Header Ads

গড়বেতার বিপ্লবী বসন্তকুমার সরকারের আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের রোমহষর্ক কাহিনী আজও বিস্মৃত বাঙালির কাছে


বিপ্লবের মাটি মেদিনীপুর। যেখানে জন্ম নেন ক্ষুদিরাম ও প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য্যের মতো শত শত বিপ্লবী৷ দুই মেদিনীপুরের আনাচে-কানাচে রয়েছে বহু বিপ্লবীদের জন্মস্থান। যাদের কথা আমরা আজকে অনেকেই ভুলে গেছি। আমাদের স্বাধীন করার জন্য যারা গেয়ে গেল জীবনের জয়গান তাদের নিয়ে আজকাল খুব একটা আলোচনাও হয়না। তাই মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের নিয়ে এখন থেকে নিয়মিত  আলোচনা করা হবে লিটারেসি প্যারাডাইসের পাতায়৷ আসুন আজকে নেওয়া যাক পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতার এক মহান বিপ্লবীর কথা।  


গড়বেতা বললেই গনগনি, সবুজ শাল ও কাজু বাদাম জঙ্গল, অচল সিংহ ক্রীড়াঙ্গন, শিলাবতী নদী ও সর্বমঙ্গলা মন্দিরের কথা সবার প্রথমে উঠে আসে। এই গড়বেতার বুকেই জন্মেছিলেন বীর বিপ্লবী বসন্তকুমার সরকার। ১৮৮৬ সালের ১৮ ই মে গড়বেতা থানার অন্তর্গত সন্ধিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন কাতরাবালি গ্রামে ভূমিষ্ঠ হন তিনি। তাঁর বৈপ্লবিক জীবন ছিল অত্যন্ত রোমহষর্ক। আজও সন্ধিপুর এলাকার মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে তাঁর জীবনের গল্পকথা। তিনি যে কত বড় বীরপুরুষ ছিলেন তা গ্রামবাসীদের সাথে কথা না বললে বোঝা যাবে না। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে অসীম সাহস ও নির্ভীকতার পরিচয় রাখেন তিনি। 

শোনা যায়, বসন্তকুমার সরকারের ভয়ে ব্রিটিশদের চোখে ঘুম উড়ে যেত৷ সন্ধিপুরের উত্তর দিকে কাদড়া নামক স্থানে যে মেদিনীপুর জমিদার কোম্পানির সদর কাছারিবাড়ি ছিল সেখানে নাকি পৌষের শীতের বিকেলবেলায় সাহেবরা মেমদের নিয়ে বেড়াতে আসতো। যদি এই সময় তাদের কেউ বলতো যে বসন্ত সরকার আসছে তাহলে তারা লোকানোর পথ খুঁজে পেত না।

১৯০৩ সালে গড়বেতা স্কুলে পড়ার সময় কালী রায় নামের এক ইতিহাস শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় তিনি ক্রমশ ব্রিটিশ বিরোধী হয়ে ওঠেন। বাংলার অসহায় চাষীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার, মহারাজ নন্দকুমারকে কীভাবে অন্যায়ভাবে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে, কেমন করে ব্রিটিশরা গ্রামে-গঞ্জে নিপীড়ন ও নির্যাতন চালাচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর প্রভৃতি কাহিনী কালীবাবুর মুখ থেকে শুনেছিলেন তিনি। যা শোনার পর থেকেই তাঁর সারা শরীরের মধ্যে ক্রোধের অগ্নি বিস্ফোরণ হতে থাকে।

লর্ড কার্জনের নির্দেশে ১৯০৫ সালে জারি হলো বাংলাকে ব্যবচ্ছেদ করার আইন। যার ফলে বারুদের বিষবাষ্পে জ্বলে উঠলো বঙ্গদেশ। একইসাথে শুরু হলো স্বদেশী আন্দোলন। বাংলার আকাশে-বাতাসে তখন একটাই রব ব্রিটিশদের পণ্য প্রত্যাহার করতে হবে। বাংলার সর্বত্র শুরু হলো পিকেটিং, আন্দোলন ও বিলিতি কাপড় পোড়ানোর মহোৎসব। এসব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেই বসন্তকুমার সরকার ব্রিটিশ উচ্ছেদ সাধনে সর্বশক্তি নিয়োগ করার দৃঢ় সংকল্প নেন।

বর্ধমান রাজ কলেজে বি এফ পড়ার সময় বংশগোপাল টাউন হলে নিজের কর্ণে শ্রবণ করলেন জে.এন রায় ও বিপিনচন্দ্র পালের সুললিত কণ্ঠের জ্বালাময়ী বক্তব্য, দেশপ্রেমের আগুন তখন তাঁর সারা শরীরে টগবগ করে ফুটে উঠলো। এরপর তিনি নাম লেখালেন বিপ্লবীদের দলে। কাজ করতে গিয়ে উপলব্ধি করলেন ব্রিটিশ তাড়াতে হলে সবার আগে প্রয়োজন শারীরিক শক্তির সঞ্চয় এবং সংগঠন গড়ে তোলা। তাই বর্ধমানের আর্য মেসে থাকাকালীন তিনি পূর্ণ মোদক, ব্রজ মাহাত প্রভৃতি ছাত্রদের নিয়ে স্থাপন করলেন লাঠি খেলার আখড়া। শুধু শহরে নয়, প্রত্যন্ত গ্রামের বুকেও এই সংগঠন গড়ে তোলার উদ্দেশ্য সামনে রেখে সতীশ অগস্তি, হাবু অগস্তি, মনু ভট্টাচার্য, অরোধ দে, ফণী সিংহ, নীলু হাজরা, প্রভাকর চৌধুরী, চণ্ডী পাল, রাজেন্দ্র ঘটক, সুরেন্দ্র চক্রবর্তী প্রভৃতি যুবকদের নিয়ে নিজ গ্রাম কাতরাবালি সহ গড়বেতার বাঁশদা, বলদঘাটা, বড়াই, সন্ধিপুর ইত্যাদি বিভিন্ন এলাকায় লাঠি খেলার আখড়া বানালেন।

এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বি.এ পড়তে এসে তিনি যুক্ত হন অনুশীলন সমিতির সঙ্গে। এখানে এক হস্টেলে থাকার সময়ই ইতালিয়ান বিপ্লবী ম্যাৎসিনী ও গ্যারিবল্ডির ভাবধারা ও তাঁদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সতীশ সেনগুপ্ত, পঞ্চানন, অমর চ্যাটার্জি, কালী বাড়ুজ্যে, আশু দাস প্রভৃতি সমবয়সী ছাত্র ও যুবকদের সঙ্গে ইডেন হিন্দু হস্টেলের নিচতলার একটি ঘরে ম্যাৎসিনী সোসাইটি স্থাপন করেন৷ আর এখান থেকেই নিয়মিত তিনি শিখতে থাকেন বক্সিং ও যুযুৎসু এবং তলোয়ার খেলা। আর এখানে থাকার সময়ই বসন্ত সরকার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, যোগেন্দ্র ঠাকুরের মতো দেশবরেণ্য নেতা ও বিপ্লবীদের সান্নিধ্যে আসেন তিনি৷ 

১৯০৮ সালে হঠাৎ করে অনুশীলন সমিতিতে নিদারুণ অর্থাভাব লক্ষ্য করা যায়। যার ফলে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই বিশাল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের জন্য খুলনা, যশোহর ও বাংলার বহু স্থানে আরম্ভ হয় রাজনৈতিক ডাকাতি। অনুশীলন সমিতির সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিলেন ২ রা জুন রাতের বেলায় ঢাকার 'বারহা' বাজার লুট করবেন। এর পূর্বদিন অর্থাৎ ১ লা জুন বোমা, বন্দুক ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাবার দায়িত্ব এসে পড়ে বসন্ত সরকারের ঘাড়ে। তাঁর সঙ্গী হিসেবে যোগ দিলেন বাঁকুড়ার শৈলেন চক্রবর্তী। ট্রেনে ও নৌকাতে করে বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দিয়ে বারহা বাজারে পৌঁছালে সেখানে তিনি একটি মাত্র উইনচেস্টার রাইফেলের ওপর ভর করে প্রধান ঘাঁটি আগলাবার দায়িত্ব আবারো নিজের কাঁধে তুলে নিলেন৷ এই রাইফেলের সাহায্যেই সে যাত্রা তিনি পার হয়ে যান এবং অস্ত্র বোঝাই একটি ট্রাঙ্ক নিয়ে আবার হস্টেলে ফিরতে সক্ষম হন তিনি। 

১৯০৭ সালে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এলেনকে স্টীমারে হত্যা ছক কষেন বিপ্লবীরা। আক্রমণকারী সাঁতার দিয়ে মেঘনা নদী পার হয়ে এলেও ব্রিটিশদের কু-দৃষ্টি এড়ানো সম্ভবপর হলো না। আক্রমণকারীর বাড়ি ছিল ময়মনসিংহে। পরবর্তীকালে তাঁকে ডাকা হতো নলিনী সরকার নামে। 

১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বর, ভারতের বিপ্লবীদের সাহায্যের  জন্য জার্মানি থেকে ম্যাভেরিক নামক একটি আগ্নেয়াস্ত্র ভর্তি জাহাজ ওড়িশার বালেশ্বর উপকূলের দিকে রওনা দিয়েছে। এই অস্ত্রশস্ত্রগুলো উদ্ধারের জন্য একটা নীল নকশা প্রস্তুত করেন নীরেন দাশগুপ্ত, বাঘাযতীন, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও জ্যোতিষ পালের মতো বিপ্লবীরা। অস্ত্রশস্ত্রগুলো উদ্ধার করে চাঁদবালীতে গোপনে লুকিয়ে রাখার ভার এসে পড়ে বিপ্লবী বসন্ত কুমার সরকারের ওপর। দূর্ভাগ্যবশত কোনো কারণে নির্দিষ্ট স্থানে জাহাজটি পৌঁছাল না। কারণ তার আগে বুড়িবালামের যুদ্ধে নিহত হলেন বাঘাযতীন, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, নীরেন দাশগুপ্ত ও জ্যোতিষ পাল। 

বুড়িবালামের যুদ্ধের ঠিক কয়েক মাস পর, মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল দখল করার সিদ্ধান্ত নিলেন বসন্ত কুমার সরকার বিপ্লবী তারাপদ মুখোপাধ্যায়, বিপিন হাজরা, মনু ভট্টাচার্য্য, পঞ্চানন ও রাঘব সরকারদের সঙ্গে নিয়ে। এই ষড়যন্ত্রেরও নীল নকশা ফাঁস হওয়ার ফলে বানচাল হয়ে যায় তাঁদের মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল দখলের বিশেষ কাজটি। 

বোমা তৈরি, বিপ্লবীদের সাহায্যার্থে রাজনৈতিক ডাকাতি, বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে ব্রিটিশ রাজশক্তি তাঁকে বহুবার কারাগারে বন্দী করেছেন। ১৯১০ সালে তাঁকে ব্রিটিশ বিরোধী রণ সংগ্রামে লিপ্ত থাকার অপরাধে প্রেসিডেন্সী জেলে পাঠানো হয়। খুলনা-যশোহর গ্যাং কেসে জড়িত থাকার অজুহাতে ১৯০৯ সালে কলকাতা ও বাংলার অন্যান্য স্থান থেকে বসন্ত সরকার সহ ৮৮ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ব্রিটিশ পুলিশ তাঁর কাতরাবালির বাড়িতে ফৌজ পাঠিয়ে বাড়ির সমস্ত আসবাবপত্র ফেলে ছড়িয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়৷ ১৯২২ সালে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে তাঁকে মাস ছয়েক আটকে রাখা হয়। ১৯৩০ সালে বাড়িতে বোমা বানানোর অজুহাতে একটি বিশেষ কেস সৃষ্টি করে ব্রিটিশরা বসন্ত সরকার এবং তাঁর ভাইপো বিনয়কে শাস্তি দেয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আরো বহুবার তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। কখনো বাগেরহাট, কখনো সাতক্ষীরা, কখনো বা কাকদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে তিনি কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। 

হাজার কারাগারের বেড়ি, তাঁর প্রতি ব্রিটিশদের শত লাঞ্ছনা কখনোই তাঁকে পারেনি স্বাধীনতার বিপ্লব থেকে সরিয়ে দিতে। নিজের জীবনের থেকেও তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম। 'স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়।'-- এই মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। শত্রুর কাছে তিনি কখনো মাথা নত করেননি। একবার প্রেসিডেন্সী জেলে বড়লাট রাজবন্দীদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য জেল পরিদর্শনে আসেন। বসন্ত সরকারের কাছে এসে বড়লাট জিজ্ঞেস করলেন, "How are you?" তিনি বারুদের মতো জ্বলে উঠে দৃঢ় কণ্ঠে স্পষ্ট জবাব দিলেন, "Don't you feel ashamed? What we have done? We wanted freedom only and we received in human beast like treatment and you put us in dark cells. For the last one year we were not even allowed to see anybody." 

১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগী আন্দোলনে তিনি প্রভাবিত হলেও 'অগ্নিযুগের স্মৃতিকথা' গ্রন্থে লিখেছেন, "১৯২৫ সাল হইতে ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীজীর অহিংসাবাদ প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। বিপ্লবীরাও অনেকে গান্ধী প্রভাবিত কংগ্রেসে যোগ দিতে থাকেন, কিন্তু অহিংসাকে কখনোই তাহারা মনে প্রাণে বরণ করিতে পারেন নাই। তাঁহারা বরাবরই সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিতেন।"

এই মনোভাবের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায় ১৯২৯ সালে লাহোর কংগ্রেস অধিবেশনে, যেখানে তিনি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যান। যার উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ভারতের বুকে দ্বিতীয়বার ঘটতে না দেওয়া। তাই তিনি প্রস্তুত ছিলেন। এরকম বহু ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তিনি। সারাজীবন দেশের স্বাধীনতার জন্য নির্ভীকভাবে জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য তিনি লড়ে গেছেন। প্রতিটি বাঙালির উচিৎ বসন্ত কুমার সরকারের মতো বিপ্লবীদের স্মৃতিকে রক্ষা করা।

প্রতিবেদন- সুমিত দে 

তথ্যসূত্র- সংসদ বাংলা চরিতাভিধান, মেদিনীপুর ডন ইন ৷


1 comment:

  1. vr music playlist - YouTube, CCK, Vimeo
    Download the playlist Vr Music Videos MP3 free. online youtube to mp3 Play free Vr Music Videos for free on Vr. Listen to more free Vr Music Videos.

    ReplyDelete