Header Ads

ঋত্বিক ঘটক বাংলা তথা ভারতীয় ছবিকে যা দিয়েছেন তার লভ্যাংশ বোধহয় তিনি নিজেও পান নি!


কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের অনবদ্য সৃষ্টি 'মেঘে ঢাকা তারা'র পাহাড়ের কোলে টি বি স্যানাটোরিয়াম, সেখানে নীতা দাদার হাত ধরে চিৎকার করে ওঠে , 'দাদা আমি বাঁচব’।

কে পারবেন নিজের চোখের জল ধরে রাখতে! অথবা কার চোখে জল আসবে না?


প্রবাদপ্রতিম চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক সোজা চলে গিয়েছিলেন সুপ্রিয়া দেবীর বাড়িতে, বলেছিলেন ওই আজ্ঞে, আপনি এসব তিনি তাকে বলতে পারবেন না, সুপ্রিয়া তাঁর ছোট বোনের মত৷ এরপরে তাঁর অনুরোধ 'মেঘে ঢাকা তারা'র নীতা চরিত্রটি যেন তিনি অভিনয় করেন৷ একই সঙ্গে বলেছিলেন খুব ভালো রোল, মেকআপ ছাড়া, চরিত্রটি একটি রিফিউজি মেয়ের, যার জীবন খুব কষ্টের৷

সুপ্রিয়া দেবী তখন একপ্রকার আনকোরা বলা যায়, 'আম্রপালী' ছবি করছেন সেইসময় তাঁর পরিচয় হয় ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে৷ ঋত্বিকের প্রস্তাবে তিনি সেদিন সম্মতি দিয়েছিলেন বলেই বোধহয় আমরা দেখেছিলাম সম্ভবত সুপ্রিয়া দেবীর জীবনের সেরা অভিনয় বাঁচার জন্য আকুল আকুতি 'দাদা,আমি বাঁচব'৷

'মেঘে ঢাকা তারা’র নীতা সংসারের জন্য, দাদার জন্য, বোনের জন্য, মায়ের জন্য, বাবার জন্য নিজেকে নিঃশেষ করে দিল, নিজের প্রেমিক সরে গিয়েছিল বোনের দিকে, মা আসকারা দিলেন সেই ঘটনাকে, বড় গায়ক হবে গানপাগল দাদা, সংসারের জন্য নিঃশেষ হওয়া মেয়ের মুখ দিয়ে কাশির সাথে রক্ত বেরিয়ে আসে (টি বি)৷ উদ্বাস্তু পরিবারের দাদাকে রেখে আসতে হয়েছিল বোনকে টিবি স্যানাটোরিয়ামে, সেখানে নীতা দাদার হাত ধরে চিৎকার করে ওঠে, 'দাদা আমি বাঁচব’। সকলকে কাঁদিয়ে ছবির নীতা  মরে গেল৷

ঋত্বিক ঘটকের 'মেঘে ঢাকা তারা' ভারতীয় সিনেমার সর্বকালের সেরা ছবির তালিকায় চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে, কিন্তু ছবির নীতা মরবে নাকি বাঁচবে সেই নিয়ে মহেন্দ্রজির (জনতা ডিস্ট্রিবিউটরের মালিক) সঙ্গে ঋত্বিকের নিত্য কথা কাটাকাটি হত৷ যেহেতু 'মেঘে ঢাকা তারা'র নীতা বাঁচবে কি মরবে সেই নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে মহেন্দ্রজির কথা কাটাকাটি লেগে থাকত সেজন্য ছবির দুভাবে শুটিং হয়েছিল৷ আরও অদ্ভুত একটি তথ্য হল নীতার মৃত্যুর দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল আগেই, সেই নিয়ে সুপ্রিয়া দেবীও মনখারাপ করেছিলেন, তাঁর মনে হতো, মৃত্যুর দৃশ্য শেষে শুটিং হলে ভাল হত৷ কিন্তু বিতর্ক ছিল নীতার বাঁচা আর মরা নিয়ে৷ ঋত্বিকের বক্তব্য নীতা বেঁচে কি করবে! সেইজন্য দু'ভাবে শুটিং হয় 'মেঘে ঢাকা তারা'র৷ পুরো ছবি হয়ে যাবার পর দেখা গেল ঋত্বিক সঠিক, অতএব নীতা মরে গেল সবাইকে কাঁদিয়ে৷

মোটেও সহজ ছিল না 'মেঘে ঢাকা তারা'র শেষ দৃশ্যের চিত্রায়ণ, প্রায় আনকোরা এক অভিনেত্রীকে দিয়ে সেদিন জীবনের সেরা অভিনয় বের করে এনেছিলেন যিনি নতুন করে বলতে হবে না তিনি কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক৷ সত্যজিৎ রায় একবার তাঁর সম্পর্কে  বলেছিলেন 'ঋত্বিক মনেপ্রাণে বাঙালি পরিচালক, তেমনি ঋত্বিকের ছবির নায়িকাদের সম্পর্কে বলা যায় তারা মনে প্রাণে সেই বাঙালি যারা দাঙ্গা দেখেছে, মন্বন্তর দেখেছে, রাজনীতির ডামাডোল দেখেছে, দেখেছে দেশভাগ'৷ নীতা, অনুসূয়া ও সীতা তাঁর তিনটি ছবি যথা 'মেঘে ঢাকা তারা', 'কোমল গান্ধার' ও 'সূবর্ণরেখা'র নায়িকা৷ তিনটি ছবি ভারতীয় সিনেমায় একপ্রকার ভূকম্পন ঘটিয়েছে৷ সিনেমা ভাবনার দিক থেকে শুরু ওই 'মেঘে ঢাকা তারা' পরে 'কোমল গান্ধার'ও 'সূবর্ণরেখা'৷ 

ঋত্বিক ঘটককে মূল্যায়ন করার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা আমার নেই, একরাশ মুগ্ধতা, শ্রদ্ধা আছে, থাকবে নিরন্তর৷ আর সেইজন্য অনেকের মনে হয় তিনি বোধহয় সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা মানুষ, হয়তো সেই জন্যই ঋত্বিকের অন্ধকার, অসম্পূর্ণ জায়গাগুলোই দুনিয়ার কাছে আজ আলোচ্য বিষয়। এই প্রসঙ্গে ঋত্বিকের দুটি ছবির কথা অবশ্যই বলতে হয় দুই বাংলার মেলবন্ধনের গল্প 'তিতাস একটি নদীর নাম' ও 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো' সেখানে অবশ্য নায়িকারা কিঞ্চিৎ নিষ্প্রভ৷

ঋত্বিক ঘটক বাংলা সিনেমাকে, ভারতীয় সিনেমাকে যা দিয়েছেন তার ডিভিডেন্ড তিনি নিজে বোধহয় পান নি! অবশ্য সুপ্রিয়া দেবীর নাম লেখা থাকবে সোনার জলে অন্তত দুটি ছবিতে তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের জন্য, প্রথমটি যদি হয় 'মেঘে ঢাকা তারা', পরেরটি অবশ্যই 'কোমল গান্ধার'৷ সেই দুটি ঋত্বিক প্রণীত৷ সন্দেহের অবকাশ নেই 'কোমল গান্ধার'-এর আগে ও পরে সুপ্রিয়া অনেক ছবিতে অভিনয় করলেও 'মেঘে ঢাকা তারা' আর 'কোমল গান্ধার'-এর জন্য তিনি অনন্যা৷

প্রতিবেদন- অরুণাভ সেন

তথ্যসূত্র- চলচ্চিত্র কথকতা; চণ্ডী মুখোপাধ্যায়


No comments