Header Ads

যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো



দিনটি ছিল ১৮ এপ্রিল, ১৯৩০। চট্টগ্রাম থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে ধুম ও নাঙ্গলকোট স্টেশনের মাঝামাঝি হঠাৎ করে লাইনচ্যুত হয়ে যায় একটি মালবাহী ট্রেন। কারা যেন রেল লাইনের ফিসপ্লেট খুলে রেখেছিল। বিভিন্ন স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়লো কলকাতা মেল সহ সমস্ত ট্রেন। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো চট্টগ্রামের সাথে পুরো দেশের রেল যোগাযোগ। সেই একই রাতে অন্য একটি দল হামলা চালায় চট্টগ্রামের টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিসে। সব যন্ত্রপাতি গুড়িয়ে দিয়ে তারা আগুন ধরিয়ে দেয় ভবনটিতে। ফলে এবার সম্পূর্ণরূপে বিকল হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। চট্টগ্রামে সেদিন রচিত হয়েছিল এক অসীম সাহসিকতার উপাখ্যান । মাস্টারদার পরিচালনায় চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের এ কাহিনী তো অনেকবার পড়েছেন বা শুনেছেন, কিন্তু কারা ছিলেন সেদিনের কুশীলব ?‌


গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিং, লোকনাথ বল বা অম্বিকা চক্রবর্তীদের মতন প্রথম সারির বিপ্লবী নেতাদের কথা তো সবাই জানেন। এনারা ছাড়াও আরো অনেকে সেদিন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছোট ছোট দলের যাদের ওপর নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এভাবেই সেদিন এই মৃত্যুঞ্জয়ী বীরেরা বিভিন্ন স্থানে চালিয়েছিল ধ্বংসলীলা। রেল লাইন নষ্ট করে দেবার ভার যার ওপর ছিল, তিনি হলেন লালমোহন সেন। ঐ দলের বাকিরা ছিলেন সুবোধ মিত্র, সুকুমার ভৌমিক ও সৌমিত্র কিশোর দত্ত চৌধুরী প্রমুখ বিপ্লবী। সর্বাধিনায়কের নির্দেশ সেদিন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন লালমোহন। জানেন কি এনার পরিচয় ?‌

১৯১০ সালে নোয়াখালী জেলায় সন্দ্বীপের মুছাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই বিপ্লবী মানুষটি। টাকা ধার দেবার ব্যাবসা করে তাদের পরিবার ছিল বংশগত ভাবে ধনী। ছোটবেলা থেকেই এনার ছিলো ধর্ম-কর্মে মতি, যাতায়াত করতেন রামকৃষ্ণ মিশনে। বাড়ির অমতে ওখানকার সন্তদের সাথে দুর্গতদের ত্রাণের কাজেও যেতেন। পড়াশোনায় মেধাবী ছেলেটি ক্লাস নাইনে উঠে ভর্তি হলো চট্টগ্রামে নর্মাল স্কুলে। সময়টা ১৯২৮ সাল। হোস্টেলে থাকার সময়ে পরিচয় হয় আনন্দ গুপ্ত, অনন্ত সিং ও গনেশ ঘোষের সাথে। দীক্ষা নেন  বিপ্লবী মন্ত্রে। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে আত্মনিয়োগ করেন স্বাধীনতা সংগ্রামে।

বিদ্রোহের পরিকল্পনা শুরু হতে সবার আগে সূর্য সেন যে সমস্যার সম্মুখীন হলেন তা হলো অর্থ, খালি হাতে তো আর লড়াই হয়না। এদিকে সদস্যরা সবাই তখন হয় ছাত্র নয়তো বেকার যুবক, কে দেবে টাকা ? এগিয়ে এলেন লালমোহন। এক সন্ধ্যায় বাড়ি গিয়ে জ্যেঠুর ক্যাশ বাক্স ভেঙে নিয়ে এলেন দেড়হাজার টাকা। সেই আমলে সেটা বড়ো কম টাকা ছিলোনা।‌

১৮ই এপ্রিল তার দায়িত্ব পালন করে চট্টগ্রামে ফিরে আসার পথে পেছু নেয় পুলিশের চর । বিপদ বুঝে ফেণী হয়ে পালিয়ে আসেন কলকাতায়। খুবই কাছের একজনের বিশ্বাসঘাতকতায় সে খবরও পৌঁছে যায় সন্দ্বীপের দারোগা সৈয়দ আহমদের কাছে। কলকাতার এক পার্ক থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।‌

১৯৩২ সালে বেরুলো চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল মামলার রায়। অনেকের সাথে লালমোহন সেনের ও হলো যাবজ্জীবন দীপান্তরের সাজা। পনেরোই আগষ্ট যাত্রা করলেন আন্দামানের পথে। সেলুলার জেলে বন্দীদের ওপর অমানবিক ব্যাবহারের প্রতিবাদে ভাগ নেন লাগাতার অনশনে। ১৯৩৮ সালে সেলুলার জেল বন্ধ হয়ে গেলে ওনাকে দেশে ফিরিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী করে রাখা হয়। এখানে থাকতেই দীক্ষা নেন মার্কসবাদে। ফজলুল হক মন্ত্রীসভার হস্তক্ষেপে ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে মুক্তি পান। যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টি তে।‌

সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ ৪৬ সাল থেকেই নোয়াখালীতে অঙ্কুরিত হয়।পরিস্থিতি দেখে বিপ্লবী মানুষটি উদ্যোগ নিয়ে সন্দ্বীপে "হিন্দু মুসলমান শান্তি কমিটি" গঠন করেন। তাঁকেই সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে পার্টির কাজে কলকাতায় যান, সেখানে থাকতেই কানে আসে নিজের গ্রামে দাঙ্গার খবর। তড়িঘড়ি ফিরে আসেন মুছাপুর। অক্লান্ত চেষ্টায় ছড়াতে দিলেন না দাঙ্গা, দুদিনেই নেমে আসে শান্তি।

২০শে অক্টোবর,১৯৪৬....সম্ভবত কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর পরদিন। বাড়ি থেকে ভোরবেলায় বেরিয়ে চট্টগ্রাম আসছিলেন। সঙ্গী ছিলেন ভাগ্নে রয়্যাল এয়ারফোর্সের পাইলট অমলেন্দু সহ আরও তিনজন। ধোপারহাটের কাছে আসতেই ধর্মোন্মাদ একদল মানুষ হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের ওপর। আর তারপর ?

তারপর আরকি,দা বল্লম নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারলো তাদের সেই শ্বাপদের দল। যে দেশবাসীর স্বাধীনতার জন্য একদিন নিজের ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়েছিলেন তারাই সুদে আসলে ফিরিয়ে দিলো তার দাম! ভয়ার্ত পরিবারের লোকজন যখন খবর পেয়ে ছুটে এলো তখন দেহ ক্ষতবিক্ষত হলেও চোখ দুটি খোলা ছিলো তাঁর, আর সেখানে ছিলো এক অপার বিস্ময়! মাত্র ছত্রিশ বছরে আমরা ছিনিয়ে নিলাম এক বিপ্লবীর জীবন যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন শোষণমুক্ত এক দুনিয়ার। এ লজ্জা তোমার, এ লজ্জা আমার, এ লজ্জা সমগ্র বাঙালি জাতির । আজও কি আমরা সে লজ্জা থেকে মুক্তি পেয়েছি ?  

No comments