Header Ads

'নীল-দর্পণ' নাটকটি মঞ্চস্থ করার মাধ্যমে 'ন্যাশনাল থিয়েটার'-এর দ্বার উদঘাটন করা হয়েছিল



এক বিখ্যাত বাংলা ঐতিহাসিক নাটক হল 'নীল-দর্পণ'।যার নাট্যকার হলেন অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক 'দীনবন্ধু মিত্র'।গত ৭ই ডিসেম্বর এক ঐতিহাসিক দিন কেননা এই দিনেই এই বিখ্যাত নাটকটি মঞ্চস্থ করার মাধ্যমে 'ন্যাশনাল থিয়েটার'-এর দ্বার উদঘাটন করা হয়েছিল।এই প্রবন্ধে আমরা নীলদর্পণ নাটকটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করব।


নাটকটি মূলত নীলের চাষ ও নীলকর সাহেবদের অবর্ণনীয় অত্যাচারকে কেন্দ্র করে রচিত।বস্ত্রশিল্পে নীল রং প্রয়োজন হয়। সে আজ থেকে দেড়শো-দুশো বছর আগেকার কথা।রাসায়নিক নীল তখনো আবিষ্কার হয়নি, উদ্ভিদ থেকে উৎপাদিত নীল দিয়েই রঙের কাজ চালানো হত।তখন কোম্পানির আমল।কোম্পানির সাহেবরা জানতেন যে বঙ্গদেশের উর্বর জমি নীল চাষের জন্য উপযুক্ত জায়গা।তাই, সেইসব সাহেবরা, বলাবাহুল্য, বণিকেরা বাংলার কৃষকদের সাহায্যে নীলের চাষ আরম্ভ করেন।বাংলার বিভিন্ন গ্রামে কুঠির বানিয়ে সেখানে নীল চাষ আরম্ভ হয়।কৃষকদের দাদন(আগাম কিছু টাকা)দিয়ে তাদেরকে দিয়েই নীল চাষ করানো হত।আর তার থেকে উৎপাদিত নীল ইউরোপের বাজারে চড়া দামে বিক্রি করে কোম্পানি মোটা টাকা লাভ করত। ক্রমে, কোম্পানির অর্থলাভ বেড়ে গেল এবং এই অর্থলাভের ফলে লোভও বেড়ে গেল।এই আকস্মিক অর্থলাভ ও লোভের বশে নিরীহ বাংলার কৃষকদের প্রতি কোম্পানির নিদারুণ অত্যাচার শুরু হল।কি রকম? কোম্পানি আরও লাভের জন্য কৃষকদের ধানের ক্ষেতে জোর করে নির্যাস আরম্ভ করল।অনিচ্ছুক কৃষকদের উপর নেমে আসত অবর্ণনীয় অত্যাচার।দেশের স্বাধীনতা তো আগেই হরণ করা হয়েছিল এবার এর সাথে কৃষকদের স্বাধীনতাও হরণ করা হল।কৃষকদের উপর এই অত্যাচার একটা সময় সব সীমা ছাড়িয়ে গেল।ঠিক সেই সময় এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল।

সর্বপ্রথম পত্রিকায় কলম ধরলেন বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার দত্ত।যাঁর জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী কিছুকাল আগেই পার হয়ে এলাম।তো, তিনি ১৮৫৭ সালে 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকায় লিখেছিলেন, "ভূস্বামীদিগের বিষম অত্যাচারের বিবরণ পাঠ করিলে বিস্ময়াপন্ন ও ব্যাকুল চিত্ত হইতে হয়; কিন্তু এক্ষণে চতুর্দ্দিক হইতে এই কথাই শ্রুত হওয়া যাইতেছে যে, নীলকরদিগের অত্যাচার তদপেক্ষা ভয়ানক, তাঁহাদের দৌরাত্ম্যে প্রজাকুল নির্মূল হইবার উপক্রম হইয়াছে।" এতোখানি ভয়ংকর অত্যাচার!তিনি ভূস্বামী ও নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে লিখেছিলেন যার মর্মার্থ হলো দুটো সমুদ্র দেখে তাদের মধ্যে যেমন তারতম্য বোঝা যায় না তাদের দুজনকে অসীম প্রায় বোধ হয় ঠিক তেমনি ভূস্বামী ও নীলকরদের অত্যাচার তারতম্য বোঝা কঠিন শুধু নয় দুষ্করও বটে।তিনি আরো লিখেছিলেন যে, "নীলকরদিগের কার্য্যের আদ্যোপান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে স্পষ্ট প্রতীত হয় যে, প্রজা পীড়ন করিয়া স্বকার্য্য উদ্ধার করাই তাঁহাদের সংকল্প।দেখ, প্রজারা আপন অধিকারস্থ না হইলে, তাহাদের উপর সম্পূর্ণ বল প্রকাশ ও স্বেচ্ছানুরূপ অত্যাচার করা সম্ভাবিত হয় নাঅতএব তাঁহারা স্বীয় স্বীয় কটীর সন্নিহিত গ্রামের সকল ইজারা লইয়া থাকেন এবং এতদ্বারা তাহাদিগকে স্বীয় লাভে-খৰ্পরে পতিত করিয়া মনস্কামনা সিদ্ধ করেন।করিলে,তাঁহারা এই কৌশল দ্বারা ভূস্বামীদিগের সদৃশ প্রবল প্রতাপ ও প্রভূত পরাক্রম প্রাপ্ত হবেন এবং বাস্তবিক আপনাদিগকে স্বাধিকারের সম্রাট্‌ স্বরূপ জ্ঞান করিয়া প্রজাপীড়নে কৃতসংকল্প হইয়া তদনুযায়ী ব্যবহার করেন।"

অক্ষয়কুমার দত্তের মতোই যিনি এই নীলকর সাহেবদের অত্যাচার সম্পর্কে বাংলার সমাজের সকলকে জানিয়েছিলেন তিনি হলেন 'হিন্দু পেট্রিয়ট' পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।তাঁর পত্রিকার প্রতিটা সংখ্যায় তিনি নীলকর সাহেবের অত্যাচার প্রকাশ করতেন।

অবশ্য, পত্রিকার আগে বইয়ে স্থান করে নেয় নীলকর সাহেবদের অত্যাচার, প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল’-এর গ্রন্থে।

এই কলমকে অস্ত্র করে যখন কৃষকদের প্রতি নীলকর সাহেবদের ও ভূস্বামীদের অমানুষিক অত্যাচার প্রকাশ পাচ্ছিল,ঠিক তখনই এই ঘটনা এক নাটকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুললেন দীনবন্ধু মিত্র।নাটক তো সমাজেরই আয়না বা দর্পণ।তাই সেই কৃষক সমাজের কৃষকদের উপর ঘটে যাওয়া অত্যাচারকে দর্পণে দেখিয়েছিলেন দীনবন্ধু মিত্র তাঁর 'নীলদর্পণ' নামক এক পূর্ণাঙ্গ নাটকে।যা রচিত হয় ১৮৫৮-৫৯ সালে এবং প্রকাশিত হয় ১৮৬০ সালে ঢাকা থেকে।নীলের চাষ অস্বীকার করা নিয়ে ১৮৫৯ ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ মাসে ঘটা নীলচাষীদের সংঘবদ্ধভাবে নীল বিদ্রোহের ইতিহাসকেও তুলে ধরা হয় এই নাটকে।নীলের চাষের এমনই করুণ পরিণতি হয়েছিল যে চাঁদপুরের হাজি মোল্লা ঘোষণা করেন, 'নীলচাষ থেকে ভিক্ষা উত্তম' 

এখানে বলা ভালো যে, নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদিত হয়েছিল।এই অনুবাদ ‘Nil Durpan, or The Indigo Planting Mirror’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল।অনেকেই মনে করেন যে নাটকটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত অনুবাদ করেছিলেন যদিও অনেক গবেষকের এ ব্যাপারে দ্বিধা আছে।নাটকটি ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলেন রেভারেণ্ড জেমস লঙ সাহেব।তবে, বাংলায় নাটকটি যতটা সাফল্যলাভ করেছিল, ইংরেজিতে তা করতে তো পারেই নি বরং অনুবাদটি প্রকাশের সাথে সাথেই দেশে এক উত্তেজনা সৃষ্টি করে।ওনুবাদ প্রকাশের জন্যে জেমস লঙ সাহেবের জরিমানা ও কারাদণ্ড হয়।আর এই জরিমানার টাকা আদালতেই মেটান এক অন্যতম কৃতী বাঙালি সাহিত্যিক কালীপ্রসন্ন সিংহ।যাইহোক, এখানে উল্লেখযোগ্য এই যে, এই 'নীলদর্পণ'-ই হলো প্রথম বাংলা নাটক যা কিনা ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছিল।

বলা যায়, এভাবেই 'নীলদর্পণ' নাটকটি বাংলা ও বাঙালির এক অমূল্য ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে রয়েছে এবং থাকবেও।



No comments