Header Ads

স্বাধীনতা সংগ্রামের ট্র্যাজিক মহানায়ক উল্লাসকর দত্ত


৩০শে এপ্রিল ১৯০৮, মজাফফরপুরে এক সম্ভ্রান্ত ক্লাবের সামনে বোমায় আক্রান্ত হলো একটি ফিটন গাড়ি। মারা গেলেন গাড়ির আরোহী দুই ব্রিটিশ মহিলা, আর সেই সাথেই সূচনা হলো স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায়, সশস্ত্র সংগ্রাম। ‌


বোমা কারা মেরেছিল বা কি তাঁদের পরিনতি হলো এতো সবাই জানেন, কিন্তু কে প্রথম বানিয়েছিলেন এই মারণাস্ত্র  ?

উল্লাসকর দত্ত জন্মেছিলেন ১৮৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কালীকচ্ছ গ্রামে। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ দ্বিজদাস দত্ত ছিলেন তাঁর পিতা। কলকাতার একটি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে ১৯০৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন। যাতায়াত ছিল বাবার বন্ধু বিখ্যাত বাগ্মী বিপিন চন্দ্র পালের গৃহে। ওনারই প্রভাবে স্বদেশী আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। বিপিন চন্দ্র পালের ছোট মেয়ে লীলাও ছিলো বিজ্ঞানের ছাত্রী। তাঁদের মেলামেশা একসময় বদলে গেল প্রেমে, পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করবেন এমনটাই ঠিক হলো।‌

বিধাতা পুরুষের ইচ্ছা ছিল কিন্তু অন্যরকম। কলেজে পড়ার সময়তেই ইংরেজ অধ্যাপক ডক্টর রাসেল ভারতীয়দের সম্বন্ধে অপমানকর উক্তি করলে উল্লাস তাকে ঘুষি মেরে বসেন। ফল, কলেজ থেকে বহিস্কার। টেক্সটাইল নিয়ে পড়াশোনা করতে বাবা এরপর পাঠিয়ে দেন বোম্বাই। মাঝপথেই তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। অল্পদিনের মধ্যে বারীন্দ্র ঘোষের বিপ্লবী দল যুগান্তর এর সঙ্গে যুক্ত হন। হেম কানুনগোর সাথে বসে মুরারি পুকুরের বাগানবাড়িতে তৈরি করেন তিনটি বোমা, যার একটি ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী নিক্ষেপ করেন মজাফফরপুরে। ততদিনে লীলা পাল প্রেসিডেন্সি থেকে স্নাতক হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে গেছেন ইংল্যান্ড।‌

এই ঘটনার পর বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৬ জন বিপ্লবীকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করে। শুরু হয় 'আলীপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা'। বিচারে উল্লাসকর দত্ত ও বারীন ঘোষের ফাঁসির এবং অন্যদের দ্বীপান্তর ও বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। বেকসুর খালাস পান অরবিন্দ ঘোষ। 

পরবর্তীকালে আপিলে তাঁদের ফাঁসির বদলে পাঠিয়ে দেয়া হয় আন্দামানে, ঠিকানা সেলুলার জেল। বরাবরের প্রতিবাদী মানুষটি এখানে এসেও বন্দীদের ওপর অমানুষিক ব্যবহারের প্রতিবাদ করেন। ফল হয় মারাত্মক, পাঠান মেটদের নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এক পর্যায়ে তাকে ওখান থেকে মাদ্রাজ জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। টানা সেখানে চিকিৎসা চলে ছয় বছর, শেষমেশ ১৯২০ সালের শেষদিকে মুক্তি পান।‌

বাইরে এসে দেখেন বদলে গেছে ফেলে আসা জগতটা। সঙ্গী বলতে তখন ছিল তার যখন তখন অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, প্রতিবাদী হবার পুরস্কার!

শুনলেন লীলা বিদেশ থেকে ফিরে চাকরি করছে বোম্বাইতে, বিয়েও করেছে এক সহকর্মী কে। ছুটে যান বোম্বাই, নিজের চোখে সব দেখে নিষ্ফল আক্রোশে ফিরে যান নিজের গ্রাম কালীকচ্ছে। দিন কাটতো সারাদিন নদীর পাড়ে বসে বাঁশি আর দোতারা বাজিয়ে। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসতো তাঁর সেলুলার জেলের কাহিনী শুনতে। তাদের অনুরোধে লিখে ফেলেন "কারাজীবনী"! নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে ফিরে আসেন কলকাতায়, সময়টা ১৯৩০।

সেখানে আসার পর জানতে পারেন লীলা বিধবা হয়েছে, শুধু তা-ই নয়, পক্ষাঘাতে তার অর্ধাঙ্গ অবশ ও কয়েকটি আঙুল চিরতরে বেঁকে গেছে। কলকাতাতেই ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের  চিকিৎসাধীন। সংবাদ পেয়ে ছুটে যান উল্লাসকর। বন্ধুদের সহযোগিতায় ব্রাহ্মমতে ১৯৪৮ সালে তাদের বিয়ে হয়, দু'জনেরই বয়স তখন ৬৩ বছর। কৈশোরের ভালোবাসার পরিপূর্ণতা দেখা গেল ভারসাম্যহীন উল্লাসকরের হৃদয়ে। টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর কাছে ছোট একটি ঘরে বাসা বাঁধলেন।

চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও প্রত্যাখান করেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য প্রদত্ত ভাতা। মহানগরীতে সংসার চালাতে না পেরে শেষে কলকাতা ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯৫২ সালের কোনো একসময়ে দু-একজন বন্ধুর সাহায্যে অসুস্থ্‌ উল্লাসকর নিজেই পঙ্গু স্ত্রীকে পাঁজকোলা করে স্টিমারে শিলচরে চলে যান। দশবছর পর সেখানে লীলা মারা যান। চরম একাকিত্বের মাঝে ১৯৬৫ সালের ১৭ই মে অমৃতলোকের পথে যাত্রা করেন স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ট্র্যাজিক মহানায়ক।

No comments