Header Ads

বেতার পদার্থবিজ্ঞানের পথিকৃৎ শিশির কুমার মিত্র || তৃতীয় পর্ব



১৯২৪ সালে ইংল্যান্ডের স্যার এডোয়ার্ড এপলটন ও স্যামুয়েল জ্যাকসন বারনেট বায়ুমন্ডলে কেনেলি-হেভিসাইডস্তরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন।এর পরের বছর আমেরিকার প্রফেসর ব্রেইট ও টুভে এই প্রতিফলক স্তরের উচ্চতা পরিমাপের একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।বেতার-তরঙ্গ আলোর বেগে চলে।ভূ-পৃষ্ঠ থেকে তরঙ্গ উৎক্ষেপণের সময় ও প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসার সময় পরিমাপ করতে পারলে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলক স্তরের উচ্চতা নির্ণয় করা যায় অতি সহজেই।তাঁরা একটি ট্রান্সমিটার থেকে ছোট্ট একটা বেতার-তরঙ্গ পাঠিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে রাখা একটি রিসিভারে প্রতিফলিত বেতার-তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে এলেন যে কেনেলি-হেভিসাইডপ্রতিফলক স্তরের উচ্চতা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে বিস্তৃত। পরবর্তী কয়েক বছরে স্যার এপেলটন এ ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধান চালান।তিনি বায়ুমন্ডলে আরো কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিফলক স্তরের সন্ধান পান।ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার উচ্চতার স্তরটির নামকরণ করা হয় এপলটন স্তর।পরে স্যার এপলটন কেনেলি-হেভিসাইডস্তরের নাম রাখেন ই-স্তর’ (E layer) এপলটনস্তরের নাম রাখেন এফ-স্তর’ (F layer)১৯২৮ সালে তিনি ই-স্তরের নিচে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৫০ থেকে ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে আরো একটি স্তর আবিষ্কার করেন।এই স্তর ডি-স্তর নামে পরিচিত। এপলটন তাঁর আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৪৭ সালে।

এপলটন যখন বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন স্তরের অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে নানারকম পরীক্ষা চালাচ্ছিলেনতখন তিনিও আগ্রহী হয়ে ওঠলেন এই কাজে।কাজের জন্য কয়েকজন মিলে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে যন্ত্রপাতি তৈরি করে ফেললেন।কলকাতা বেতার থেকে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও মিডিয়াম-ওয়েভ পাঠিয়ে পরীক্ষা চালানো হতো।১৯৩০ সালে কলকাতা থেকে ৭৫ মাইল দূরে রিসিভার রাখা হলো। তরঙ্গ পাঠিয়ে আয়োনোস্ফিয়ারে একটি প্রতিফলক স্তর ধরা পড়ল যা এপলটনের ডি-স্তরের উচ্চতার সাথে মিলে যায়। এটা ভারতে প্রথম সনাক্তকরণ। তাঁর এই আবিষ্কার ভারতের বেতার-পদার্থবিজ্ঞানে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এপলটন ডি-স্তরের প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি ডি-স্তর সম্পর্কিত আরো বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। আবহাওয়ার পরিবর্তন, ঝড়-বৃষ্টি বা ব্জ্রপাতের সময় বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন স্তরে কী কী পরিবর্তন ঘটে সে সম্পর্কিত অনেক পরীক্ষা করেন তিনি ও তাঁর তরুণ গবেষকরা।ই-স্তরের সঠিক অবস্থানও নির্ণয় করতে সক্ষম হন তারা।ভূ-পৃষ্ঠ থেকে মাত্র বিশ কিলোমিটার উচ্চতায় একটি নতুন প্রতিফলক স্তরের সন্ধান পান। তিনি এ স্তরের নাম দেন সি-স্তর।১৯৩০ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত নিরলস গবেষণা চললো তাঁর নেতৃত্বে। শুরুতে ইউরোপ আমেরিকায় বিজ্ঞানীরা কিছুটা নাক উঁচু ভাব নিয়ে থাকলেও পরে তাঁর কাজের স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁরা।১৯৩৬ সালে ম্যাক্সওয়েল সোসাইটি আয়োজিত কিংস কলেজের সভায় আমন্ত্রিত হলেন তিনি। সেখানে স্যার এপলটন সহ আরো সব বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী উচ্ছসিত প্রশংসা করলেন তাঁর গবেষণার।


ইংল্যান্ডের রেডিও-ফিজিসিস্টদের সাথে আলোচনা করে তিনি বুঝলেন রেডিও-ট্রান্সমিটিং সংক্রান্ত গবেষণা শুধুমাত্র কলকাতায় বসে করা সম্ভব নয়।রেডিও-ওয়েভ শুধু এক জায়গা থেকে ট্রান্সমিট করলে হবে না। দেশের আরো জায়গা থেকে গবেষণা করতে হবে।একটা ন্যাশনাল রেডিও রিসার্চ বোর্ড হওয়া খুব জরুরি। পরাধীন দেশে তাঁর কথায় কান দেয়ার মানুষ ব্রিটিশ সরকার নয়।কিংস কলেজে বক্তৃতার সময় পারস্পরিক সহযোগিতার কথা আলোচিত হয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে আরো আলোচনা ও সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে একটা ডিনারের ব্যবস্থা করলেন।স্যার এপলটন, রবার্ট ওয়াটসন-ওয়াট, নেচার সাময়িকীর সম্পাদক ডক্টর গ্রেগরি সহ আরো অনেক খ্যাতনামা বিজ্ঞানী এসেছিলেন সেই নৈশভোজে।ভারতে ন্যাশনাল রেডিও রিসার্চ বোর্ডের প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে নেচার পত্রিকায় সম্পাদকীয় বেরোল ভারতে রেডিও রিসার্চ বোর্ড তৈরি করবার এই-ই উপযুক্ত সময়।এই বিষয়ে গবেষণা এখনও তাঁর ও এলাহাবাদে অধ্যাপক সাহার মধ্যেই সীমিত রয়েছে।

মেঘনাদ সাহা এলাহাবাদ থেকেই সহযোগিতা করছিলেন তাঁর সাথে।তিনি ও মেঘনাদ সাহা মিলে জোর তদারকি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।কিন্তু বছর গড়িয়ে যায় কিছুই হয় না।১৯৩৮ সালে মেঘনাদ সাহা কলকাতায় ফিরে এলে তাঁদের চেষ্টা আরো জোরদার হয়।অবশেষে ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত হল আকাঙ্খিত বোর্ড।তিনি সেই বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।এরপর দায়িত্ব নিয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা।কলকাতার বাইরে হরিণঘাটায় একটা গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করেছিলেন তিনি।ভারতে এটিই প্রথম আয়োনোস্ফিয়ার ফিল্ড স্টেশন।

বায়ুমন্ডলের ই-স্তরের উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন তিনি। বায়ুমন্ডলে সক্রিয় নাইট্রোজেন ও আয়নের উপস্থিতি বিষয়ে অনেক গবেষণা কাজ করেছেন।বিখ্যাত নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে সেই গবেষণার ফল।বায়ুমন্ডলের উপরিভাগে কী করে নাইট্রোজেন তৈরি হয় তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তিনি।

তিনি কখনও গবেষণাকে শুধুমাত্র গবেষণাগারে সীমিত রাখার পক্ষপাতি ছিলেন না।নিজেই পরীক্ষাগারে সম্পূর্ণ দেশীয় যন্ত্রাংশ দিয়ে মাইক্রোফোন, লাউড স্পিকার তৈরি করেছিলেন।ইলেকট্রন টিউব তো আগেই তৈরি করতেন।রেডিও ট্রান্সমিটার, রিসিভার ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারেই সংযুক্ত করতেন।ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্প-কারখানার ব্যাপক প্রসারের স্বপ্ন দেখতেন তরুণ এই অধ্যাপক।

বিজ্ঞানের গবেষণার সুফল সাধারণ মানুষের কাজে লাগানোর জন্য বিজ্ঞান সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি।১৯৩৪ সালে তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশানের গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।১৯৩৫ ও ১৯৩৮ সালে তাঁর উদ্যোগে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়।১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশানের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন।১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অবস্থাতেও তাঁর বিশেষ উদ্যোগে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে কলকাতায়।১৯৫৪ সালে বরোদায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সর্বভারতীয় সভাপতি ছিলেন তিনি।ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স এর পরিচালনা পরিষদের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।অ্যাসোসিয়েশানের সেক্রেটারি, সহ-সভাপতি ও ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন সময়ে।১৯৩৫ সালে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশান প্রতিষ্ঠিত হবার শুরু থেকেই অ্যাসোসিয়েশানের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।সংগঠনের সাময়িকী সায়েন্স এন্ড কালচারএর প্রকাশ, প্রচার ও প্রসারে নিরলস ভূমিকা রেখেছেন তিনি।১৯৫১-৫২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন তিনি।

এটমোস্ফেরিক ফিজিক্সের জগতে তাঁর অবদানের কথা সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়তা হলো তাঁর রচিত বই দি আপার এটমোস্ফিয়ার।এই বইটির আগে বায়ুমন্ডল সম্পর্কিত এরকম পূর্ণাঙ্গ বই লেখা হয়নি।১৯৩৫-৩৬ সালে তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের সময়ে এরকম একটি বইয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন তিনি।দেশে ফিরেই কাজ শুরু করে দেন।তাঁর গ্রুপের রিচার্স ফেলো ও সহকর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন অধ্যায়ের জন্য তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেন।বইয়ের কাজ এগোতে এগোতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।ফলে বইটি শেষ হতে প্রায় দশ বছর লেগে যায়।১৯৪৭ সালে বইটির রচনা শেষ হয়।বায়ুমন্ডল সম্পর্কিত সমসাময়িক সমস্ত গবেষণার তথ্য ও তত্ত্ব এই বইতে সংযুক্ত হয়।স্যার এপলটন বইটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে জেনে এটাকে বীরোচিত উদ্যোগবলে প্রশংসা করেন।তিনি আশা করেছিলেন ইউরোপের বিখ্যাত প্রকাশকেরা বইটি প্রকাশ করার জন্য এগিয়ে আসবেন।কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী মন্দার কারণে হোক বা অন্য কোন কারণে হোক ইউরোপের কোন প্রকাশক বইটি প্রকাশ করতে রাজী হলেন না।নোবেল বিজয়ীর প্রশংসা-পত্রেও কোন কাজ হলো না।

অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা তখন এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি।এত ভালো এবং দরকারী একটা বই প্রকাশিত হবে না তা তিনি মেনে নিতে পারলেন না।তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে বইটি ছাপানোর ব্যবস্থা করলেন। বইটি প্রকাশের সাথে সাথে অকল্পনীয় সাড়া পড়ে যায়।প্রকাশের তিন বছরের মধ্যে দুহাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়।১৯৫২ সালে আরো বড় আকারে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।




No comments