Header Ads

প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী গোপীমোহন সাহাকে। যাকে কেউ মনে রাখেনি


- একটা কাগজ-কলম হবে? 

- নিশ্চয়ই। আর কিছু লাগলে বলতে পারো। কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বলো, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। 

- না না, কাগজ-কলম হলেই চলবে। চিঠি লিখব একটা। 

প্রহরী বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যান খাতা-পেন আনতে। কী ধাতুতে যে গড়া এই ছেলেটি! কাল বাদে পরশু ফাঁসি। এই সময়টায় জেল কর্তৃপক্ষের নির্দেশই থাকে, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তের যাবতীয় ইচ্ছে যথাসাধ্য পূরণ করার।


- এই নাও কাগজ আর কলম। এতে হবে তো?

একগাল হাসে যুবক। 

নিশ্চিন্তে লিখতে বসেন শেষ চিঠি। 

"শ্রীচরণেষু মা..."

বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় কলকাতা পুলিশের রাশ হাতে নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন এক শ্বেতাঙ্গ অফিসার, চার্লস অগাস্টিন টেগার্ট। স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের পত্তন এবং তার পরিকাঠামোগত বুনিয়াদ স্থাপনে সিংহভাগ কৃতিত্ব ছিল টেগার্টের। কলকাতা তো বটেই, রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত ছিল তাঁর দুর্ধর্ষ 'সোর্স নেটওয়ার্ক'। সঙ্গে যোগ হয়েছিল ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং দুর্দমনীয় সাহস। ফলত তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনে ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং কিংবদন্তিসম। পুলিশ কমিশনারের পদে উন্নীত হয়েছিলেন ১৯২৩ সালে, লাগাতার আট বছর ছিলেন কলকাতা পুলিশের অবিসংবাদিত সর্বাধিনায়ক। 

মাত্রাছাড়া উচ্চাকাঙ্খী টেগার্ট ছিঁচকে চোর বা বেপরোয়া ডাকাত বা ত্রাস সৃষ্টিকারী স্থানীয় গুণ্ডাদের সঙ্গে বিভাজনরেখা মুছে দিয়েছিলেন দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের। আর সেজন্যেই বিপ্লবী দের খতমতালিকার শীর্ষে  ছিলেন তিনি। প্রাণনাশের একাধিক চেষ্টা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। 

১৯২৩ সালের শেষদিকে, কলকাতার এক গোপন ডেরায় শেষ মুহূর্তের পরিকল্পনায় বসেছেন চার বিপ্লবী। অনন্ত সিংহ, দেবেন্দ্র চন্দ্র দে (খোকা),  গোপীমোহন সাহা এবং নগেন্দ্রনাথ সেন (জুলু)। 
- এমন সুযোগ আর আসবে না গোপী... মনে আছে তো... ব্যাটা একেবারে মৃত নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত গুলি চালিয়েই যাবি। অনন্ত সিংয়ের শেষ উপদেশ।

১২ই জানুয়ারি, ১৯২৪। সকাল সোয়া সাতটা, বড়জোর সাড়ে সাত। সাদা ধুতি আর ঝোলা খাকি শার্ট পরিহিত গোপীমোহন দাঁড়িয়ে রয়েছেন পার্ক স্ট্রিট আর চৌরঙ্গী রোডের সংযোগস্থলে, ঘোরাঘুরি করছেন ইতস্তত। যেমন রোজই করেন টেগার্টকে অসতর্ক মুহূর্তে পেয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে। সাহেব অতি ধূর্ত, রোজ মর্নিং ওয়াকে বেরোন না। যে ক'দিন বেরোন, রোজ আলাদা রাস্তা দিয়ে ফেরেন। তা ছাড়া সাদা পোশাকের টিকটিকিরা তো থাকেই আশেপাশে। 

স্নায়ু হঠাৎই সজাগ হয়ে ওঠে গোপীর। আরে, মোড়ের বড় দোকান "Hall and Anderson"-এর সামনে কে দাঁড়িয়ে উনি? দোকান খোলেনি এখনো, বাইরে থেকেই কাচের শো-কেসে সাজিয়ে রাখা জিনিসপত্রে চোখ বোলাচ্ছেন দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক।

পিছন থেকে এক ঝলক দেখেই নিশ্চিত হয়ে যান গোপী। আরে, এ তো স্বয়ং টেগার্ট! দাঁড়ানোর ওই ভঙ্গি তার ভীষণ পরিচিত। খয়েরি রঙের লম্বা ওভারকোটটাও। অবশেষে! অবশেষে নাগালের মধ্যে প্রবল পরাক্রমী পুলিশ কমিশনার! যাঁকে হত্যা করা মানে ব্রিটিশরাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়া। 

এক মুহূর্তও দেরি করলেন না গোপীমোহন। সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন পিছনে, তড়িঘড়ি চাপলেন ট্রিগার। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। আওয়াজে সচকিত সাহেব ঘুরে তাকানোর আগেই ফের ছুটল বুলেট, এবার লক্ষ্যভেদ। ফুটপাথে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা দেহে বুলেটবৃষ্টি করলেন গোপী। ঝুঁকি নেওয়ার কোন প্রশ্নই নেই। মৃত্যু নিশ্চিত করতেই হবে। 

ততক্ষণে লোক জমে গেছে আশেপাশে। পার্ক স্ট্রিট ধরে ছুটলেন গোপী। ধাওয়া করলেন কিছু পথচারী, পিছু নিল একটি ট্যাক্সিও। যা লক্ষ্য করে গোপী গুলি ছুঁড়লেন, পথচলতি একটি মোটরগাড়ি থামিয়ে চেষ্টা করলেন উঠতে। চালক অসম্মত হতে গুলি চালালেন ফের। লক্ষ্যভ্রষ্ট হল বুলেট। একটি ঘোড়ার গাড়ির পাদানিতে উঠে পালানোর শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হল। ধরে ফেলল পুলিশ। গোপীর কাছ থেকে উদ্ধার হল একটি বড় পিস্তল, একটি রিভলভার এবং চল্লিশটি তাজা কার্তুজ। 

লালবাজার নিয়ে যাওয়ার পথে এক প্রস্থ এলোপাথাড়ি মারধর প্রথমে। তার পর আসামীকে সোজা নিয়ে যাওয়া হল নগরপালের ঘরে। এবং ঢুকেই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল গোপীমোহনের। এ কী! কমিশনারের চেয়ারে স্বমহিমায় বসে টেগার্ট! যাঁকে একটু আগেই বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিয়ে এসেছেন প্রকাশ্য রাজপথে! 

অচিরেই বুঝলেন, মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন। টেগার্ট ভেবে খুন করে ফেলেছেন অনেকটা তাঁরই মতো দেখতে এক নিরপরাধ ইংরেজ নাগরিককে। নাম Ernest Day, এক বেসরকারি সংস্থার আধিকারিক। মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই। টেগার্ট জীবিত এবং বহাল তবিয়তেই। 

পরের দিনের খবরের কাগজে হেডিং হল প্রত্যাশিত, "Mistaken identity saves Tegart".  

গোপীমোহনের বাঁচার রাস্তা ছিল না কোন। ভবিতব্য ছিল মৃত্যুদণ্ডই। কারাবাসকালীন নির্যাতন সহ্য করেছিলেন অকথ্য। বিচারপর্বের শেষে ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ যখন ফাঁসির রায় ঘোষিত হচ্ছে, আদালতে দাঁড়িয়ে বললেন, "আমি টেগার্টকে মারতে চেয়েছিলাম। একজন নিরপরাধ মানুষকে মেরেছি বলে অনুশোচনার শেষ নেই আমার। মৃতের পরিবারের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।" 

১৯২৪-এর পয়লা মার্চ। "ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান"-এর দীর্ঘ তালিকায় যুক্ত হল শ্রীরামপুরের যুবক গোপীমোহন সাহার নাম। যাঁর নামে একটি সেতু রয়েছে ওখানে। 

মৃত্যুর দিনদুয়েক আগে প্রেসিডেন্সি জেলের প্রহরীর থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন কাগজ-কলম।শেষ চিঠি লিখেছিলেন গর্ভধারিণীকে.......

"শ্রীচরণেষু মা, 

সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা কোরো ভারতের প্রতিটি সংসার যেন তোমার মতো মা লাভ করে ধন্য হয় আর তাঁরা যেন তোমার গোপীর মতো সন্তান প্রসব করেন, যারা অক্লেশে প্রাণ দেবে দেশের জন্য। 
তোমার স্নেহের গোপী।" 


তথ্য সৌজন্যে: অচেনা লালবাজার 

No comments