প্রফুল্ল চাকীর নাতনি মাধবী তালুকদারের নিত্যসঙ্গী যখন দারিদ্র্যতা
দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর থানার সামনে ফুটপাথে অসহায় ভাবে দিন কাটছে এক বৃদ্ধার। বাড়ি বলতে একটি ছোট্ট কুঁড়েঘর। রাত হলেই আঁধারে ঢেকে থাকে সেই বাড়ি। কারণ বাড়িতে নেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা। বাড়ির মধ্যে একটি ছোট্ট চৌকিতে রান্না করে, সেই চৌকির ওপর বসে খাওয়া-দাওয়া করে ও ঘুমিয়ে দিনযাপন তার। বলা যায় সেই বৃদ্ধা হলো ভারতবর্ষ। সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের ভারতবর্ষ গল্পে বলা হয়েছিল এক বুড়ির গল্প। যার মুখে ছিল সুদীর্ঘ আয়ুর দাগ৷ মাথায় ছিল একমাথা সাদা চুল। রাক্ষুসীর মতো চেহারা যার পরনে ছিল একটি ময়লা কাপড় ও তার ওপর নোংরা চিটচিটে কম্বল। এক হাতে বেঁটে লাঠি। এক গভীর নিম্নচাপের দিন বটগাছের নীচে এক লম্বা ঘুম দেয় সেই বুড়ি। গত তিনদিনেও যার ঘুম ভাঙ্গেনা। বুড়ি যে গ্রামে থাকতো সেই গ্রামের সকলে ধরে নেয় বুড়ি মারা গেছে। কাজেই গ্রামের মানুষেরা ঠিক করে দেহ সৎকার করবে। কিন্তু বুড়ির ধর্ম কী? এরপর একদল হিন্দু বলে সে হিন্দু ধর্মের আর একদল মুসলিম বলে সে মুসলিম ধর্মের। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে বাঁধে সংঘাত। এরই মাঝেই ঘুম ভাঙ্গে বুড়ির। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর বুড়িকে দুপক্ষের মানুষ তার ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বুড়ির মুখে তখন একটাই জবাব 'তুই মর, তোর চৌদ্দ গুষ্টি মরুক।' শেষমেশ বুড়ি হয়ে উঠলো সর্বধর্মের প্রতীক। বাস্তবের এই বৃদ্ধাও এমনি এনাকেও বলা যায় সর্বধর্মের প্রতীক৷ কারণ পেটে খাবার না থাকলে কখনো ধর্ম হয়না। এই বৃদ্ধার কাছে খাবারই হলো এখন সবচেয়ে বড়ো ধর্ম।
এতোক্ষণ যা লিখলাম তাতে আপনাদের মনে হতে পারে আমি হয়তো রাস্তার ধারে পড়ে থাকা কোনো এক আর্তপীড়িত বৃদ্ধার জীবনযাপনের কথা বলছি। একদমই তা নয়৷ এই বৃদ্ধা আর চার-পাঁচটা রাস্তার ভবঘুরেদের মতো নয়। ইনি একজন মহান পরিবারেরই মেয়ে। যার পরিচয় শুনলে আপনি আঁতকে উঠবেন। আপনি হয়তো এও ভাববেন এটা কী করে সম্ভব? তবে এটাই বাস্তব। এই বৃদ্ধার নাম মাধবী তালুকদার। মহান বীর বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীর নাতনি হলেন তিনি। এখন তার বয়স নব্বইয়ের কাছাকাছি। দুমুঠো খাবার সংগ্রহ করতেই হাজারো কষ্টের সম্মুখীন হতে হয় তাকে। তিনি মন্দিরে কাজ করেন ও তার ছোটো ছেলে বাজারে কচু শাকের ব্যবসা করে। মন্দিরের কাজ ও কচু শাকের ব্যবসা করে সামান্য আয়ে যেমন-তেমন করে সংসার চলে তাদের।
স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও মাধবী তালুকদারের মতো অসংখ্য বিপ্লবী পরিবারের কাছে দারিদ্র্য এখন নিত্যসঙ্গী। যাদের রক্তে দেশ স্বাধীন হলো তাদের পরিবারই এখন বঞ্চিত গোটা দেশে। এদের খোঁজ নিতেও কেউ আসেন না। আমরা সকলেই ভুলে যায় এসব মানুষদের কথা। বিপ্লবীরা কী এ দিনটাই দেখতে চেয়েছিল যেখানে দেশের আসল বীরের পরিবারই বঞ্চিত থাকবে? ভাবতে অবাক লাগে যে প্রফুল্ল চাকীর নাতনির ঠিকানা আজকে পথঘাট। আমরা কী পারিনা তাদের কথা সরকারকে বলতে? দেশের কোনো সরকারই বিপ্লবী পরিবারের জন্য এতটুকু সাহায্য করেনি। এ আমরা কোন দেশে বসবাস করছি যেখানে বিপ্লবীর সন্তানেরাই বঞ্চিত?
মাধবী তালুকদার তার দশ বছর বয়সে মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানাগুলিতে যেতেন ও তাঁর ঠাকুরদা প্রতাপ চাকীর ছোটো ভাই প্রফুল্ল চাকীর দায়িত্বপ্রাপ্ত আন্দোলন সম্পর্কিত কাজ করতেন। বলা চলে মাধবী তালুকদারও একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। গঙ্গারামপুরে ভালো পরিবারে বিয়ে হওয়া সত্বেও তার সঙ্গী এখন খাদ্যের অভাব। প্রফুল্ল চাকীরা ছিলেন চার ভাই৷ তাঁর দাদা প্রতাপ চাকীর নাতনি হলেন মাধবী তালুকদার। লকডাউনের ফলে বন্ধ বাজার ও মন্দির, এই পরিস্থিতিতে খাবার জুটছে না তাদের। খাদ্য সংকটের মুখে হাহাকার পড়েছে তার পরিবারে। দেশে যদি স্বাধীনতা সংগ্রামীরা প্রকৃত মর্যাদা পেত তাহলে মাধবী তালুকদারের মতো মহিলাদের অনাহারে দিন কাটাতে হতো না। তারা কী স্বপ্নেও ভেবেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাতনি হয়েও এভাবে দিন কাটাতে হবে?
প্রতিবেদন- সুমিত দে


Post a Comment