Header Ads

হারিয়ে যাওয়া শীতকাল


পঞ্চাশের দশকে যাদের আমার মতন জন্ম তাদের কাছে শীতকাল মানে ছিল ইডেনে এমসিসি বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট নয়তো ডোভার লেন বা কলামন্দিরে গানের জলসা। নিকো বা ইকোপার্কের তখন জন্মই হয়নি আর তাই সেসময় ছোটদের  আকর্ষণের জায়গা ছিল এক ও অদ্বিতীয় চিড়িয়াখানা। এখন গলি ক্রিকেটের মতো সারাবছরই খেলা তাই সেই আকর্ষণ যেমন আর নেই তেমনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শোনার চেয়ে লোকজন নিম্নাঙ্গ দেখতেই বেশি আগ্রহী !


এতো গেলো শহুরে লোকজনদের কথা, গাঁয়ে গঞ্জে তখন মূখ্য আকর্ষণ ছিলো যাত্রাপালা।

এ সব ভাবতে ভাবতে গ্রামের শীতের কথা মনে পড়ে যায়। শীতের সঙ্গে যাত্রার কি সম্পর্ক? যাত্রা গরমে হয় না কেন? দুটো প্রশ্নের উত্তর হাতড়াতে বেশি দেরি হয় না, শীত মানে তো শান্তির সময়। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, কেউ কান ধরে বলেনা পড়তে বোস !

গ্রামের শীত যারা দেখেনি, তারা কিন্তু অনেক কিছুই দেখেনি। ভোরবেলা খেজুর গাছে ঝুলছে হাঁড়ি, টুপটুপ করে জমা হচ্ছে রস৷ হাঁড়ির মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৌমাছি৷ খেতের মধ্যে পরপর লাগানো রয়েছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু। একটু উঁচু করে রাখা মাটির আল৷ সব গাছে জল দিতে হয় না, একটা জায়গায় জল দিলে তা গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যায় সব জায়গায়। ও দিকে সবুজ গাছের মধ্যে লুকিয়ে বেগুন, কড়াইশুঁটি, সেখানে পাতায় পাতায় গড়িয়ে পড়ছে শিশির৷ জল ভরে উঠেছে পেঁয়াজকলির আগায়, ফুলকপির পাতায়।শিশিরের এই বিন্দু বিন্দু ফোঁটা শীতের নিজস্ব ট্রেডমার্ক৷ 

ভরদুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে উঠোনে পাটি পেতে চলতো রোদ গায়ে মাখা৷ পরিবারের বয়স্কতম থেকে কনিষ্ঠতম, সেই রোদ পোহানোর খেলায় একবয়সী হয়ে যেতা৷ শীতের বিকেল ছোট, ওই রোদ পোহাতে পোহাতেই কখন যেন সন্ধ্যে নেমে আসতো। 

সন্ধ্যে হলে যাত্রার প্যান্ডেলে ভেঙে পড়ত গ্রাম৷ এক জন দু’জনকে রেখে পুরো পাড়া যাত্রার আসরে৷ টিনে ঘেরা প্যান্ডেলে ক্লারিওনেটের বাজনা জেগে থাকত ঈশ্বরের সুর হয়ে৷ একদিন নট্ট কোম্পানির বীনা দাশগুপ্ত গাইছেন, ‘আমার কানের পাশা হারিয়ে গেল ওই ঘোলা জলে’৷ পাশ থেকে খোকন বিশ্বাসের গলায় উঠে আসে পাল্টা সুর, ‘আমি ডুব দিয়ে ওই কানের পাশা আনব যে তুলে৷’ পরের দিন শান্তিগোপাল হিটলার হয়ে বলছেন, ‘মাত্র চারটে প্রশ্নের উত্তর দাও৷ তৃতীয় দিন হয়তো শেখর গাঙ্গুলি ও বর্ণালি ব্যানার্জি ‘ঝড়’ যাত্রায় ঝড় তুলছেন৷ সোনাই দীঘি যাত্রায় দিলীপ চ্যাটার্জি সংলাপ ছুড়ে হাসছেন, ‘আমার নাম ভাবনা কাজি!’ শেখর গাঙ্গুলি-বর্ণালি ব্যানার্জি, স্বপন কুমার-স্বপ্না কুমারী, পান্না চক্রবর্তী-চিত্রা মল্লিক, জোৎস্না দত্ত-গুরুদাস ধাড়া, অরুণ দাশগুপ্ত-বীনা দাশগুপ্ত জুটি গ্রামের কাছে তখন সিনেমার নায়ক নায়িকার থেকেও বেশি মর্যাদা পান৷ সকালে সংবাদপত্র খুললে শুধু যাত্রার বিজ্ঞাপন। 

যাত্রা করে ফিরতে গিয়ে যেদিন বীনা দাশগুপ্ত মারা গেলেন পথ দুর্ঘটনায়, সেদিন সত্যিই মনে হয়েছিল লক্ষী বিসর্জন হয়ে গেল৷ বীনা দাশগুপ্তকে বলা হত যাত্রালক্ষী৷

এখন তো গ্রামের ছেলেরা এ সব দেখে টেকে না, টিভিতে কার্টুন নেটওয়ার্ক রয়েছে। গ্রামের মেয়েরাও দেখে না যাত্রা,টিভিতে কুচুটে মার্কা সিরিয়াল তাহলে কে দেখবে ? 

অতীতে জলসার সময় গ্রামের মানুদা, সিধুজ্যাঠা, প্রসাদকাকা, রাধুদাদুরা সব এক হয়ে যেত, কে এই পার্টি, কে ঐ পার্টি সব চুলোয় যাক, ও সব পরে হবে ভোটের সময়। যাত্রা, গান, জলসার সময় আমরা এক৷ সারা রাত একসঙ্গে দেখব ছেলেমেয়ে, মা, বউ নিয়ে৷ সকালবেলা আবার পার্টির অনুষ্ঠান হলে একে অন্যের বিরুদ্ধে গলা ফাটাবো। সন্ধ্যে থেকে আবার সবাই এক, ঘাসের ওপর পাতা ত্রিপলের ওপর  বসে যাব একসাথে। ভালো জায়গায় বসে জলসা শুনতে হবে না?

আজ আর সেই গ্রামও নেই, নেই সে যাত্রাপালা। পড়ে রয়েছে শুধু রাজনৈতিক চাপানউতোর আর সাথে একরাশ ঘৃণা এবং অবিশ্বাস !

No comments