Header Ads

দেশপ্রিয় পার্কে যাদের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে খাঁচায় বন্দী হয়ে


দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের নাম শুনেছেন? নিশ্চয়ই শুনেছেন। হয়তো বা গেছেনও সেখানে রাজ্যের উচ্চতম দুর্গা ঠাকুর দেখতে! যার নামে পার্কের নামকরণ, সেই প্রখ্যাত ব্যারিস্টার কাম কংগ্রেস নেতা দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তর আবক্ষ মূর্তি রয়েছে এখানে। বেদী মূলে লেখাও আছে তাদের পরিচয়, কিন্তু পাশে আরও দুটি কাদের মূর্তি? কিছু একটা লেখা হয়তো ছিল কোনদিন, সময়ের কশাঘাতে আজ তা ঝাপসা। মুছে যাবে হয়তো একদিন আর নামগোত্র হীন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে শুধুই দুটি মর্মর মূর্তি।এ ভাবেই বুঝি হারিয়ে যায় ইতিহাস। মুছে যায় স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপকথার গল্পের মতো বাস্তব আলেখ্য।


ইতিহাসের কি নিষ্ঠুর পরিহাস.....যারা একদিন দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচন করতে নিজেদের জীবন বাজি রেখেছিলেন, আজ তাদের মূর্তিই কিনা দাঁড়িয়ে আছে খাঁচায় বন্দী হয়ে! চারিদিকে এত নীলসাদা রঙ, এতো ত্রিফলা বাতির সমারোহ, তার মাঝে বিবর্ণ ও অনালোকিত। বড়োই বেমানান। 

দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহনকে প্রতি বছর জুলাইয়ে তাঁর প্রয়াণদিবসে স্মরণ করে রাজ্য সরকার। সেই অনুষ্ঠানে অনেকটা ফাউ হিসাবে রজনীগন্ধার মালা ঝোলে ঐ দুই মূর্তির গলায় আর খাঁচার গায়েও। শুকনো হতে হতে ঝরে যায় একদিন ফুলমালা, ফিরেও তাকায় না কেউ !

মূর্তির একজন বিপ্লবী অনিল চন্দ্র দাস, যার কথা শোনাবো অন্য কোনদিন। কিন্তু আরেকজন.......?

কুমিল্লার ছেলে অসিত রঞ্জন ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৫ সালের ৪ঠা এপ্রিল। বাবা ক্ষীরোদ রঞ্জন ছিলেন স্কুল শিক্ষক এবং স্বদেশীয়ানায় বিশ্বাসী। কুমিল্লা কলেজে পড়ার সময়ই অনুশীলন সমিতির সংস্পর্শে আসেন অসিত। বিশ্বাস করতে শুরু করেন সশস্ত্র আন্দোলনই দেশের স্বাধীনতা অর্জনের একমাত্র উপায়। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ আসবে কোথা থেকে? তারজন্য তো টাকা লাগবে ! করতে হবে ডাকাতি। সরকার এবং ধনী মহাজনদের কাছ থেকে লুট করা অর্থই লাগানো হবে এই কাজে। 

কবি সুকান্তের 'রানার' বা তারাশঙ্করের 'ডাকহরকরা' পড়েছেন আশা করি। একশো বছর আগে এরাই ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। শহর বা গঞ্জের বড় পোস্টাপিস থেকে চিঠিপত্র, টাকাকড়ি  বয়ে নিয়ে যেতো গ্রামের ছোট ডাকঘরে।‌ 

১৩ই মার্চ ১৯৩৩, শ্রীহট্ট হবিগঞ্জের ইটাখোলা বড় ডাকঘর থেকে বেরিয়েছে এমনই এক হরকরা। কাঁধে ডাকের ঝোলা, একহাতে বল্লম তাতে বাঁধা ঘুঙুর। সবে সূর্যাস্ত হয়েছে তখন। কিছুদূর যেতে না যেতেই পাঁচ জনের একটি দল তার ডাকব্যাগটি কেড়ে নিয়ে ছুট.....! চীৎকার শুনে লোকজন পিছু নেয় তাদের। একটু পরেই তাদের ঘিরে ফেলে ধাওয়া করে আসা মানুষ। উৎসাহী একজন বল্লমটি ছুঁড়ে মারে স্বদেশীদের লক্ষ্য করে, পায়ে বেঁধে একজনের। বেগতিক দেখে তাদের একজন সঙ্গের রিভলবার থেকে গুলি চালালে লুটিয়ে পড়ে এক গ্রামবাসী।অবাঞ্ছিত এই ঘটনায় যখন সবাই হতচকিত, তখনই ধরা পড়ে যায় পাঁচজন। ততক্ষণে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছে স্থানীয় থানার পুলিশ।

বিচারে বাকি সবাইয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ হলেও অসিতকে দেওয়া হলো মৃত্যুদণ্ড। গুলিটা যেহেতু উনিই চালিয়েছিলেন। ২রা জুলাই ১৯৩৪, শ্রীহট্ট জেলে ফাঁসি হয়ে যায় বাংলা মায়ের এই দামাল ছেলের। সমগ্র বরাক উপত্যকায় এবং ওই জেলে সেটাই প্রথম ফাঁসি।

প্রসঙ্গত অসিত ভূষনের দাদা বিধুভূষণ ভট্টচার্য, মাস্টারদা সূর্য সেনের ইণ্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি-র সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ২২ শে এপ্রিল ১৯৩০ সালে জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশ সেনার বিরুদ্ধে লড়াই করে টেগরা, মতি কানুনগো, প্রভাস বল প্রমুখ বিপ্লবীদের সঙ্গে তিনিও আত্মাহুতি দেন। 

সে দিনের দুই দস্যি ছেলে অসিত আর অনিলের কথা এই প্রজন্মের কেউ জানে না। পালন হয় না ওঁদের জন্মদিন-মৃত্যুদিন। অচেনা এই বিপ্লবীদের চেনানোর কোনও দায় কি  আমাদের নেই? 

সংকলনে- স্বপন সেন ও অভীক মন্ডল

তথ্যসূত্র: অগ্নিযুগের ফাঁসি ‌

No comments