Header Ads

বাঙালির মধ্যে যেভাবে প্রথম ইংরেজিয়ানার আবির্ভাব হয় || শেষ পর্ব



বঙ্কিম চন্দ্র লিখলেন-- সে সময়কার চিত্রটা ছিল এই রকম--কিছু কৃতবিদ্য ছিল যারা বাংলা ভাষাকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করলো। তাদের মতে বাংলা ভাষার মধ্যে তাদের পাঠযোগ্য কিছুই নেই। বাংলা ভাষার লেখক মাত্র হয় বিদ্যাবুদ্ধিহীন ও  লিপি কৌশল শূন্য। ওঁদের লেখা পড়লে মনে হয় বুঝি কোন ইংরেজি গ্রন্থের অনুবাদ মাত্র। তাদের বিশ্বাস ছিল যা কিছু বাংলায় লেখা হয় তা হয় অপাঠ্য নতুবা কোন ইংরেজি গ্রন্থের ছায়াপাত বা নকল। 



সে সময়টা এমন দিকে গড়িয়ে যাচ্ছিল যে নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন কাজই বাংলায় হত না।  আলোচনা, সভা-মিটিং, লেকচার, সাধারণ কাজকর্ম সবই চলত ইংরেজিতে। যেখানে উভয়ে ইংরেজি জানত সেখানে সমস্ত কথোপকথন ইংরেজিতেই চলত। ইংরেজিতে তারা চিঠি-পত্র লেখালেখি করত,  কখনও বাংলায় তারা লিখত না। সময়টা এমন এসে ছিল মনে হত অবিলম্বেই ইংরেজিতে পূজামন্ত্র উচ্চারিত শুরু হয়ে যাবে। 

বঙ্কিম চন্দ্র এমনটাও লিখে ছিলেন--“আমরা ইংরেজি বা ইংরেজের দ্বেষক নহি। ইহা বলিতে পারি যে, ইংরেজ হইতে এ দেশের লোকের যত উপকার হইয়াছে, ইংরেজি শিক্ষাই তাহার মধ্যে প্রধান। অনন্তরত্নপ্রসূতি ইংরেজি ভাষার যতই অনুশীলন হয়, ততই ভাল। আরও  বলি, সমাজের মঙ্গলের জন্য কতগুলি সামাজিক কার্য রাজপুরুষদিগের ভাষাতেই সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক।…এমন অনেক কথা আছে যে, তাহা কেবল বাঙালির জন্য নহে; সমস্ত ভারতবর্ষ তাহার শ্রোতা হওয়া উচিত। সে সকল কথা ইংরেজিতে না বলিলে, সমগ্র ভারতবর্ষ বুঝিবে কেন ? ভারতবর্ষীয় নানা জাতি এক মত, এক পরামর্শী,  এক একোদ্যগী না হইলে, ভারতবর্ষের উন্নতি নাই। এই মতৈক্য, এক পরামর্শিত্ব, একোদ্যম, কেবল ইংরেজির দ্বারা সাধনীয়। কেন না এখন সংস্কৃত লুপ্ত হইয়াছে। বাঙালী, মহারাষ্ট্রী, তৈলঙ্গী, পাঞ্জাবী  ইহাদের সাধারণ মিলন ভূমি ইংরেজি ভাষা। এই রজ্জুতে ভারতীয় ঐক্যের গ্রন্থি বাঁধিতে হইবে। অতএব যতদূর ইংরেজি  চলা আবশ্যক তত দূর চলুক। কিন্তু একেবারে ইংরাজ হইয়া বসিলে চলিবে না। বাঙালী কখনও ইংরাজ হইতে পারিবে না।…যদি এই তিন কোটি বাঙালী হঠাৎ তিন কোটি ইংরেজ হইতে পারিত, তবে সে মন্দ ছিল না। কিন্তু তাহার কোন সম্ভাবনা নাই; আমরা যত ইংরেজি পড়ি, যত ইংরেজি কহি বা যত ইংরেজি লিখি না কেন, ইংরেজি কেবল আমাদিগের মৃত সিংহের চর্মস্বরূপ হইবে মাত্র। ডাক ডাকিবার সময় ধরা পড়িব। পাঁচ সাত হাজার নকল ইংরেজ ভিন্ন তিন কোটি সাহেব কখনই হইয়া উঠিবে না। গিল্টি পিতল হইতে খাঁটি রুপা ভাল। নকল ইংরেজ অপেক্ষা খাঁটি বাঙালী স্পৃহণীয়। ইংরেজি লেখক, ইংরেজি বাচক সম্প্রদায় হইতে নকল ইংরেজ ভিন্ন কখনও খাঁটি বাঙালীর সমুদ্ভবের সম্ভাবনা নাই।  যত দিন না সুশিক্ষিত জ্ঞানবন্ত বাঙালীরা বাংলা ভাষায় আপন উক্তি সকল বিন্যস্ত করিবেন, তত দিন বাঙালীর উন্নতির কোন সম্ভাবনা নাই।”

এ ভাবে বঙ্কিম চন্দ্র তদানীন্তন নব্য ইংরেজিয়ানার প্রাবল্য ভাবটাকে রোধ করতে অনেকটা সক্ষম হতে পেরেছিলেন। বঙ্গদর্শনের মাধ্যমে তিনি তার মতামতের কলম চালিয়ে যেতে লাগলেন। তাঁর সম্পাদনায় পাঁচ বছরে পঞ্চাশ বছরের কাজ এগিয়ে গিয়েছিল। শিক্ষিত কৃতবিদ্যরা কিছুটা আত্মস্থ হয়েছিলেন, বাঙালীর আত্মমর্যাদা অনেকাংশে ফিরে এসেছিল। বঙ্গদর্শনের দেখাদেখি শহরে ও মফস্বলে ‘আর্ষদর্শন’, ‘ভ্রমর’, ‘বান্ধব’, ‘জ্ঞানাঙ্কুর’, ‘ভারতী’, ‘সাধারণী’, ‘নবজীবন’ ও ‘প্রচার’, বঙ্গদর্শন প্রকাশের মাত্র বার বৎসরের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলা ভাষার সাহিত্যের মর্যাদা এইভাবে ফিরে এসেছিল।

বঙ্কিম চন্দ্র এ কাজ প্রায় সম্পূর্ণ করে এনেছিলেন। এরপর কলকাতার ঠাকুর পরিবার তা সম্পন্ন করেছিলেন। “তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ভারতবর্ষ ও ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টি ফিরিয়ে এনেছিলেন। পুত্র দ্বিজেন্দ্র, সত্যেন্দ্র, জ্যোতিরিন্দ্র, রবীন্দ্র এবং কন্যা স্বর্ণকুমারী 'ভারতী'র মাধ্যমে সে কাজ সুসম্পন্ন করেছিলেন। এরপর রবীন্দ্রনাথের 'সাধনা'তে সেই সাধনা জয়যুক্ত হয়েছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ও রাম বাগানের দত্ত পরিবার তখন কলকাতার শিক্ষিত সমাজের আদর্শ ছিল। ঠাকুর পরিবার স্বভাষায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকলেন। অন্য দিকে দত্ত পরিবারের শচীন্দ্র, গোবিন্দ চন্দ্র, তরু ও অরু ক্ষমতাশালী হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজিয়ানার মোহে পড়ে বিলুপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। বঙ্কিম চন্দ্রের উপদেশ গ্রহণ করে এক মাত্র রমেশচন্দ্র আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন। বঙ্কিম চন্দ্র নিজে তখনও ভাষা নিয়ে সচেষ্ট ছিলেন। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি লিখলেন--“আজকে কলকাতায় এমন অনেক কৃতবিদ্য নরাধম আছে যারা মাতৃভাষাকে ঘৃণা করে। যে তার অনুশীলন করে তাকেও তারা ঘৃণা করে। আপনাকে মাতৃভাষা অনুশীলনে পরান্মুখ ইংরেজি নবিস বলিয়া পরিচয় দিয়া, আপনার গৌরব বৃদ্ধির চেষ্টা পায়।”

এ ব্যাপারে সাহিত্যের পথ ধরে অগ্রসর হবার কাজ যতটুকু বাকি ছিল স্বদেশী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্র সুন্দর, ব্রহ্মবান্ধব, পাঁচকড়ি, বিপিনচন্দ্র প্রভৃতির চেষ্টায় সেটুকুও আর বাকি থাকল না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সংস্কার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ এর আগেই মন দিয়েছিলেন। সাধনায় শিক্ষার হেরফের প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন,“আমাদের এই শিক্ষার সহিত জীবনের সামঞ্জস্য সাধনই এখনকার দিনের সর্ব প্রধান মনোযোগের বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু এ মিলন কে সাধন করিতে পারে। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য...আমাদের শিক্ষিত লোকেরা যখনই ভাব প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করেন তখনই বাংলাভাষা অবলম্বন করিতে তাহাদের একটা কাতরতা জন্মে। কিন্তু হায় অভিমানিনী ভাষা, সে কোথায়।"

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় মাতৃভাষার প্রচলনের সেই ছিল প্রথম আবেদন। এই আবেদন এত দিনে গ্রাহ্য হয়েছিল।

তারপর বিংশ শতাব্দীর শুরু ও স্বদেশী আন্দোলন নতুন ভাবে বঙ্গদর্শনে ও ভাণ্ডারে মায়ের ঘরে যেন মাটির প্রদীপ জ্বলে দিয়েছিল। বিশ্বের দরবারে বাঙালী নিজের ভাষা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো। সমস্ত বিশ্বের সঙ্গে বাংলা ভাষার পরিচয় ঘটল। সে যুগের ঈশ্বর গুপ্তরা আর 'হুট বলে বুট' পরার নিন্দা করতে পারলেন না। প্রথম ইউরোপিয়ান মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে আমরা নব-পর্যায় 'বঙ্গদর্শনে'র অর্থাৎ নতুন স্বদেশীকতার শেষ সীমা পর্যন্ত এসে পৌঁছালাম।

প্রথম ইউরোপীয় মহাযুদ্ধের সাথে সাথে বাঙালির মন-মেজাজ রুচি আবার বদলাতে লাগলো। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় বিদেশের প্রভাব প্রবেশ করেছিল। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে নানা বৈদেশিক ভাব এসে আমাদের মানসিকতায় ধাক্কা দিতে লাগলো। আমাদের হৃদয় দ্বারে 'সবুজপত্র' ভাষা ব্যঞ্জনেও কোন কাজ হল না। এরপর যুদ্ধ সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনে ও বাংলাদেশের অধিকাংশ সাহিত্যে অতি আধুনিকতার বন্যা বয়ে গেল। এই সাহিত্যের চেহারা বাংলা হলেও ভাব ছিল অন্য রকম। নতুন ভাবে ছদ্মবেশে আরও প্রবল ও বিষাক্ত ইংরেজিয়ানা আমাদের অন্তঃপুরে প্রবেশ করতে লাগল। এর সঙ্গে সহায়ক হিসাবে যুক্ত হল মুখর চলচ্চিত্র বা টকি। এর মারাত্মক প্রভাব কতদূর পর্যন্ত গড়িয়ে ছিল তার কথা অবশ্য রাজশেখর বাবুও উল্লেখ করেননি। কিন্তু স্বদেশপ্রেমী চিন্তাশীল বাঙালী মাত্রেরই আশঙ্কার কারণ ঘটেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তা আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধরে নিলো। সে রূপ ভারতবর্ষের বুকে এসে আছড়ে পড়ল। বাঙালীর ঘরে-বাইরে যেন বানের জল ঢুকে পড়ল। যত অনাচার, যত জঞ্জাল, অবাঞ্ছিত দ্রব্য ঘরে এসে জমা হল। বহুকষ্টে, বহু বেদনায় সংগ্রহ করা যা কিছু ছিল ভেসে যেতে লাগলো। ইংরেজিয়ানার সঙ্গে ইয়ার্কিয়ানা যোগ হয়ে ভাষার চেহারা একের জায়গায় দুইয়ের মাঝে একাকার হয়ে গেল। টকির সঙ্গে এরোড্রাম, এয়ারপোর্ট এবং এয়ার বেস-এর সর্বনাশা শিক্ষা আমাদের মনকে কলুষিত করে তুলল। আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের এই ভাব শিক্ষা বাংলাদেশকে বিশেষভাবে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে লেগেছিল। তারপর এলো মন্বন্তর, ব্ল্যাক মার্কেট, নতুন আভিজাত্য সম্প্রদায়। এ সবের দ্বারা তৈরি সর্বনাশের পরিণাম শুধু ভাষা ও সাহিত্যের দিক দিয়ে নয়, আমাদের মন মানসিকতাকেও কলঙ্কিত করে তুলেছিল। সে সময় শ্রী রাজশেখর বসু দ্বারাই এর মূল্যায়ন করা সম্ভব ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতার বাতাস বয়ে যেতে যেতেও বিজাতীয় গন্ধকে কিন্তু দূর করতে পারেনি। বাংলাদেশ বা বাংলা সাহিত্যকে কলঙ্কমুক্ত করবার জন্য বঙ্কিম চন্দ্র, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথের মত মহাশক্তিশালী সাধকের অক্লান্ত সাধনা ও প্রহরার প্রয়োজন ঘটে ছিল। রাজ শেখর এ ব্যাপারে বাইরের দু'চারটে উপসর্গ মাত্র তার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, আসল ব্যাধি আরও ব্যাপক, আরও গভীরে নিহিত ছিল। এর প্রতিকারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্মিলিত চেষ্টার প্রয়োজন যথেষ্ট ছিল না।

ইংরেজিয়ানার সমস্যা ভারতের গ্রামাঞ্চলের লোকদের বিশেষ একটা প্রভাবিত করতে পারেনি। এখনও গ্রাম অঞ্চলের বেশির ভাগ লোক অশিক্ষিত। বাংলা বা স্থানীয় ভাষা যা কিনা কথ্য ভাষা তা দিয়েই তাদের মত বিনিময়ের কাজ চলে যায়। বাংলা ভাষার ব্যুৎপত্তি ভাবধারার কাছে তারা বেশির ভাগই অপরিচিত। অন্য দিকে হিন্দি ভাষার চলন বেশ বেড়ে গেছে, শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমানে এই ভাবেই যেন 'কিউ, কেয়া, কাহা নিয়ে পরস্পর পরস্পরের ভাব বিনিময় করে চলছে। আজও বাংলা ভাষার বিসর্জনের কাজ প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। অলিখিত ভাবে হলেও ইংরেজি আজও ভারতের রাজভাষা। প্রবাসী বাঙালিরা তো বাংলা ভাষা ভুলতে চলেছেন। প্রবাসী নব যুবকদের কাছে বাংলা ভাষা তো দূরের কথা, বাংলা বর্ণ তাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। আজ বাংলা ও ইংরেজি প্রতিযোগিতায় ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য অনেক বেশি। এ জন্যে ভারতীয় বিবিধ ভাষার সমন্বয়ও অনেকাংশে দায়ী। আজ অধিকাংশ বাঙালীর বাংলা ভাষার প্রতি প্রবল অনীহা। শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষার হোড় পড়েছে। সবাই তাদের ছেলে মেয়েকে ইংরাজি স্কুলে শিক্ষা দেবার জন্যে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।

প্রবাসে কিছু প্রবীণ ও বৃদ্ধরা বাংলা ভাষার প্রচার প্রসারের ব্যাপারে কিছুটা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু সেটা সমুদ্রের মাঝে কয়েক বিন্দু জলের সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। এতে আর যেন অন্য কারও কোন মাথা ব্যথা নেই। যেমন চলছে চলুক না, এমনি একটা ভাবনায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এ ব্যবস্থার পরিবর্তন করা যেন বেড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধার সামিল হয়ে পড়েছে।




No comments