Header Ads

বাংলার মানুষের সামাজিক কল্যাণে অভিনব কায়দায় একনাগাড়ে কাজ করে সাফল্যের পথ দেখালো 'স্মরণ'

যারা বলে বাঙালিরা দুর্বল। যারা বলে বাঙালিরা অলস। যারা বলে বাঙালিরা সমাজের জন্য কিছুই করেনা। তাদের সবার প্রথমে চোখ রাখতে হবে বাংলার বুকে গড়ে ওঠা কয়েকটি ননপ্রফিট অরগানাইজেশানগুলোর দিকে। যারা বাঙালি সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে ভেঙ্গে দিয়েছে। কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ারিং দুঃস্থ বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীরা নিজের হাতখরচ বাঁচিয়ে ২০১৭ সালে জন্ম দিয়েছেন 'স্মরণ' বলে একটি প্রতিষ্ঠানের। যাদের লক্ষ্য সমাজের জন্য কিছু করে যাওয়া। দেখতে দেখতে প্রায় তিনটে বছর অতিক্রম করে ফেলেছে তারা। তাদের উঠে দাঁড়ানোর লড়াইটা ছিল বেশ কঠিন। দুর্গম গিরি দুস্তর পারাপারের মতোই শক্ত ছিল তাদের এগিয়ে যাওয়ার গল্পটা।


গত বছর একগুচ্ছ কর্মসূচীর মাধ্যমে রাজ্যের বিভিন্ন মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে স্মরণ। অসংখ্য পত্র-পত্রিকাতে তাদের নিয়ে লেখালেখিও শুরু হয়। বর্তমানে তাদের প্রত্যেকটি কর্মসূচী নিয়ে বড় বড় সংবাদপত্রে খবর বের হয়। এমনকি মাঝে মধ্যে টিভিতেও তাদের খবরের দেখা মেলে। গরীব, দুঃস্থ, আর্তপীড়িত, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের মুখে হাসি ফোটাতে তারা বদ্ধপরিকর। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিকল্পনা মাফিক একের পর এক উদ্যোগ নিয়ে রীতিমতো সাড়ি জাগিয়েছে তারা। ২০১৭ তে বাঁকুড়া শহরে শীতের রাতে রাস্তার ধারে বসবাস করা আর্তপীড়িত-অসহায় মানুষদের কম্বল, কেক ও মশারি বিতরণের মাধ্যমে 'স্মরণে'র প্রথম কর্মসূচী নেওয়া হয়।  

২০১৯ সালে নতুন ভাবনাতে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় জেলায় অসংখ্য মহৎ উদ্যোগের মাধ্যমে 'স্মরণ' কাজ করেছে। যেমন পুরুলিয়ার আদ্রাতে ইচ্ছড় হাইস্কুলের দরিদ্র মেধাবী ছাত্রী দীপ্তি সিংহ যার মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বর ৫৯৪, তার হাতে 'স্মরণ' তুলে দেয় নতুন গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নের টেক্সট বই ও বাংলা ইংরেজি সহায়িকা বই, নোটবুক, মিষ্টির প্যাকেট, ট্রফি ও এককালীন কিছু অনুদান। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশিয়াড়ীর খাজড়া সতিশ চন্দ্র মেমোরিয়াল হাইস্কুলের দরিদ্র মেধাবী ছাত্রী ও এ বছরের মাধ্যমিক উত্তীর্ণ সাথী গিরি যার প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৫৮৮ তার হাতেও একই ভাবে কিছু সাহায্যের হাত বাড়ায় তারা। এরপর শুভজিৎ সার অর্থাৎ যিনি না থাকলে এই প্রতিষ্ঠানটা গড়ে উঠতো না, সেই শুভজিৎ সারের মায়ের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে বাঁকুড়ার হাড়মাসড়াতে যাযাবর শিশু ও তাদের পরিবারকে ভুরিভোজ করানো হয় ও তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় খাতা, পেন, পেন্সিল ও কিছু চারাগাছ। শুভজিৎ সারের জন্মদিনে বাঁকুড়ার হাড়মাসড়া এলাকার পাশ্ববর্তী পাঁচটি গ্রামের একেবারে দরিদ্র কিছু মানুষদের শণাক্ত করে তাদের কম্বল ও চারাগাছ বিতরণ করা হয়। 

দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বুনিয়াদপুরে বড়াইল আশ্রমে করুণ অবস্থায় চব্বিশ জন বাচ্চার কষ্টে দিন কাটছিল। এই ছোটো ছোটো বাচ্চাদের কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে 'স্মরণ' ওদের হাতে তুলে দেয় কম্বল, জামাকাপড়, গল্পের বই, লাফ দড়ি, বর্ণ পরিচয়। এরপর পুরুলিয়ার বরাবাজার সংলগ্ন দুই শবর পাড়াতে নতুন বস্ত্র বিতরণ, বিনামূল্যে চিকিৎসা শিবিরের আয়োজন ও স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করা হয়। এর পাশাপাশি ডাইনি প্রথা, ঝাড় ফুঁক না করিয়ে সাপে কামড়ালে হাসপাতালে যাওয়া, বাল্যবিবাহ রোধ, ধর্মীয় পশুবলি প্রভৃতি সম্পর্কে সচেতনতা শিবিরেরও আয়োজন করা হয়। পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডিতে বিড়হর উপজাতিদের বাসস্থান ভূপতি পল্লীতে আয়োজন করা হয় বিনে পয়সার বাজারের। যেখানে প্রায় সাড়ে চারশো মানুষ বস্ত্র সংগ্রহ করেন। এরপর দুগ্ধ দিবস উপলক্ষ্যে জামসেদপুরের ঘোড়াবাঁধা সহ বেশ কিছু বস্তিতে 'স্মরণে'র সদস্য আত্রেয়ী কুন্ডুর নেতৃত্বে দুঃস্থ মানুষদের ত্রিশ লিটার দুধ বিতরণ করা হয়। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে পরিবেশের বার্তা দিয়ে স্মরণের তরফে বাঁকুড়ার বিভিন্ন জায়গাতে চৌত্রিশ থেকে চল্লিশটি বৃক্ষরোপণ করা হয়। প্রতিটি বৃক্ষের নাম রাখা হয় স্মরণ গাছ। 

এমনকি ২০১৮ সাল থেকে পশুবলি বন্ধের চেষ্টায় একনাগাড়ে কাজ করে চলেছে টিম 'স্মরণ'। তাদের সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় সতেরো থেকে আঠারোটির মতো জায়গাতে বন্ধ হয়েছে পশুবলি। যে এলাকাগুলোতে আজকে পশুবলির বদলে আখ, চাল কুমড়ো বলি হয়। এ কাজটি করার পিছনে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাদের। ২০১৯ সালে আরো বেশ কয়েক কর্মকাণ্ডের সাথে তারা যুক্ত ছিলেন যেমন স্বাধীনতা দিবসে সম্প্রীতির রাখীবন্ধন ও স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা হয়। আরো অনেক কর্মসূচীর কথা রয়েছে যেগুলো বলতে গেলে অনেকটা সময় কেটে যেতে পারে। 

মানুষের অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা, দুঃস্থ মানুষদের মুখে হাসি ফোটানো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, পরিবেশ রক্ষা, সচেতনতা শিবির ও মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে উন্নত করে তোলার জন্য 'স্মরণে'র এমন উদ্যোগগুলো সত্যিই প্রশংসনীয়।আগামীদিনে হাজারো কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে সমাজের কাছে সাক্ষী থাকবে 'স্মরণ'। 

খুব শীঘ্রই দুঃস্থ মেধাবী ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়াদের জন্য 'স্মরণে'র উদ্যোগে সিভিল ও মেকানিক্যাল ডিপ্লোমা ছাত্রদের জন্য পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথমবার বিনামূল্যে কোচিং সেন্টার স্থাপিত হতে চলেছে। টিম 'স্মরণে'র  নেপথ্যে রয়েছেন যে মানুষগুলো তারা হলেন বাঁকুড়া জেলার রাধানগরনিবাসী মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তুষার মুখোপাধ্যায়, বাঁকুড়ার কাটজুড়িডাঙ্গানিবাসী প্রজেক্ট সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শুভজিৎ সার, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরনিবাসী পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দক্ষিণ ২৪ পরগণার রায়দিঘী এলাকার স্টাফ নার্স রুম্পা মন্ডল, পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল শহরের ভারতীয় রেলওয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট লোকো পাইলট শ্রীকান্ত মাজি এবং বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর শহরের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তিস্তা খাঁ।   
         
প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments