Header Ads

পাগলাপন্থী বিদ্রোহ। হিন্দুধর্ম, সুফিবাদ ও সর্বপ্রাণবাদের সংমিশ্রণে সংঘটিত ইতিহাসের এক অচেনা বিদ্রোহ



আচ্ছা,পাগলারা কি আন্দোলন করতে পারেপারে বৈকি! আলবাত পারে অন্তত বাংলার ইতিহাসে তার প্রমাণ পাওয়া যায় আসলে নিজেদের সামান্যতম অধিকার যখন অন্য কেউ ছিনিয়ে নেয় তখন মানুষ বিদ্রোহী হয়ে পাগল হয়ে যায়। না,যারা আন্দোলন করেছিল তারা কেউ 'পাগলা' নয়, তবে তাদের 'পাগলাপন্থী' বলা হয়। আসলে পাগলাপন্থী হল এক ধরনের সম্প্রদায় এবং ১৮২৪-৩৩ এই দীর্ঘ ন'বছর ধরে উত্তর  ময়মনসিংহে তাদের দ্বারা সংগঠিত বিদ্রোহের নাম হল পাগলাপন্থী বিদ্রোহ জমি ও খাজনা সংক্রান্ত ১৯৫ বছরের পুরনো এই আন্দোলনের তাৎপর্য আজও অনুভব করা যায় অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ছিল 'গারো' উপজাতিদের বসবাস। এরা শেরপুরের জমিদারদের অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতনের শিকার হত ওইসব জমিদারেরা ছিল ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা পোষিত ও তাদের আজ্ঞাবাহক। ১৭৯৩ সালের  চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিধান অনুযায়ী জমিদারেরা বংশানুক্রমিকভাবে ছিল জমির মালিক বা ভূস্বামী


"কহিলাম আমি, 'তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই। চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।" (দুই বিঘা জমি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরতাই, এদের জমির অভাব না থাকলেও, ছিল মানবিকতার অভাব আর ছিল লোভ, নিরীহ প্রজাদের অত্যাচার করার বাসনা এবং ইংরেজ সরকারকে তেয়াজ করার রীতিএরা প্রজাদের থেকে নিষ্ঠুরভাবে খাজনা আদায় করত শুধু জোর-জুলুম করে খাজনা আদায়েই করত না, জোর করে প্রজাদের বিনা বেতনে প্রচুর খাটিয়েও নিত। এইসব পাগলাপন্থি গারোরা ছিল সহজ, সরল মনের এই পাগলাপন্থীদের মধ্যে প্রধান বিদ্রোহী ছিলেন টিপু শাহ (ওরফে টিপু পাগলা বা টিপু গারো) তাঁর পিতা করম শাহ ছিলেন এই পাগলাপন্থী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা করম শাহের পিতা শের আলী গাজীর নামেই শেরপুর জেলার নাম রাখা  হয় যাইহোক, টিপু  গারোদেরকে যে ধর্মীয় বাণী প্রচার করে গেছেন তার সারমর্মটি হল-"ঈশ্বর সমস্ত মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করেছেন। অতএব,কেউ কাউকে পরাধীন করে রাখতে পারবে না।" এই বাণীটি আজও তাৎপর্যপূর্ণ টিপুর এই ধর্মীয় বাণী গারো সম্প্রদায়ের মানুষদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলবিদ্রোহীরা তাদের সব দাবি একমুখী করে তুলেছিলবিভিন্ন জায়গায় যেমন বেগার প্রথায়,অতিরিক্ত করারোপণে, ইংরেজ পুলিসের অত্যাচার ও অন্যায়ভাবে নেওয়া চাঁদাতে, বার্মায় সংঘটিত যুদ্ধের জন্যে বিভিন্ন করে এবং নানা প্রয়োজনীয় জিনিসের জোগাড় করার জায়গাসহ নানা জায়গায় কম খাজনা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন টিপু শাহ এই প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করেই সমস্ত কৃষকরা বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল বলা যায় টিপু শাহই তাদের বিদ্রোহে উদ্বুদ্ধ করেছিল ১৮২৪-২৫ সাল পর্যন্ত এই পাগলাপন্থী বিদ্রোহের প্রথম পর্ব ছিল ১৮২৫ সালে গারো কৃষকরা জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয় 

১৯শে জানুয়ারি, ১৮২৫ সালে এরা দলে দলে শেরপুরে প্রবেশ করে এবং জমিদারদের বাড়ি আক্রমণ করে সেখান থেকে তাদের উচ্ছেদ করে দেয় সেখানে যে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তব্যরত ছিলেন তাঁর কাছে এই বিদ্রোহীরা জানিয়ে দেয় যে তারা জমিদারি অত্যাচার ও শোষণ মানবে না এভাবেই এরা স্বাধীন গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে আর সূচনা করে পাগলাপন্থী বিদ্রোহের এইসব গারো কৃষকরাই হল মূল পাগলপন্থী বিদ্রোহী পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ উত্তাল হয়েছিল এই আন্দোলনে। এই বিদ্রোহের শিখা ছড়িয়ে পড়েছিল গারো পাহাড়রাজিতে এবং হাওড় এলাকায়

গারোরা শেরপুরের জমিদারদের উচ্ছেদ করেছে এবং স্বাধীন গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে এই খবর জানতে পেরে ইংরেজ সৈন্যরা গারোদের শাস্তি দেওয়ার জন্য সেনা পাঠায় শুরু হয় ইংরেজ সৈন্যদের সাথে কৃষকদের এক দুর্ধর্ষ লড়াই এই লড়াই  চলেছিল প্রায় দু'বছর ধরে অর্থাৎ গারোরা তাদের প্রতিষ্ঠিত স্বতন্ত্র রাজত্ব প্রায় দুবছর লড়াই করে রক্ষা করেছিল কিন্তু এক নিষ্ঠুর পরিহাসে শেষ রক্ষা হল না পরে রংপুর থেকে বিশাল ইংরেজ সেনাবাহিনী আসে ও শেরপুরকে এই গারো বিদ্রোহীদের হাত থেকে উদ্ধার করেপাগলাপন্থী টিপুকে ইংরেজ সেনাবাহিনী ১৮২৭ সালে গ্রেফতার করে। ব্রিটিশ আদালত তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে এবং এর ২৫ বছর পরে ৮ই অক্টোবর,১৮৫২ সালে টিপু শাহের জেলেই মৃত্যু হয়। এভাবেই, ইংরেজ সরকার ১৮৩৩ সালের ১লা এপ্রিল শেরপুর শহর আবার দখল করে সেখানে সরকারি সামরিক বা সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় এর এক মাস পর অর্থাৎ ৩রা মে বিদ্রোহীদের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালানো হয় এমনকি তাদের সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নষ্ট করা হয় এর ফলে, ১৮৩৩ সালের ১৩ই মে থেকে এই আন্দোলন তার গতি হারাতে থাকে এরপরে আন্দোলনকারীরা নিয়ম মেনেই নানা দাবির কথা জানানোর পথে আসে সরকারও তাদের অনেক দাবি মেনে নেয় ও জায়গায় শান্তি ফিরে আসে জানা যায় যে, উজির সরকারকে ময়মনসিংহে পাঠিয়ে উকিল নিযুক্ত করা হয় এইসব  বিদ্রোহীদের পক্ষে দাবি আদায়ের জন্যেএমনকি কোর্টে তাদের পক্ষে আইনি লড়াই করার জন্যে তৎকালীন রাজধানী কলকাতা থেকে একজন অ্যাটর্নি আনাও হয়েছিল

ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে নজীর করেছিল বাংলার এই গারো কৃষকরা মনে রাখতে হবে যে, এই পাগলাপন্থী  বিদ্রোহ কোনো আদিবাসী ধর্মকে কেন্দ্র করে ছিল না এই বিদ্রোহ ছিল মূলত হিন্দুধর্ম, সুফিবাদ ও সর্বপ্রাণবাদের সংমিশ্রণ বলাই যায় যে, হিন্দু- মুসুলমান নির্বিশেষে সমস্ত ধর্ম ও বর্ণের মানুষ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল সমস্ত জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই বিদ্রোহ আজকের দিনের এক অনুপ্রেরণা বটে সমাজতন্ত্র ও বিদেশি শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে ও অধিকার রক্ষার জন্যে এই আন্দোলন ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয়আমাদেরও উচিৎ প্রায় দুশো বছর আগে ঘটে যাওয়া এই আন্দোলনকে ও আন্দোলনকারীদের সশ্রদ্ধ স্মরণ করার


তথ্যসূত্র:ভারতের মুক্তিসংগ্রামে বাংলা, কৃষ্ণ ধর, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৯৭ উইকিপিডিয়া সহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট


        



No comments