Header Ads

বেতার পদার্থবিজ্ঞানের পথিকৃৎ শিশির কুমার মিত্র || প্রথম পর্ব


সে অনেককাল আগের কথা। কলকাতায় গড়ের মাঠে রামচন্দ্র ব্যানার্জি নামে এক যুবক বেলুনে চড়ে আকাশে উঠেছিল। কয়েকশো ফুট উঁচুতে উঠে কয়েক মাইল গিয়েছিল। গড়ের মাঠ থেকে বসিরহাট। এ নিয়ে একটা ছড়া প্রচলিত হয়ে গেল-"উঠল বেলুন গড়ের মাঠে, নামল গিয়ে বসিরহাটে।"


ছড়াটা লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে পৌঁছাল ছয় কি সাত বছরের এক বালকের কাছে। তখন থেকেই তাঁর মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করেছে-সব জিনিস উপর থেকে নিচে পড়ে যায়-কিন্তু বেলুন কেন উপরে উঠে যায়?


সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন রাশিয়ান মহাকাশ বিজ্ঞানীরা একটি মাত্র বইকে তাদের কাজের জন্য নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে সাথে রেখেছিল-দি আপার এটমোস্ফিয়ার।১৯৫৫ সালে বইটি সোভিয়েত সরকার রুশ ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করে।এই বইটি ছিল তাঁর লেখা।

১৯২০ সালে ইউরোপে যাবার সুযোগ পেলেন তিনি।প্যারিসের সারবোন ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে যোগ দিলেন প্রফেসর চার্লস ফেব্রির গ্রুপে। চার্লস ফেব্রি ১৯১৩ সালে বায়ুমন্ডলের উপরের স্তরে ওজোনের উপস্থিতি আবিষ্কার করে খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি সেই গ্রুপে থেকে কাজ করলেন তামার বর্ণালী নিয়ে। এই কাজের জন্যে তাঁর দ্বিতীয় ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করলেন সারবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৩ সালে। এরপর তিনি রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে গিয়ে মেরি কুরির গ্রুপে কাজ করলেন কিছুদিন। মাসখানেক পর প্যারিসের ন্যান্সি ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে যোগ দিলেন প্রফেসর গুটনের গ্রুপে। প্রফেসর গুটন তখন কাজ করছিলেন রেডিও ভাল্ব নিয়ে। প্রফেসর গুটনের গ্রুপের গবেষণা কাজ দেখে বেতার তরঙ্গ সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠলেন সেই বঙ্গসন্তান। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় জগদীশচন্দ্র বসুকে কাছ থেকে দেখেছিলেন বেতার তরঙ্গ নিয়ে কাজ করতে। অবচেতন মনে বিষয়টা সম্পর্কে আগ্রহ জন্মেছিল তখন থেকেই। এখন তা রীতিমত নেশায় পরিণত হল। রেডিও ভাল্ব নিয়ে সিরিয়াসলি কাজ শুরু করলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই ভিত তৈরি।কিন্তু কাজ করতে করতে খেয়াল হল রেডিও ওয়েভের কাজ শিখে যে কলকাতায় ফিরে যাবেন সেখানে তো এখনো রেডিও-ফিজিক্সের কোন গবেষণা দূরে থাকুক রেডিও-ফিজিক্স পড়ানোও হয় না। মনে মনে ঠিক করলেন কলকাতায় ফিরে নিজেই রেডিও-ফিজিক্স পড়ানো শুরু করবেন। উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জিকে চিঠি লিখলেন তিনি। লিখলেন ফিজিক্সের এম-এস-সি কোর্সে রেডিও-ফিজিক্স বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

স্যার আশুতোষ মুখার্জি সম্মতি জানালেন। ১৯২৩ সালে ফ্রান্স থেকে ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদে যোগ দিলেন তিনি।বেতার যোগাযোগ সংক্রান্ত পদার্থবিজ্ঞান বা রেডিও-ফিজিক্স বিষয়ক পড়াশোনা ও গবেষণা শুরু করার দায়িত্ব নিলেন তিনি।ভারতবর্ষে প্রথম এই বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে যোগ হল।

যন্ত্রে রিসার্চ করে না বয়েজ। রিসার্চ করে মানুষে। উপযুক্ত মানুষ থাকলে টাকা, যন্ত্র সব চলে আসবে।তাই একসময় গবেষণার কাজ কমিয়ে ছাত্র তৈরিতে উঠে পড়ে লাগলেন।আয়নোস্ফিয়ার এর গঠন মাপার জন্যে আয়নোসান্ড যন্ত্র নিজে বানিয়ে লাগিয়েছিলেন হরিণঘাটা ফিল্ড স্টেশনে। গোটা পৃথিবীতে তখন এরকম যন্ত্র ছিল মাত্র ছয়টি। ঐরকম এক বিশ্বমানের যন্ত্রের ডাটা সংগ্রহের কাজ নির্দ্বিধায় ছাত্রদের হাতে তুলে দিলেন। ছাত্রছাত্রীরা পেপার লিখলেন। তিনি নিজের নাম অবধি দিলেন না সেই পেপারে। সেই পেপার যেদিন ছাপা হল, তিনি কে সি দাসের রসগোল্লা আনিয়ে বিভাগের সকলকে খাইয়েছিলেন। বারবার বলতে লাগলেন "তোমরা আজ আমার মুখ উজ্জ্বল করলে। শিক্ষক হিসাবে আজ আমি ধন্য।" অথচ তাঁর নিজের পেপার সংখ্যা তখন দেড়শোর উপর।তিনি বাংলার গর্ব বিজ্ঞানী শিশির কুমার মিত্র।

জন্ম ১৮৯০ সালের ২৪ শে অক্টোবর কলকাতায়।বাবা জয়কৃষ্ণ মিত্র স্কুল শিক্ষক।মা শরৎকুমারী দেবী ডাক্তার।১৮৯২ সালে ডাক্তারি পাশ করলেন শরৎকুমারী। চাকরির সুযোগ পেলেন বিহারের ভাগলপুরে লেডি ডাফরিন হাসপাতালে।স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেন জয়কৃষ্ণ। পাড়ি দিলেন ভাগলপুরে।জয়কৃষ্ণ ভাগলপুর পৌরসভায় কেরাণীর চাকরি নিলেন।

ভাগলপুর জেলা স্কুলে তাঁর পড়াশোনার শুরু।দিন ভালোই কাটছিল। হঠাৎ নেমে আসল বিপর্যয়। তাঁর বড় দুভাই সতীশকুমার আর সন্তোষকুমার মারা গেল। নিজে ডাক্তার হয়েও মা তেমন কিছু করতে পারলেন না। বাবা জয়কৃষ্ণ এ শোক সহ্য করতে পারলেন না।খুবই ভেঙে পড়লেন।হার্ট অ্যাটাক হল।পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় পড়ে রইলেন।পুরো সংসারের দায়িত্ব এসে পড়লো একা মায়ের ওপর।

স্কুলের পড়াশোনা বন্ধ হবার জোগাড়। কিন্তু শক্ত হাতে হাল ধরলেন মা শরৎকুমারী। বাড়ির গুমোট পরিবেশে দিনরাত পড়াশোনায় ডুবে থাকল সেই ছেলেটি। এন্ট্রান্স পাশ করার পর ভাগলপুরের টি-এন-জে কলেজ থেকে এফ-এ পাশ করল।দীর্ঘ রোগভোগের পর বাবা জয়কৃষ্ণ মারা যান।ছেলেটি ভাবল পড়াশোনা আর না করে একটা চাকরি নিয়ে মায়ের বোঝা হালকা করবেন। মাকে বললেন কথাটা। কিন্তু মা শরৎকুমারী ছিলেন অন্য ধাতুতে তৈরি। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি করে দিলেন ছেলেকে।


তথ্য-উইকিপিডিয়া, প্রদীপ দেবের মুক্তমনা ব্লগ


No comments