ভারতের প্রথম ডিজিটাল কম্পিউটার তৈরি করেছিলেন এক বাঙালি গণিতবিদ
কম্পিউটার যে বস্তুটির গুরুত্ব সম্পর্কে আজ সকলেই অবহিত। কম্পিউটারের প্রয়োজনীয়তা আর নতুন করে বলার কিছুই নেই। প্রত্যেকটি মানুষ কোনো না কোনো ভাবে প্রতিদিন কম্পিউটার ব্যবহার করছেন সেটা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হোক বা স্মার্টফোনের মাধ্যমে। এই যুগান্তকারী বৈপ্লবিক যন্ত্রটি ভারতে প্রথম তৈরি হয় এক বাঙালি গণিতবিদের হাত ধরে। এই কম্পিউটারটি তৈরি হয়েছিল বাংলার দুই বিশ্ববিদ্যালয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট কোলকাতার তত্ত্বাবধানে। এই কম্পিউটার তৈরি করেন ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে সমরেন্দ্র কুমার মিত্র।
ভারতের প্রায় প্রত্যেকটি জটিল যন্ত্রপাতি বা বৈজ্ঞানিক কাজে বাঙালি সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সমরেন্দ্র কুমার মিত্রের এই বৈজ্ঞানিক কাজটিও বাঙালির বুদ্ধির জোরকেই প্রকাশ করে। ভারতের প্রথম অ্যানালগ কম্পিউটার তৈরির জন্য সমরেন্দ্র কুমার মিত্রকে কলকাতা গাণিতিক সমিতি 'ভারতের কম্পিউটারের জনক' বলে সম্মানিত করে। এই কাজের জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার হিস্ট্রি মিউজিয়াম অফ কম্পিউটারে ওনার জীবনী লিখে রাখা হয়েছে।
তিনি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ই মার্চ কলকাতা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ওনার পিতা ছিলেন শ্রী রূপেন্দ্র কুমার মিত্র যিনি গণিতে স্নাতকোত্তর স্বর্ণপদক প্রাপ্ত। ১৯৪৭ সালে রূপেন্দ্র কুমার মিত্র ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি।
সমরেন্দ্র কুমার মিত্র বউবাজার হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। প্রেসিডেন্সি থেকেই তিনি কেমিস্ট্রি তে স্নাতক হন ও রৌপ্য পদক লাভ করেন। ঐ বছরই তিনি কেমিস্ট্রিতে কানিংগাম মেমোরিয়াল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৪০ সালে ফলিত গণিতে তিনি স্নাতকোত্তর লাভ করেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। তারপর তিনি মেঘনাদ সাহার তত্ত্বাবধানে ফিজিক্সে পিএইচডি করছিলেন কিন্তু মেঘনাদ সাহার মৃত্যুর পর তা আর সম্পূর্ণ হয়নি।
কাউন্সিল অফ সায়েন্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ থেকে এয়ার ড্রাইভেন আলট্রাসেন্ট্রিফিউজ নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালিত ল্যাবরেটারিতে চার বছর গবেষণা করেন। তিনি ইউনিস্কো স্পেশাল ফেলোশিপ অর্জন করেন হাই স্পিড কম্পিউটিং মেশিন নিয়ে গবেষণার জন্য। ১৯৪৯-৫০ সালে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিস, প্রিন্সটন থেকে হাই স্পিড কম্পিউটিং মেশিন নিয়ে গবেষণা করেন। এই সময়ে তিনি আর্লবার্ট আইনস্টাইন, ই.পাউলি, জন ভন নিউম্যান, নিলস বোর, রবার্ট ওপেনহাইমারের মতো বিজ্ঞানীদের সাথে পরিচিত হন। প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিসে থাকার সময় আলবার্ট আইনস্টাইনের সাথে বিজ্ঞান সম্পর্কিত বহু বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করেছিলেন। তিনি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে গবেষক, অধ্যাপক এবং ডাইরেক্টরও হয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার ইলেকট্রনিক্স এবং কম্পিউটার ম্যাকানিক্স এই দুই বিভাগের সূচনা করেন সমরেন্দ্র কুমার মিত্র।
ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগেও ওনার অবদান অনস্বীকার্য। ওনার তত্ত্বাবধানেই ১৯৬২ সালে ভারত প্রথম বন্দুক তৈরিতে সমর্থ্য হয়।
১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল কমিটি ফর স্পেশ রিসার্চের মেম্বার ছিলেন। ১৯৬৩ সালে ওনার নেতৃত্বেই ভারতের প্রথম ইলেকট্রনিক ডিজিটাল কম্পিউটার ISIJU তৈরি করেন। এরকম বহু বিষয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাঙালি সমরেন্দ্র কুমার মিত্রকে চেনেই না। কোনো পাঠ্য বই-তেও ওনার ব্যাপারে কিছু উল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি। বাঙালি নাকি আর বিজ্ঞান চর্চা করেনা এরকমই একটি মিথ তৈরি করে বাঙালির মধ্যল বহুভাবে হীনমন্যতা বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। বাঙালির উচিৎ এ বিষয়ে সচেতনতা অবলম্বন করা। সমরেন্দ্র কুমার মিত্রের মতো বিজ্ঞানীদের ব্যাপারে প্রচার অবশ্যই প্রয়োজন বর্তমান প্রজন্মের বাঙালির হীনমন্যতা কাটাতে।
প্রতিবেদন- অমিত দে
Post a Comment