সম্পর্কের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রহস্য ৷ 'শব্দজব্দ' এ বন্দী এখন হইচই
কাছের মানুষও অনেক সময় ষড়যন্ত্র করে দূরে সরে যেতে চায়৷ এমন ঘটনা আজকাল বেড়েই চলেছে। কাছের মানুষের ষড়যন্ত্রে জীবনে বিপর্যয় নেমে আসার পর তাকে প্রতিহত করার গল্পে মজেছে এখন হইচই। মুক্তি পেয়েছে নতুন বাংলা ওয়েব সিরিজ 'শব্দজব্দ'। চেনা গল্প থেকে বেরিয়ে একদম নতুন কিছু বানানোর চেষ্টা করেছেন পরিচালক সৌরভ চক্রবর্তী। যিনি এর আগে 'কার্টুন' ও 'ধানবাদ ব্লুজ' নামের দুটি ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি একটু ভিন্নধর্মী গল্প নিয়ে কাজ করতেই বেশি পছন্দ করেন। 'শব্দজব্দ' হলো একটি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারধর্মী সিরিজ।
এই সিরিজের গল্প বেশ আকর্ষণীয়। সৌগত সিনহা যিনি একজন লেখক। যিনি মৃত্যু নিয়ে লেখালেখি করতে বেশি পছন্দ করেন। তিনি বিয়ের পর থেকে আমেরিকাতে স্ত্রী অদিতি ও মেয়ে রাকার সাথে থাকেন। তিনি বহু বছর পর কলকাতায় আসেন। তারপর বন্ধু অমিতাভের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। সৌগত নিজের হাতে গাড়ি চালিয়ে অমিতাভের বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ গাড়ির সামনের কাচে অচেনা একটা মেয়ে লাফিয়ে পড়ে। সৌগত ভয় পেয়ে যায়। গাড়ি থেকে নেমে দেখে যে চারপাশে কোথাও কেউ নেই। এরপর সৌগতের মাথায় একই ঘটনা ঘুরপাক খেতে থাকে। একদিন হোটেলে সৌগত নৈশ্যভোজ করার আগে মদ্যপান করতে গিয়ে গাড়ির ওপর লাফিয়ে পড়া অচেনা মেয়েটিকে দেখতে পায়। যাকে সৌগত ছাড়া আর কেউ দেখতে পেলেন না। আর একদিন নিজের ফ্ল্যাটের মধ্যে মেয়েটির সাথে তিনি রাত কাটান। মেয়েটি জানায় সে নাকি সুলগ্না৷ সৌগতর পুরানো প্রেমিকা নাকি সুলগ্না। তার ছেলেবেলার বন্ধু কানাইও নাকি সুলগ্নাকে ভালোবাসত৷ সৌগত কানাইকে সহ্য করতে না পেরে নাকি তাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল। সৌগত এ কথা বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি নিজের পুরানো প্রেমের কথা কিছুতেই স্মরণ করতে পারলেন না। সৌগতের মন ঠিক করবার জন্য বন্ধু অভিতাভ সৌগত, সৌগতের স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে দার্জিলিং এ যান। সেখানে শহর থেকে দূরে সবুজ ঘন জঙ্গলে ঘেরা একটি বাঙলোতে তারা আশ্রয় নেন। এখানেই ঘটতে থাকে বেশ কিছু অশরীরী ঘটনা। সৌগত জঙ্গলে একলা ঘুরতে গিয়ে দেখতে পান কয়েকটি কবরস্থানের পাশে বাথটবে একটি অশরীরী নারী যার মুখের অর্ধেকটা পুড়ে গেছে সে বড় বড় চোখ করে সৌগতের দিকে তাকিয়ে বসে আছে৷ সৌগত এ দৃশ্যের কথা অভিতাভকে জানান। যদিও অভিতাভ এ কথা বিশ্বাস করেননি। তার স্ত্রী অদিতিও বিশ্বাস করলেন না এ কথা। সৌগত কেমন যেন হয়ে উঠলেন। হারিয়ে ফেলতে লাগলেন লেখার ক্ষমতা। তিনি বুঝতে পারলেন যে তিনি হ্যালুসিনেশনে ভুগছেন৷ এছাড়াও তিনি পুরানো কথা সব ভুলে যাচ্ছেন। তার এই রোগের প্রকোপ যাতে পরিবারের কারোর ওপর না পড়ে সে বিষয়েও তিনি চিন্তিত। জীবনটা তার এভাবেই ক্রমশ জটিল হয়ে উঠতে থাকে।
সৌগত ঠিকমতো রাতে ঘুমোতে পারেননা। প্রতিদিন চোখের সামনে কিছু অশরীরী ঘটনা ঘটতে থাকে৷ সৌগতের পাশাপাশি অদিতিও সম্মুখীন হলেন অশরীরী ঘটনার মুখোমুখি। বাথরুমের কমোটে তিনি টকটকে লাল রক্ত দেখতে পান। এমনকি কখনো কখনো পোড়া শরীরে কানাইকে তিনি দেখতে পান। তাদের মেয়ে যাতে এ কথা না জানতে পারে তারা দুজনে সব গোপন করতে শুরু করেন। সৌগত ও অদিতির পাশাপাশি অমিতাভও একদিন অশরীরী ঘটনা চাক্ষুষ করেন। কনের সাজে কমবয়সী একজন মহিলা গলায় দড়ি পরে ঝুলছে। চোখের একটা অংশ পুড়ে গেছে। তার চোখের ওপর কে যেন একটা কাঁটা চামচ বসিয়ে দিয়েছে। তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। যদিও তিনি এ দৃশ্য কাউকে জানালেন না। তিনি বিশেষ কারণ দেখিয়ে কলকাতা রওনা হন। তাকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে যান সৌগত ও রাকা। বাঙলোতে অদিতি একা রইলেন। হঠাৎ কানাইকে তিনি দেখতে পেলেন। এরপর ঠিক কী হয়েছিল? ওটা লেখার প্রয়োজন নেই। কারণ ক্লাইম্যাক্সের শুরু তো এখান থেকেই ৷
গল্পের মধ্যে ঘুরতে থাকা অশরীরী ঘটনাগুলো কী আদৌ সত্য নাকি সাজানো? তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় সিরিজের শেষ পর্বে। হাজারো অশরীরী ঘটনার পর জানা যাবে যে আসলে ওগুলো সব সাজানো ঘটনা ছিল। অমিতাভের সাথে অদিতির সম্পর্ক ছিল৷ অদিতি মেয়ে রাকাকে সৌগতের কাছে রেখে গিয়ে অমিতাভের সাথে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সৌগতের সাথে জীবন কাটাতে অদিতির ভালো লাগছিল না। শেষমেশ অদিতি অমিতাভের সাথে পালিয়ে যেতে ব্যর্থ হন। ঠিক কীভাবে তিনি ব্যর্থ হলেন? এর নেপথ্যে কোন কাহিনী লুকিয়ে আছে? গল্পের আসল রহস্য এখানেই। যেটা বলে ফেললে গল্পের মজা খানিকটা কমে যেতে পারে৷ তাই ওটা আর আলাদা করে বলার দরকার নেই।
এই বিশেষ সিরিজের গল্প গুছিয়ে বর্ননা করা বেশ কঠিন। যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সাথে পর্দায় উপস্থাপন করা হয়েছে গল্পটিকে। 'শব্দজব্দ' সিরিজটি অন্যান্য সিরিজগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
সিরিজটির আবহ সঙ্গীত, ড্রোণ শর্টস, দৃশ্য নির্ধারণ ও সম্পাদনা বেশ উন্নতমানের৷ এই সিরিজটিকে একটি আন্তর্জাতিক লুক দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। দার্জিলিং কে একদম অন্যভাবে দেখানো হয়েছে ছবিতে। যা দেখলে আপনার মনে হতে পারে হয়তো এটা বিদেশের কোনো জায়গা। ফ্রেম টু ফ্রেম প্রতিটি দৃশ্যের পিছনের সাজসজ্জা ও ক্যামেরার কাজ মুগ্ধ করার মতো। সিরিজের প্রতিটি পর্ব আপনাকে টানটান উত্তেজনার ভিত্তিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বসিয়ে রাখবে। সিরিজে 'বোবা পাহাড়' বলে একটি গান রয়েছে। যে গানটি গল্পের সাথে একদম খাপে খাপ মিলে যায়। এই সিরিজটির সবচেয়ে বড়ো পাওনা হলো 'শব্দজব্দ' এর মতো এমন সাবলীল চিত্রনাট্য ও কথোপকথন বাংলা ওয়েব সিরিজে এর আগে খুব কম লেখা হয়েছে।
গল্প, চিত্রনাট্য, ক্যামেরা, সম্পাদনা, আবহ সঙ্গীত নিয়ে অনেক কথা হলো। এবার একটু অভিনয় নিয়ে কথা বলা যাক। সৌগতের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রজত কাপুর। অদিতির চরিত্রে পায়েল সরকার। রাকার চরিত্রে সালোনি পান্ডে। অমিতাভের চরিত্রে সুব্রত দত্ত। সুলগ্নার চরিত্রে মুমতাজ সরকার ও কানাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন কৌশিক রায়। রজত কাপুর, পায়েল সরকার, সালোনি পান্ডে, মুমতাজ সরকার, সুব্রত দত্ত প্রত্যেকেই দূর্দান্ত অভিনয় করেছেন। কিন্তু এদের সবার অভিনয়কে ছাপিয়ে গেছে কৌশিক রায়ের হাড়কাঁপানো অভিনয়। ঠান্ডা গলায় গা ছমছমে চরিত্রও যে তুলে ধরা সম্ভব এই প্রথমবার তার প্রমাণ দিলেন কৌশিক রায়।
'শব্দজব্দ' সিরিজটি বহুদিন পর্যন্ত মনে রাখার মতো সিরিজ৷ চারটে থেকে পাঁচটা চরিত্র নিয়েও যে পর্দায় কত ভালো গল্প বলা যায় তার আভাস দিলেন পরিচালক সৌরভ চক্রবর্তী। আগের দুটো সিরিজের পর নিজের মিথকে কিছুটা ভেঙ্গে তিনি নতুন করে এ সিরিজটা নির্মাণ করেছেন। যারা বাংলা ওয়েব সিরিজ দেখতে ভালোবাসেন তাদের জন্য একটা নজরকাড়া ওয়েব সিরিজ হলো 'শব্দজব্দ'। হইচই অ্যাপে আপনার প্রিয়জনদের সাথে আজই দেখে ফেলুন এই ওয়েব সিরিজ।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment