Header Ads

পুরোনো কলকাতার সোঁদা বাতাসের গন্ধে নস্টালজিক হতে চান? তাহলে জেনে ফেলুন পুরাতন কলকাতার কিছু যাত্রাপালা ও প্রচলিত গানের কথা


নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের সংমিশ্রণে আমার শহর কলকাতা আজ সত্যিই কল্লোলিনী তিলোত্তমা। রুটি রুজির খোঁজে গ্রাম থেকে, ভিন্ রাজ্য থেকে ভিন্ দেশ থেকে শত শত নারী পুরুষ প্রতিদিন ছুটে আসেন কলকাতার বুকে। তাদের সাফল্য, ব্যর্থতা, আশা, নিরাশা, মিলন, বিচ্ছেদের রোজনামচা বুকে চেপে প্রাচীন থেকে প্রাচীনতর হয় আমার শহর। স্মৃতি ভারে ভারাক্রান্ত নয়,কাহিনীর কৌলিন্যে গর্বিত আমার শহর। যেমন প্রতিদিন সহস্র আরব্য রজনীর কাহিনী লেখা হয় এই শহরের আলোসাজানো অট্টালিকায় কিংবা বস্তির কুঁড়েঘরে তেমনি অতীতের বহু কথা ও কাহিনী হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। তাই আজকের গল্প দাদুর আসরে আপনাদের শোনাবো পুরাতন কলকাতার কিছু যাত্রাপালা ও প্রচলিত গানের কথা.......



গোবিন্দ অধিকারীর যাত্রা :- 

সেকালের কলকাতার যাত্রা দলগুলির মধ্যে গোবিন্দ অধিকারীর দল খুব বিখ্যাত ছিল। শুধু জমিদার বাড়ি বা সম্ভ্রান্ত এলাকার মানুষজন যে এই এই পালার আয়োজন করতেন তা নয় গোয়ালাদের মতো তথাকথিত নিচু জাতের মানুষজনও এই যাত্রাপালার আয়োজন করতেন। খুব বড় বাঁশের মাচা বেঁধে মঞ্চ তৈরি করা হতো। বড় বড় বাঁশের খুঁটিতে ঝাড় লণ্ঠন ঝোলানো হতো। খুঁটির গায়ে লম্বা লম্বা বাঁশের ঘেরাটোপ দিয়ে পাখির খাঁচা ঝুলিয়ে দিতেন বাবুরা (সেকালের বাবুদের পাখি পোষার চল ছিল)। মূলত পৌরাণিক পালা গাওয়া হতো মঞ্চে। যেমন অধিকারী মহাশয়ের "রাধিকার মানভঞ্জন" পালাটি খুব বিখ্যাত ছিল। কুশীলবদের সাজসজ্জা ছিল চড়া ধাঁচের। খোল করতাল,হারমোনিয়াম বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে যাত্রা হতো খালি গলাতেই। চড়া কেটে কেটে সংলাপ বলা হতো, গানের সাথে মঞ্চ জুড়ে নেচে নেচে দর্শকদের মনোরঞ্জন করতেন গোবিন্দ অধিকারী। যেমন শুরুতে কেউ একজন বললেন "বৃন্দাবনসে দূতী আয়া" অধিকারী মশাই উত্তর দিলেন "কেয়া বিলাতসে ধুতি আয়া"। অনেক দেরিতে শুরু হতো যাত্রা আর প্রায় ভোর রাত পর্যন্ত চলতো। 

নোকো(লক্ষণ) ধোপার যাত্রা :- 

বাবুদের বাড়িতে কোনো পুজো পার্বন বা অনুষ্ঠান উপলক্ষে নোকো ধোপার যাত্রার আসর বসত।  লক্ষণ ধোপার গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ, দোহারা চেহারা, কিন্তু গানের গলা ছিল মিঠে। তাঁর "কমলে কামিনী " পালাটি খুব বিখ্যাত হয়েছিল। "বিপদ সময় হও না সদয় ডেকে মরি শ্যামা শ্রীপদ নলিনী" গান ধরলে আবাল বৃদ্ধবনিতার চোখের জল বাগ মানত না।

বিদ্যাসুন্দর যাত্রা :- 

সেকালে বিদ্যাসুন্দরের যাত্রা খুব বিখ্যাত হয়েছিল। এর মধ্যে মালিনীর পালা ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। আসরে মালিনী এসে গান ধরতো ..."ঐ দেখা যায় আমার বাড়ি চৌদিকে মালঞ্চ ঘেরা"। উল্টোদিকে কোটাল গাইতো ... "আর কি আমাদের আনন্দের সীমা আছে। এবার চোর ধরতে পেরে সবার ভয় ঘুচেছে। "সেকালে একটা কথা খুব প্রচলিত ছিল .."কালা পেড়ে ধুতি আর বিদ্যাসুন্দরের পুঁথি কখনো পুরোনো হয় না"। 

মেয়ে পাঁচালী :- 

তখনকার দিনে মেয়ে যাত্রা বা মেয়ে পাঁচালীর দল কিছুকালের জন্য বিখ্যাত হয়েছিল। এঁরা "দক্ষযজ্ঞ" , "পার্বতীর বিবাহ" ইত্যাদি পালা গাইতো। ভাঁড় যে সাজত সে আসরে এসে বলতো... "এক কেঁড়ে এঁড়ে গরুর দুধ, এক মালা চাঁদের আলো বাটিয়া খাইলে আশু প্যাঁড়া সারিবে"। এইসব মেয়েদের দল বেহালা তানপুরা ইত্যাদি বাজাতে জানতো না। মন্দিরা, হাততালি, বাঁয়াতবলা ইত্যাদি সহযোগে তাঁরা একসাথে গান গাইতেন। তবে এই যাত্রাদলগুলি বেশিদিন চলেনি। কারণ ভদ্রোলোকেরা নিন্দে করতে শুরু করেছিলেন। 

ঝুমরওয়ালী :-

আগেকার কলকাতায় ঝমিরওয়ালীদের খুব জনপ্রিয়তা ছিল। মূলত তথাকথিত ছোটজাতের মেয়েরা বিভিন্ন বিয়ে ইত্যাদি উপলক্ষে ঢোল কাঁসি সহযোগে চটুল নাচ নাচত। এইসব গানের ভাষা ছিল খুব অশ্লীল। যেমন ... "মাগী মিনসেকে চিৎ করে ফেলে দিয়ে বুকে দিয়েছে পা, আর চোখটা করে জুলুর জুলুর মুখে নাইকো রা"। তবে কারো কারো গানে কবিত্ব ছিল। তবে বেশিরভাগ গানের কোনো মাথামুন্ডু থাকতো না। 

কাদামাটির গান (খেউড়) :- 

তখনকার দিনে নবমীতে পাঁঠা বলি দেওয়ার প্রথা ছিল। পাঁঠা ,মোষ ইত্যাদি বলি দেওয়ার পর গায়ে রক্ত কাদা মেখে মোষের কাটা মুন্ডু মাথায় নিয়ে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে অতি অশ্লীল ও অশ্রাব্য ভাষায় গান গাইতো বৃদ্ধ থেকে জোয়ান সকলে। বাড়ির মেয়েদের সামনেও এই গান গাওয়া হতো।পাছে ভুলে যায় সেজন্য সঙ্গে খাতা নিয়ে ঘুরতেন এরা।পরবর্তীতে কেশব সেন মহাশয়ের প্রভাবে এসব বন্ধ হয়ে যায়।

তরজা গান :-  

সেকালের কলকাতায় তরজা গান খুব জনপ্রিয় ছিল। তরজাওয়ালারা রেগে গেলে খুব অশ্লীল ভাষায় গান গাইতো,বাকী সময়ে খুব ভক্তি ভরে গান গাইতো। অনেক তরজা গানে ভাব ছন্দ ও অলংকারের ব্যবহার ছিল। বেশিরভাগ ছন্দ চৌদ্দ অক্ষরের পয়ার, লঘু ও দীর্ঘ তৃপদীতে লেখা হতো। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়  ...

"আমার নামটি কৃতী, তরজা বৃত্তি ,হাতিবাগানে বাড়ি
কখনো বেচি নারকেল তেল, কখনো তরজায় লড়ি .."

তরজাওয়ালাদের চলতি পুরান জানা থাকতো, তাই প্রতিপক্ষ চাপান দিলে অর্থাৎ প্রশ্ন করলে চটপট উত্তর দিতে পারতো। তরজাওয়ালাদের চেয়ে কবিয়ালদের ভাব,ভাষাজ্ঞান,তাললয়ের বোধ অনেক বেশি সমৃদ্ধ ছিল। 

বাচের গান :-

মূলত নদীতে বাচ টানার প্রতিযোগিতার সময় এই গান গাওয়া হতো। দাঁড় টানার তালে তালে সুর মিলিয়ে এই গান গাওয়া হতো।যেমন .... 

"নতুন কান্ডারি হরি, ঢেউ দিও না গায়, 
সব সখীকে পার করিতে নেব আনা আনা 
শ্রীরাধাকে পার করিতে নেব কানের সোনা"

সেকালের কেষ্ট যাত্রাগুলিতেও এইসব গানের প্রচলন ছিল । 

এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের যাত্রা ও গান সেকালের কলকাতায় প্রচলিত ছিল যা আজ সংরক্ষণ ও চর্চার অভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ডিস্কো, ডিজে আর ভিজে বেড়ালের আধুনিক প্রজন্মের কলকতাবাসীদের কাছে হয়তো এগুলো, সেকেলে ও মূল্যহীন। কিন্তু আমার আপনার মতো যারা পুরোনো কলকাতার সোঁদা বাতাসের গন্ধে নস্টালজিক হতে চান তাদের জন্য মেলে ধরলাম একটু পুরোনো কলকাতা ।। 



কৃতজ্ঞতা :-১.কলিকাতার পুরানো কাহিনী ও কথা,মহেন্দ্র নাথ দত্ত, ২.নাজিবুল হাসান, বেলঘরিয়া

No comments