু,দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উপদলীয় ভাগাভাগি, পৌত্তলিকতার পরিবর্তে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা, নারী শিক্ষা, সমাজ সংস্কার, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগমন, সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, পেশাদারী থিয়েটার চর্চা, বিজ্ঞান চর্চা ইত্যাদি বাংলার নবজাগরণের প্রতিটি অধ্যায় তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসের পরতে পরতে।
যদি ধাপে ধাপে ভাগ করি তাহলে এই উপন্যাসের আরেক কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কিশোর রবীন্দ্রনাথ থেকে যুবক রবীন্দ্রনাথের মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তর এই উপন্যাস থেকে পাঠকের বিশেষ প্রাপ্তি। নতুন বৌঠান কাদম্বরী ও নতুনদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে চন্দননগরের গঙ্গার তীরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে কাটানো দিনগুলি রবির লেখনীতে বিশেষভাবে প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে কাদম্বরীর সৌন্দর্যচেতনা, রসবোধ,অভিমান,একাকীত্ব রবিকে আলোড়িত করেছে বারবার। রবির প্রথম দিকের বেশিরভাগ লেখার প্রথম পাঠিকা ছিলেন এই নতুন বৌঠান। তবে শুধু মনভরানো প্রশংসা নয়,কঠিন সমালোচনা করতেও পিছপা হতেন না তিনি। তাই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবি নতুন বৌঠানের সাহচর্যে থাকতে পছন্দ করতেন। তবে মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীও চাইতেন তাঁর এই লাজুক দেওরটিকে নিজের কাছে রাখতে। তিনি ঠাকুর বাড়ির রমনী হিসেবে প্রথম একাকী বিলেত যাত্রা করেন ও ঠাকুর বাড়ির যৌথ সংসারে ভাঙন ধরিয়ে পৃথক থাকতে শুরু করেন। তাঁর ছেলেমেয়ে সুরেন্দ্র ও ইন্দিরাকে যথাক্রমে সেন্ট জেভিয়ার্স ও লোরেটোতে পড়িয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। শুধু তাই নয় সেই সময়কার বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হতেন জ্ঞানদানন্দিনীর সান্ধ্য আসরে। গান বাজনা,সাহিত্য চর্চা, পানভোজন ইত্যাদির জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে পাঠক তৎকালীন অভিজাত সমাজের সঙ্গে পরিচিত হয়।সত্যেন্দ্রনাথ শুধু যে নিজের স্ত্রীকে অন্তঃপুরের বাইরে এনেছিলেন তা নয়, নিজের হাতে স্ত্রীর জন্য শেমিজ,শায়া, পেটিকোট বানিয়ে দিয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ময়দানে বেড়াতে গিয়ে বহুযুগের অচলায়তনে আঘাত হেনেছিলেন। তবে পক্ষপাতিত্ব না থাকলেও রবির বিশেষ টান ছিল নতুন বৌঠানের প্রতি। তাই নিজের স্ত্রী মৃণালিনীকে গড়েপিটে ঠাকুরবাড়ির উপযুক্ত করার ভারটি নতুন বৌঠানের হাতেই তুলে দিতে চেয়েছিলেন রবি। কিন্তু বড়দের মুখের উপর কথা বলতে পারতেন না রবি। জ্ঞানদানন্দিনী মৃণালিনীকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখেন তাকে মানুষ করার জন্য। এদিকে সবদিক থেকেই বড্ড একা হয়ে পড়েছিলেন কাদম্বরী। অসহ্য একাকীত্ব আর অবহেলা তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল আত্মহননের পথে।এই মৃত্যু রবিকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁর অসংখ্য গানে কবিতায় প্রিয় মানুষটিকে হারানোর বেদনা নীরবে উচ্চারিত হয়েছে। তবে আজকের প্রজন্ম যেভাবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নতুন বৌঠানের এই মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ককে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ চটুল রসিকতায় লিপ্ত হয় তা বড় ব্যথিত করে আমায়। ভাবি, ক'পাতা নোটস মুখস্থ করে ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষার বড়াই করা বাঙালির কি চূড়ান্ত অবনমন! যাইহোক জমিদারির কাজে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে রবির প্রকৃতিপ্রেম ও সমাজ চেতনার পরিস্ফুটন ঘটে,যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার কবিতা,গানে ও উপন্যাসে। রবির বিলেত যাত্রা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি কিভাবে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে তাও ফুটে উঠেছে এই উপাখ্যানে। অন্যদিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জাহাজ ব্যবসায় নেমে কিভাবে ইংরেজ বেনিয়াদের অসাধু চক্রান্তের কাছে পরাস্ত হন কিন্তু তাঁর এই স্বদেশী ব্যবসা উদ্যোগ কিভাবে জনমানসে জাতীয়তাবোধের প্রসার ঘটিয়েছে তা এই উপন্যাসের অন্যতম উপজীব্য।ব্রাহ্মসমাজ,ভারতী পত্রিকা,ঠাকুরবাড়ির নাট্য চর্চা,গগন ঠাকুরের চিত্রকলা ইত্যাদি সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবার সম্পর্কে এতো সাবলীল ও বিস্তৃত উপাখ্যান বোধহয় বাংলা সাহিত্যে সত্যিই বিরল।
তৃতীয় ধাপে পাঠক হারিয়ে যান রামকৃষ্ণের ভক্তিবাদে।প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতি ছাত্র,যুক্তিবাদী,সুগায়ক সিমলে পাড়ার দত্ত বাড়ির ছেলে নরেন কিসের টানে ছুটে আসতেন এক অশিক্ষিত বামুনের কাছে? বারবার নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করেও কেন ঠাকুরের থেকে দূরে সরে থাকতে পারেননি তিনি? কি সেই অলৌকিক আকর্ষণ,নাকি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, যা বারে বারে টেনে এনেছে নরেন্দ্রনাথ,মহেন্দ্রলাল,গিরীশ ঘোষের মত যুক্তিবাদী মানুষদের ? আসলে আর কেউ তো বলতে পারেননি "যত মত তত পথ"! আর কেউ তো নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিতে পারেননি বাকি সব ধর্মের অস্তিত্বকে। হিন্দু ধর্মের আচার-সর্বস্বতা, গোঁড়ামি ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠে রাজা থেকে ভিখারি,পতিতা থেকে শিক্ষিত যুবক সকলকে নিজের হৃদয়ে স্থান দিতে পেরেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস। তাইতো তিনি যুগাবতার,মহামানব। কিন্তু এই মহামানব কি সত্যিই ঈশ্বরের অংশ,তাহলে তার মধ্যে কেন জাগতিক মোহ, মায়া,লোভ,মৃত্যুভয়? এসব প্রসঙ্গও উঠে এসেছে উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে। তাই এই লেখা পড়তে পড়তে কখনো একপেশে বিরক্তিকর মনে হয়না। যাইহোক যে হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ নরেন উপলব্ধি করেছিলেন গীতা,উপনিষদ,বেদ,দর্শন ও বিজ্ঞানের সঠিক অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে,রামকৃষ্ণের সহজিয়া জীবন দর্শনের মধ্য দিয়ে,ভারত-পরিক্রমা করে দরিদ্র নিরন্ন ভারতবাসীর সংস্পর্শে এসে, তা তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বিশ্বের দরবারে। তবে সে কাহিনী এখন নয় উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে বর্ণিত হয়েছে।তবে পুরো উপন্যাসে কোনো চরিত্রকে কোথাও অযথা মহিমান্বিত করা হয়নি। যাদের আমরা আজ মহামানবের আসনে বসিয়ে পুজো করি তাদের লেখক দোষ,গুণের সমাহারে রক্তমাংসের চরিত্র হিসেবেই তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। তাই এই দীর্ঘ উপাখ্যান পড়তে গিয়ে পাঠক অতিরিক্ত অনুরক্ত বা বিরক্ত হন না বরং সম্পৃক্ত হন লেখকের নিরপেক্ষ ভাবনার সঙ্গে। বিখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব শিশির ভাদুড়ির জীবন নিয়ে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা 'নিঃসঙ্গ সম্রাট' যেমন বাংলা থিয়েটারের জ্বলন্ত দলিল তেমনি 'প্রথম আলো'র অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে গিরীশ ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর, বিনোদিনী দাসী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, ন্যাশনাল থিয়েটার,স্টার থিয়েটার, এমারেল্ড থিয়েটার সহ বাংলা নাট্য জগতের উপেক্ষিত উপাখ্যান। 'সময়' এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হলেও 'দেশ ও জাতীয়তাবাদ' এই কাহিনীর সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক অংশ। পরাধীনতার অন্ধকারের উৎস হতে নবজাগরণের আলোকে আবির্ভূত হন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্রের মত মহামানব। যাঁরা আঘাত হানেন সতীদাহ,বাল্যবিবাহ সহ একাধিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে। ঝাঁপিয়ে পড়েন নারী শিক্ষা,লোক শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ব্রত নিয়ে। পরবর্তী সময়ে এঁদের দেখানো পথে হেঁটে আরো অসংখ্য মানুষ অনুভব করেন স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা। সেখান থেকেই উমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, বাল গঙ্গাধর তিলক প্রমুখরা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করেন। এই রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটটি দ্বিতীয় পর্বে গিয়ে গান্ধীজির সুদীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। গবেষণাধর্মী এই লেখার প্রথম পর্বে অসংখ্য বিখ্যাত বাঙালির কথা উল্লেখ রয়েছে, উল্লেখ রয়েছে অমৃতবাজার,সম্বাদ কৌমুদী,তত্ত্ববোধিনী ইত্যাদি পত্রপত্রিকার। বাংলার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা,বাঙালির পোশাক পরিচ্ছদের বিবর্তন, বাঙালির খাওয়া দাওয়া, আচার অনুষ্ঠান,লোক সংস্কৃতি,সমাজ জীবন ইত্যাদির নিখুঁত বর্ণনা রয়েছে। রয়েছে অমৃতলাল,জগদীশ চন্দ্র বসুর বিজ্ঞান সাধনার আখ্যান। রয়েছে মা সারদা দেবীর সহজ জীবন দর্শন। রয়েছে ধর্মের মূল ভিত্তিতে আঘাত হানা ডারউইনের বিবর্তনবাদ। যে উগ্র হিন্দুত্ববাদের অসুখ আজ ভারত-আত্মার গভীরে বাসা বেঁধেছে তার শুরুর কথাটিও বলা আছে উপন্যাসে। মুসলিম সমাজের গোঁড়ামি, হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার বাস্তব চিত্র উপন্যাসের কাল্পনিক কাহিনীর সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। ভরত আর ভূমিসুতা কখনো দাঙ্গার কবলে,কখনো অদৃষ্টের পরিহাসে এক হতে হতেও হারিয়ে যায় পরস্পরের থেকে।
যাইহোক এই অল্প পরিসরে হয়তো উপন্যাসে উল্লিখিত সব প্রথিতযশা বাঙালির নাম উল্লেখ করা সম্ভব হল না।আত্মবিস্মৃত জাতি হিসেবে বাঙালির দুর্নাম অনেকদিনের। তাই নিজের শিকড়কে জানতে হলে,বাংলা ও বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস জানতে হলে প্রতিটি বাঙালির পড়া উচিত এই উপন্যাস। আর আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র নই তাই এই লেখাটিকে পাঠ সমালোচনা না বলে পাঠ অভিজ্ঞতা বলাই ভালো। সর্বোপরি এই সুদূর বিস্তৃত সময়কে দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে উপন্যাসের আকারে লিপিবদ্ধ করার সে সফল দুঃসাহস দেখিয়েছেন লেখক তার জন্য শতকোটি প্রণাম ও কুর্নিশ জানাই আমার প্রিয় লেখককে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার--বেলঘরিয়ার জেঠু, আমাদের বিয়ের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার দেওয়ার জন্য।
Post a Comment