Header Ads

বাংলার গোপালকে কী বাঙালির মনে আছে?


আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে এই বাংলাতেও একজন ‘গোপাল’ থাকতেন। এই গোপালও ছিলেন রক্ষাকর্তা। বাংলাকে অরাজকতার হাত থেকে বাঁচিয়ে শান্তি রক্ষা করেছিলেন। আজ আমরা বাংলার এই গোপাল সম্পর্কেই দু’-চার কথা আলোচনা করব। প্রসঙ্গত, এই গোপাল ছিলেন বাংলার এক  বিখ্যাত রাজা।


গোপাল ছিলেন বাংলার ইতিহাসের বিখ্যাত ‘পাল’ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। পাল রাজাদের নামের শেষে ‘পাল’ পদবী থাকত। আজও ‘পাল’ পদবীধারী বহু বাঙালিকেই দেখা যায়। এই ‘পাল’ শব্দটির অর্থ হল ‘রক্ষাকর্তা’- অর্থাৎ যিনি রক্ষা করেন। পাল বংশ কারা? তাদের উৎপত্তি কোথায়? অর্থাৎ তাদের প্রকৃত বা সঠিক জাতি পরিচয় জানা যায় না। বিখ্যাত গৌড়রাজ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর প্রায় শতাব্দীকাল বঙ্গদেশে ঘোর অরাজকতা চলেছিল। এর সাথে চলছিল গৃহবিবাদ। সে যুগ ছিল ঘোর অরাজকতা ও গৃহবিবাদের যুগ।এই যুগকে বাংলার ইতিহাসে ‘মাৎস্যন্যায়’ যুগ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মাছেদের মধ্যে যেমন বড়ো মাছেরা ছোট মাছেদের গিলে খায় ঠিক তেমনি সমাজের শক্তিমানেরা দুর্বলদের উপর নিরন্তর অত্যাচার চালিয়ে, শোষণ করে যেন ‘গিলে ফেলছিল’। তাই, বলা হচ্ছে ‘মাৎস্যন্যায়’ যার মানে হল মাছেদের মতো। এই অত্যাচারের ফলে বঙ্গদেশের জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশার শেষ ছিল না। প্রবলদের অত্যাচারে দুর্বলদের জীবন অসহায় হয়ে উঠেছিল। বঙ্গের এই অরাজকতার কথা জানা যায় তিব্বতী বৌদ্ধ পণ্ডিত তারানাথ ও খালিমপুর তাম্রলিপির বয়ানে। এই অরাজকতা বঙ্গদেশের অর্থনীতিতেও কুপ্রভাব ফেলেছিল। এই অরাজকতার ফলে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য বিপদের মুখে পড়েছিল এবং রৌপ্যমুদ্রার আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। 

তৎকালীন বাংলার প্রধান বন্দর তাম্রলিপ্তও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গদেশকে এই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার থেকে বাঁচাতে বা দুর্দিন থেকে রক্ষা করার জন্য বাংলার বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ বা প্রধান নাগরিকবৃন্দ যাঁদের ‘প্রকৃতিপুঞ্জ’ বলা হত তাঁরা ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে গোপাল নামক এক স্থানীয়, জনপ্রিয় সামন্ত নেতাকে রাজপদের জন্যে নির্বাচিত করেন। বলাবাহুল্য, এই নির্বাচন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হয়েছিল যা তৎকালীন বাংলা বা ভারতের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা বলা যায়। তবে কারা নির্বাচন করেছিলেন সে বিষয়ে অনেকেই ধন্দে আছেন কেননা উল্লেখিত ‘প্রকৃত’ শব্দটির অর্থ প্রজাও হতে পারে আবার প্রধান আমাত্য বা মন্ত্রীও হতে পারে। যাইহোক, রাজা গোপালও রাজ্যে শান্তিস্থাপন করে তাঁকে নির্বাচন করার সার্থকতা রেখেছিলেন। আসলে তিনি একজন যোদ্ধার ছেলে আর তাই ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী সৈনিক। এরফলে, অরাজকতা সৃষ্টিকারী সমস্ত অশুভ শক্তিকে উৎক্ষাত করে  রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন করেছিলেন। রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনের এই  প্রাথমিক সাফল্যের জন্যে তিনি প্রচুর জনসমর্থনও পেয়েছিলেন।

মহারাজ গোপাল ও তাঁর বংশধরদের শাসনকালকে ইতিহাসের পাতায় ‘পালবংশীয় শাসন’ বলা হয়ে থাকে। তবে গোপালের শাসনকাল এমনকি জাতি-পরিচয় সম্পর্কে সঠিকভাবে বা বিশেষভাবে কিছু জানা যায় না। গোপালের পুত্র ধর্মপালের রাজত্বের ৩৪তম বর্ষে খালিমপুর তাম্রলিপি রচনা করা হয়েছিল। এই তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, গোপালের পিতা ছিলেন ব্যপট নামে এক যোদ্ধা যাঁকে শত্রু ধ্বংসকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং পিতামহ ছিলেন ‘সর্ববিদ্যাশুদ্ধ’ বা ‘সর্ববিদ্যা-বিশুদ্ধ’ পণ্ডিত দয়িতবিষ্ণু। তাই, ঐতিহাসিকদের মতে পাল রাজা গোপাল খুব সম্ভবত জাতিতে ক্ষত্রিয় ছিলেন। বৌদ্ধ তিব্বতী পণ্ডিত তারানাথের  মতে গোপাল ছিলেন গোঁড়া বৌদ্ধ এবং ওদন্তপুরী মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সান্ধ্যকর নন্দী ছিলেন পাল সভাকবি যিনি বিখ্যাত ‘রামচরিত’ রচনা করেছিলেন। তা এই ‘রামচরিত’ কাব্যে পাল রাজাদের ‘সমুদ্রকুলোদ্ভূত’ বলা হয়েছে। আবার, এই রামচরিত কাব্যে লেখা আছে যে  উত্তরবঙ্গ বা বরেন্দ্রভূমি হল পাল রাজাদের পিতৃভূমি বা জনকভূ। এর থেকে ধারণা করা হয়ে থাকে যে উত্তরবঙ্গে পাল রাজারা তাঁদের আদি রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। তবে, আবুল ফজল তাঁর গ্রন্থে পাল রাজাদের জাতিতে কায়স্থ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে, এইটুকু জানা গেছে যে, পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী বা অনুরক্ত ছিলেন। ওদন্তপুরীর মতো নালন্দায়ও রাজা গোপাল একটি বৌদ্ধ মঠ  প্রতিষ্ঠা করেন। 

গোপালের রাজত্বকাল এবং তাঁর রাজ্য কতদূর বিস্তৃত সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা না গেলেও এইটুকু জানা গেছে যে গোটা বঙ্গদেশকেই তিনি অধিকার করতে পেরেছিলেন। ‘আর্য-মঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, পাল রাজা গোপালের উত্থান হয়েছিল পরবর্তীকালে গুপ্তদের অধীনে থাকা গৌড় রাজ্য এবং উত্তর-পশ্চিম বাংলায়। বাংলার  উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তিনি রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন। তারনাথ পণ্ডিত উল্লেখ করেছেন যে গোপাল মগধ বা দক্ষিণ বিহারও জয় করেছিলেন। আবার, ‘আর্য-মঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ গ্রন্থটিতে যে  উল্লিখিত ‘গৌড়তন্ত্র’-এর উল্লেখ আছে তার মধ্যে  মগধও ছিল। তাহলে আমরা বলতে পারি যে, পাল রাজা গোপাল দক্ষিণ বিহারও জয় করেছিলেন।খুব সম্ভবত রাজা গোপাল ৭৭০ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ কুড়ি বছর বঙ্গদেশ রাজত্ব করেছিলেন। আবার,অনেকের মতে তিনি ৭৫৬ থেকে ৭৮১ খ্রিস্টাব্দ এই পঁচিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। গোপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ধর্মপাল বঙ্গদেশ রাজত্ব করেছিলেন। ধর্মপালও একজন দিগ্বিজয়ী হয়ে তাঁর পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠেছিলেন। পাল রাজা গোপালকে ‘প্রথম গোপাল’-ও বলা হয়ে থাকে। ইনি সত্যিই বাংলার গোপাল যিনি বাংলাকে অরাজকতায় হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।

No comments