Header Ads

ভারতে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারের অন্যতম পথপ্রদর্শক ঈশানচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়


বর্তমান যুগে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের ভারতের মতো 'নানা ভাষা, নানা মতের' রাষ্ট্রেও ইংরেজি এক ভাষার মানুষের সাথে অপর ভাষার মানুষের যোগসূত্র ঘটিয়ে থাকে। আমরা যতই হিন্দির যোগসূত্রতা নিয়ে প্রশংসায় শামিল হই না কেন, এ কথা মানতেই হয় যে হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয়। আর হিন্দির প্রসারতা বা যোগসূত্রের মিলন ঘটানোর বিষয়টা সব ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে না। তাই, ইংরেজির শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনও গতি থাকে না। তাই, মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজির মাহাত্ম্যও স্বীকার করতে হয়। আচ্ছা, ইংরেজি নিয়ে আমরা এত কিছু বলছি কেন? উপরে উল্লেখিত কথাগুলো তো আমরা সবাই জানি তবুও আবার কেন লেখা? কেননা, আজকে আমরা আলোচনা করব এমন একজন ব্যক্তিকে নিয়ে যিনি ছিলেন এদেশে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে অন্যতম অগ্রণী।


পশ্চিমবঙ্গের হুগলি রাজ্যের এক প্রাচীন জনপদের নাম হল গুপ্তিপাড়া। এমনকি ১৭৭৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জরিপবিদ ও প্রকৌশলী জেমস রেনেল কৃত রেনেলের মানচিত্রে দেখা যায় বেহুলা নদী গুপ্তিপাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে ভাগীরথী বা গঙ্গায় গিয়ে মিশেছে। এই গুপ্তিপাড়াতেই প্রথম বারোয়ারি পূজার প্রচলন হয়। বারোজন ব্যক্তি ১৭৬০ কি ১৭৯০ সালে স্থানীয় সেন রাজাদের প্রচলিত দূর্গাপুজোয় অংশগ্রহণ না করে নিজেরাই পুজো করার মনস্থির করেন। তাঁদের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় বিন্ধ্যবাসিনী বারোয়ারি পুজো। ঘটনাটি নিশ্চয় ব্যতিক্রমী, এতে সন্দেহ নেই। আমাদের এই প্রবন্ধের নায়কও ব্যতিক্রমী। এই গুপ্তিপাড়াতেই ছিল প্রচুর সংস্কৃত ভাষার শিক্ষাকেন্দ্র বা টোল। আর তাই, অনেক টোল পণ্ডিত এবং শিক্ষাবিদদের বসবাস ছিল এই গুপ্তিপাড়ায়। আমাদের প্রবন্ধের নায়কও একজন পণ্ডিত ব্যক্তি এবং বিখ্যাত শিক্ষাবিদ। গুপ্তিপাড়ার শিক্ষার পরিবেশ তাঁর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল বলাই যায়। 

যাইহোক, আর ভণিতা না করে আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি সম্পর্কেই আসা যাক। তাঁর নাম ঈশানচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। ১৮১৪ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর হুগলীর গুপ্তিপাড়াতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন বদনচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। আগেই বলা হয়েছে, যে ঈশানচন্দ্র ছিলেন এদেশে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারে অন্যতম পথপ্রদর্শক। শুধু ইংরেজি নয়, ফারসী, ল্যাটিন, গ্রীক ভাষাতেও তিনি ছিলেন দক্ষ। আর শুধু কি ভাষা? ঈশানচন্দ্র বিজ্ঞানের বিষয় যেমন গণিত, রসায়ন এমনকি জ্যোতির্বিজ্ঞানেও ছিলেন বিশেষ জ্ঞানী ব্যক্তি।

১৮৩৩ সাল থেকে ১৮৭২ এই দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরের শিক্ষকতার জীবন তিনি অতিবাহিত করেছিলেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়িয়ে, বিভিন্ন উজ্জ্বল ছাত্র গড়ে তুলে এবং দেশে শিক্ষাবিস্তার ঘটিয়ে। ঈশানচন্দ্র জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউট, হাজারীবাগ উইনকিনসন্স স্কুল, বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ, কৃষ্ণনগর কলেজ, হুগলী কলেজ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছিলেন। তবে এতগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থাকলেও তাঁর সবচেয়ে বেশি পরিচয় হয় হুগলী কলেজের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শিক্ষক ও স্থপতি রূপে। তিনি মূলত ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যাপনা করতেন। পরাধীন ভারতে ইংরেজ সাহেবদের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা করে এক বিশেষ ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আর একইভাবে ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছিলেন ঈশানচন্দ্র। সে যুগে নিজের বিষয়ের সীমানা পেরিয়ে অন্যান্য বিষয়গুলোতেও সমান পারদর্শীতা অর্জন করে তিনি ব্যতিক্রমের উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। আসলে, তিনি নিজেকে কেবলমাত্র ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, দর্শন সহ বিভিন্ন বিষয়ে ছিলেন সুপণ্ডিত। ইংরেজি, বাংলা এমনকি ফারসী ভাষাতেও প্রচুর প্রবন্ধটি তিনি লিখেছিলেন। যদিও ইংরেজি প্রবন্ধকার হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল বেশি। তিনি 'জোরিয়ান (Zorian)' ছদ্মনাম রেখে সে যুগের অনেক পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁর মতো তাঁর ভাই মহেশচন্দ্রও ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও লেখক।

এবার আসি ঈশানচন্দ্রের কৃতি নক্ষত্রস্বরূপ কিছু ছাত্রের কথায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছাত্ররা হলেন— সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরেন ঘোষ, সাহিত্যিক গঙ্গাচরণ সরকার, শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র দাশ, বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্র, আইনশাস্ত্রবিদ সৈয়দ আমীর আলী, প্রত্নতত্ত্ববিদ নন্দলাল দে, বঙ্গবাসী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ এবং এদেশে কৃষিবিদ্যা তথা বিজ্ঞানশিক্ষার অন্যতম পথপ্রদর্শক এবং বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় অন্যতম উদ্যোগী ব্যক্তি গিরিশচন্দ্র বসু। এছাড়াও আরও অনেক কৃতি নক্ষত্র। ১৮৯৩ সালের ১৬ই জুন ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারের অন্যতম পথপ্রদর্শক তথা সুপণ্ডিত ঈশানচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় আমাদের ছেড়ে চলে যান। তবে, অত বছর আগে থেকে তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন যে বাঙালি কখনও কোনও ভাষার সংকীর্ণতায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেনি বা ফেলতে চায়নি।

প্রতিবেদন- ইন্দ্রনীল মজুমদার 

তথ্যসূত্রঃ– সংসদ বাংলা চরিতাভিধান, উইকিপিডিয়া,
বাংলাপিডিয়া।


No comments