Header Ads

ইন্দ্রলাল রায় প্রথম ভারতীয় বিমান চালক, যিনি ১৭০ ঘণ্টা যুদ্ধ বিমান চালানোর রেকর্ড করেছিলেন


দক্ষিণ কলকাতার দিকে যাতায়াত আছে ? কোনদিন কি চোখে পড়েছে ভবানীপুরে রাস্তার নাম লেখা এই সাইনবোর্ডটা। কৌতূহল জাগেনি মনে কে এই রায় ?

সমগ্র বাঙালির কাছে অচেনা এই বঙ্গসন্তানের জন্ম ১৮৯৮ সালের ২রা  ডিসেম্বর কলকাতায়। বাবা সেই আমলের নামী ব্যারিস্টার এবং কলকাতার পাবলিক প্রসিকিউশন্‌স-এর ডিরেক্টর প্যারীলাল রায় ও মা ললিতা রায়। মাতামহ সূর্য (গুডিভ) চক্রবর্তী ছিলেন দেশের প্রথম আলোপ্যাথিক ডাক্তার। 


বরিশালের ধনী পরিবারের ছেলে প্যারীলাল বিশ্বাস করতেন, একমাত্র ব্রিটিশরাই পারে ভারতীয়দের গড়ে তুলতে। ইংরেজি শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। আর এজন্যই ১৯০১ সালে ছয় সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে চলে এলেন লন্ডনে। বাড়ি নিলেন হ্যামারস্মিথে, ৭৭ নম্বর ব্রুক গ্রিনে। পরেশ, ল্যাডি ও ললিত— তিন ছেলেকে ভর্তি করে দিলেন হ্যামারস্মিথে সেন্ট পল বয়েজ় স্কুলে। আর লীলাবতী, মীরাবতী এবং হীরাবতী— তিন মেয়ে ভর্তি হল সেন্ট পল স্কুল অব গার্লস-এ। কিন্তু প্যারী লন্ডনে থাকলেন না। সংসার গুছিয়ে দিয়ে স্ত্রী ললিতার দায়িত্বে সন্তানদের রেখে ফিরে আসেন কলকাতায়।

সমাজসেবা, পড়াশোনা, খেলাধুলো, সঙ্গীত— সব কিছু নিয়ে লন্ডনের দিনগুলো হইহই করে কাটছিল ললিতা ও তাঁর ছেলেমেয়েদের। সুখী জীবনে ছেদ পড়ল ১৯১৪ সালে, শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ !

পরেশ তখন কেমব্রিজের ইমানুয়েল কলেজ থেকে সদ্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তিনি যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। হঠাৎ সেনাবাহিনীতে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর বহু দিন পরে  বলেছিলেন, ‘‘আমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম, বাঙালিরাও রণাঙ্গনে গিয়ে অন্য দেশের সৈনিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে।’’

সেই সময় ল্যাডির বয়স মাত্র পনেরো। দাদাকে দেখে  উদ্বুদ্ধ হয়ে ঠিক করেন, পড়াশোনার গণ্ডি পেরিয়ে তিনিও সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। তবে স্থলবাহিনী তে নয়, উড়তে চেয়েছিলেন আকাশে।স্কুলের পাঠ শেষ হলে অক্সফোর্ডে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি পেয়েছিলেন কিন্তু উঠে পড়ে লাগলেন স্বপ্নপূরণের আশায়।

‘রয়্যাল ফ্লায়িং কর্পস’-এ যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করলেও কপাল খারাপ! কমজোরি দৃষ্টিশক্তির জন্য পরীক্ষায় উতরোতে পারলেন না। ভেঙে না পড়ে বিক্রি করে দিলেন তাঁর শখের মোটরসাইকেল। সেই টাকা দিয়ে ব্রিটেনের সবচেয়ে নামী চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা করালেন। চিকিৎসক সবুজ সিগনাল দিতেই  ফের এক বার রয়্যাল ফ্লায়িং কর্পস-এ আবেদন করেন। এ বারে সসম্মানে পাশ করলেন। মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে যুদ্ধে গেলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তখন জ্বলছে গোটা ইউরোপ। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে গিয়েছে দিদি লীলার। দুই ছেলে যুদ্ধে চলে যাওয়ার পর ললিতা বাকি তিন সন্তানকে নিয়ে বাড়ি বদলে চলে আসেন কেনসিংটনে কুইন অ্যান ম্যানশনে।

জুলাই, ১৯১৭। অক্সফোর্ডে ট্রেনিং শেষে উনিশ বছর বয়সি ল্যাডি ৫৬ নম্বর স্কোয়াড্রনে সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের পদে যোগ দেন। ফ্রান্সের ভাদোম-এ পোস্টিং হয় তাঁর। কথাবার্তায় চৌকশ এই বঙ্গসন্তান অচিরেই এয়ার ফোর্সে  বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। 

আকাশে উড়তে না উড়তেই মুখোমুখি হন শত্রুপক্ষ জার্মান বিমানের.....ছয়মাসের মধ্যে ঘটে গেল এক অঘটন। সে দিন এস ই ফাইভ বিমানে আকাশে উড়ছিলেন, আচমকা তাঁর বিমানকে লক্ষ্য করে এক জার্মান যুদ্ধবিমান গুলি চালায়। নো ম্যান’স ল্যান্ডে ভেঙে পড়ে  বিমান। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত বলে ঘোষণা করা হয় তাকে। দেহ রাখা হয় মর্গে। হঠাৎ মর্গের দরজায় ভিতর থেকে ধাক্কা। ভূতের ভয়ে হাসপাতালের কর্মীদের তো একেবারে দাঁতকপাটি লেগে যাওয়ার জোগাড়। 
ভূত নয়, আসলে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল ল্যাডি! দুর্ঘটনায় সে দিন মারা যাননি তিনি। মর্গে জ্ঞান ফিরে আসায় দরজায় ধাক্কা দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছিলেন। হাসপাতালের কর্মীদের ভূতের ভয় তাড়িয়ে শেষমেশ বোঝাতে সমর্থ হন যে তিনি বেঁচে আছেন। নিজের শিবিরেও ফিরে আসেন তিনি। চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে ল্যাডি ।

তবে সুস্থ হয়ে উঠলেও আর বিমান চালানোর ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত তার বারংবার অনুরোধ ও অদম্য ইচ্ছের কাছে হার মানতে হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। আকাশে ওড়ার জন্য আবার শারীরিক প্রস্তুতি নেন তিনি। হাসপাতালে থাকার সময় মানসিক দিক থেকেও আরও পরিণত হয়েছিলেন। বৈমানিকের দক্ষতায় আরও শান দিয়ে ১৯১৮ সালের ২২ শে জুন যোগ দেন ৪০ নম্বর স্কোয়াড্রনে ।

জুলাই ১৯১৮, আবার বিমান নিয়ে উড়ে যান যুদ্ধক্ষেত্রে। প্রথম দিনেই তাঁর আক্রমণে পরাজিত হয় এক জার্মান বিমান। 


৯ ই জুলাই থেকে ১৯ শে জুলাই, টানা দশ দিনে ন’টি জার্মান বিমানকে তিনি আক্রমণ করে মাটিতে নামিয়ে আনেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় বিমান চালক, যিনি ১৭০ ঘণ্টা যুদ্ধ বিমান চালানোর রেকর্ড করেছিলেন।

২২ শে জুলাই, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হওয়ার চার মাস আগের ঘটনা। ফ্রান্সের আকাশে উড়ছেন, তাঁর মন হিসাব কষছে শত্রুপক্ষের বিমানকে ধূলিসাৎ করার। আর ঠিক তখনই চার-চারটে জার্মান ফকার যুদ্ধবিমান তাঁকে চার দিক থেকে ঘিরে ধরে। ধুন্ধুমার যুদ্ধ শুরু হয় আকাশে। চার বনাম একের যুদ্ধে অভিমন্যুর মতো সর্বশক্তি দিয়ে লড়েন ল্যাডি, পরাস্ত করেন দুটো জার্মান বিমানকে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না, একটি জার্মান বিমানের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা খায় তাঁর বিমান। শেষ হয়ে যায় তাঁর আকাশে ওড়ার স্বপ্ন !

লন্ডনে বসে ললিতা জানতে পারেন, তাঁর মেজ ছেলে ‘মিসিং ইন অ্যাকশন’।

১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি যে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন, তা নিশ্চিত করে রয়্যাল এয়ার ফোর্স। ওই বছরই রয়্যাল ফ্লায়িং কর্পস-এর নাম বদলে হয় দ্য রয়্যাল এয়ার ফোর্স। এর তিন দিন পর তাঁকে মরণোত্তর ‘দ্য ডিসটিংগুইশ্‌ড ফ্লায়িং ক্রস’ সম্মানে ভূষিত করা হয়। সেদিনের সেই বৈমানিক ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি এই সম্মান পেয়েছিলেন। 

উত্তর ফ্রান্সের এসতেভেলেস কমিউনাল সেমেটরির একটি সমাধির ওপর লেখা---‘তিনি মারা গিয়েছেন তাঁর আদর্শকে ভালবেসে’। ‌

সমাধির তলায় যিনি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন তাঁর জন্ম ফ্রান্স থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে কলকাতায়!  একুশ বছরের এক বঙ্গসন্তান যিনি প্রথম ভারতীয় যুদ্ধ বিমানচালক ল্যাডি ওরফে ইন্দ্রলাল রায়। তাঁর মৃত্যুর শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। 

ল্যাডির দিদি লীলার ছেলে সুব্রত মুখোপাধ্যায় স্বাধীনতার পরে ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রথম ‘চিফ অব দি এয়ার স্টাফ’ হয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে ভাগ্নের জন্য মামা নিশ্চয়ই গর্বিত হতেন।
দক্ষিণ কলকাতার ইন্দিরা সিনেমাহলের কাছে একটি রাস্তার নাম ‘ইন্দ্র রায় রোড’। কিন্তু আমরা  ক’জনই বা চিনি এই বীর বাঙালিকে! বাঙালির ভিতু, ঘরকুনো তকমাটা যে মানুষটা মুছতে চেয়েছিলেন, মৃত্যুর একশো বছর পরেও সেই ল্যাডি ওরফে ইন্দ্রলাল রায় এর নামে একটা রাস্তার নামকরণ করা ছাড়া আমরা আর কোন সম্মানই দেওয়া হয়নি তাঁকে।

No comments