Header Ads

"তুমি কি কেবলি ছবি"। প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকে


"রূপে লক্ষ্মী গুনে সরস্বতী" কথাটি বোধহয় তাঁর নামের সঙ্গে সমার্থক। তাঁর ছবি দেখতে দেখতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলে উঠেছি .... তুমি কেবলি ছবি, পটে আঁকা ..."। তাঁর জন্যই বাঙালী গুনগুনিয়ে উঠেছে ...."আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে/ সাত সাগর আর তেরো নদীর পারে"। তিনি চিরযৌবনা, তিনি সম্ভ্রান্ত সৌন্দর্য্যের (Dignified beauty ) চরম পরাকাষ্ঠা.... আসলে এইসব তুচ্ছ বিশেষণে তাঁর ছবি আঁকা যায় না। কারণ তিনি যে বাঙালীর হার্ট থ্রব- মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। বাংলা থেকে হিন্দি ভারতীয় সিনেমাপ্রেমীদের হৃদয় তিনি চিরতরে চুরি করেছেন। মূলত পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মুক্তি পাওয়া তাঁর অভিনীত সাদা কালো ছবিগুলি আজও মন ছুঁয়ে যায়। 


১৯৩১ সালের ৬ ই এপ্রিল পাবনায় জন্ম হয় পেশায় স্কুল শিক্ষক করুনাময় দাশগুপ্তের তৃতীয় কন্যা রমা দাশগুপ্তের। মাত্র সতেরো বছর বয়সে ১৯৪৭ সালে শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিবাহ হয় তাঁর। বিয়ের পর একা রমা আরো বেশি একা হয়ে পড়েন নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এবং এই একাকীত্বই একসময় তাঁর অভিনয় জগতে প্রবেশের ইন্ধন হিসেবে কাজ করে। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা সুচিত্রাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিতে চায় তাদের নাটকে। ‘নটীর পুজা’ নাটকে প্রথম অভিনয় করলেন এবং সেই সুখ্যাতি পৌঁছুলো টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায়। প্রধানত শ্বশুরের উৎসাহেই সিনেমায় নামলেন রমা সেন।

প্রথমে নেপথ্য গায়িকা হবার জন্যই গেলেন স্টুডিওতে, কিন্তু এই রূপসীকে পর্দার পেছনে রাখার মতো ভুল করেননি রুপোলি পর্দার লোকেরা! বারবার রমা মুখ ফিরিয়ে নিলেও পরিচালকেরা একবার তাঁর খোঁজ পেয়ে যাবার পর তাঁকে আর ছাড়েন কী করে? ১৯৫২ সালে প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’ দিয়ে শুরু। কিন্তু কিছুদিন অভিনয়ের পর অর্থাভাবে তা বন্ধ হয়ে গেলো। কখনোই মুক্তি পেলো না।

এরপর সুকুমার দাশগুপ্তর ‘সাত নম্বর কয়েদী’ সিনেমা থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত হলেন রমা। না, এখন আর রমা নয়, সুকুমার দাশগুপ্তর সহকারী নীতীশ রায় তার নাম দিলেন সুচিত্রা। তিনি হয়ে উঠলেন 'সুচিত্রা সেন'। এর পরের ছবি অর্থাৎ নীরেন লাহিড়ীর ‘কাজরী’ ছবির মাধ্যমে রমা সেন পাল্টিয়ে ‘সুচিত্রা সেন' নামে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। তার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি, বাকিটা ইতিহাস। একের পর এক ছবি এবং একের পর এক সুপার ডুপার হিট। আর 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবির মধ্য দিয়ে বাঙালি খুঁজে পেল উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে। বাঙালী নানা রূপে উপভোগ করেছেন এই জুটিকে , বাঙালীর রোমান্টিকতায় নতুন মাত্রা এনেছে এই জুটি। বাঙালির প্রেমের আইকন হয়ে উঠলো রূপলী পর্দার 'উত্তম-সুচিত্রা'।

তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো হলঃ সাত নম্বর কয়েদি, সাড়ে চুয়াত্তর, কাজরী, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য, অ্যাটম বোম, ওরা থাকে ওধারে, ঢুলি, মরণের পরে, সদানন্দের মেলা, অন্নপূর্ণার মন্দির, অগ্নিপরীক্ষা, গৃহপ্রবেশ, বলয়গ্রাস, সাঁঝের প্রদীপ, সাজঘর, শাপমোচন, মেজ বউ, ভালোবাসা, সবার উপরে, সাগরিকা, শুভরাত্রি, একটি রাত, ত্রিযামা, শিল্পী, আমার বউ, হারানো সুর, চন্দ্রনাথ, পথে হল দেরি, জীবন তৃষ্ণা, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, ইন্দ্রাণী, সূর্যতোরণ, চাওয়া-পাওয়া, দীপ জ্বেলে যাই, হসপিটাল, স্মৃতিটুকু থাক, সপ্তপদী, বিপাশা, সাত পাকে বাঁধা, উত্তরফাল্গুনী, সন্ধ্যাদীপের শিখা, গৃহদাহ, কমললতা, মেঘ কালো, নবরাগ, ফরিয়াদ, আলো আমার আলো, হার মানা হার, শ্রাবণ সন্ধ্যা, দেবী চৌধুরাণী, প্রিয় বান্ধবী, দত্তা, প্রণয় পাশা।

প্রতিটি ছবিতেই চিত্রনাট্য অনুযায়ী ভিন্নস্বাদের অথচ স্বতন্ত্র অভিনয়ের দ্বারা প্রমাণ করেছেন তিনি এক ও অদ্বিতীয়া, তিনি বাঙালীর মহানায়িকা। তিনি আকাশ ছুঁয়েছেন, তা সত্ত্বেও তৎকালীন চলচ্চিত্র জগতের সকলের সঙ্গে ছিল তাঁর মধুর সম্পর্ক।পর্দায় যে উত্তমকুমারের গলায় তিনি মালা দিয়েছেন বারে বারে সেই উত্তম কুমারের সঙ্গেও ছিল তাঁর সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক, লোকমুখে তাঁদের প্রেমের গল্পও কম শোনা যায় না।পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর সম্ভ্রম বজায় রেখে চলতেন চিরদিন।

কিন্তু সিনেমার পর্দায় তাঁর বাঁকা চোখের চাহনি, হৃদয়ে কাঁপন জাগানো সেই মায়া হাসি,মিহি কুয়াশার মতো সুরেলা কন্ঠস্বর আর অসামান্য অভিনয় প্রতিভা গুনে বাঙালী হৃদয়ে ঝড় তুলেছেন বারে বারে।  'সপ্তপদী'র... "এই পথ যদি না শেষ হয়", কিংবা হারানো সুর ছবিতে গীতা দত্তের মায়াবী সুরে ''তুমি যে আমার" তালিকার শেষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কি সাবলীল অভিব্যক্তি! সে জন্যই তিনি সেরার সেরা।

হঠাৎ করেই যেভাবে এসেছিলেন, ঠিক হঠাৎ করেই সেভাবে চলচ্চিত্র ছেড়ে দেন তিনি। ১৯৭৮সালে মুক্তি পায় তাঁর অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র ‘প্রণয় পাশা’। এরপর আর কখনও ক্যামেরার সামনে আসেননি তিনি। এমনকি সেভাবে কারো সাথে দেখাও করেননি। শোনা যায়, দর্শক হৃদয়ে তাঁর চিরযৌবনা ছবিটাকে বাঁচিয়ে রাখতেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত। ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ 'দাদাসাহেব ফালকে' পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও, ভারতের রাষ্ট্রপতির থেকে সশরীরে পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেন তিনি। ফলে তাঁকে সে পুরস্কার দেয়া হয়নি। সুচিত্রা সেন প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি “সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস” অর্জন করেন। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে। এছাড়াও ২০১২ সালে তাঁকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মাননা 'বঙ্গবিভূষণ' প্রদান করা হয়।

শেষ জীবনটা অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে কাটিয়ে দেন আধ্যাত্মিক জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সাথে তিনি শেষদিন পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। ২০১৪ সালের ১৭ ই জানুয়ারি কলকাতার বেলে ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এই মহানায়িকা সুচিত্রা সেন পরলোকগমন করেন। একথা অনস্বীকার্য যে মৃত্যু শুধু তাঁর নশ্বর দেহটার বিলুপ্তি ঘটিয়েছে, কিন্তু বাঙালী চলচ্চিত্র অনুরাগীদের মনে তাঁর জন্য চিরস্থায়ী আসন পাতা রয়েছে। তিনি তাঁর অভিনীত ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে অমর হয়ে রয়েছেন।

তাই প্রয়াণ দিবসে সশ্রদ্ধ স্মরণ করি মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকে।


No comments