Header Ads

১৯ শে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের তালিকা ও তাদের পরিচয়


১৯৬১ সালের ১৯ শে মে, বরাক ভাষা আন্দোলনে যে ৯ জন বাঙালি শহীদ হন, তাঁরা কারা? কীই বা তাদের পরিচয়? এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা বিশদে তুলে ধরছি ১৯ শে মের শহীদদের পরিচয়। 


কমলা ভট্টাচার্য- যাকে পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষাশহীদ হিসেবে ধরা হয়। নিজের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় তাঁর লড়াই মনে রাখার মতো। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেন তিনি। তাঁর পিতা ছিলেন রামনারায়ন ভট্টাচার্য ও মাতা ছিলেন শ্রীমতি সুভাষিণী ভট্টাচার্য। দুই ভাই ও চার বোনের সংসারে কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন তৃতীয়। বড়ভাই রমেন্দ্র পান্ডুতে রেলে চাকরি করছিলেন এবং বড় বোন বেনু চক্রবর্তী তখন বিবাহিতা। অন্যরা সবাই স্কুল পড়ুয়া। কমলা শিলচর সরকারি বালিকা মহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় বর্তমান নাম শিলচর উচ্চতর সরকারি মাধ্যমিক ও বহুমুখী বালিকা বিদ্যালয় থেকে সবে মাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন। শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের  একটি ভাড়া বাড়িতে তারা থাকতেন৷ বোন মঙ্গলাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সকালেই শিলচর রেল স্টেশনে যান। ছোটোবোন মঙ্গলা সকাল বেলাই পুলিশের লাঠির আঘাতে জঘম হলে তাকে চিকিৎসার জন্য সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কমলা স্টেশনে থেকে যান ও আসাম পুলিশের গুলির আঘাতে তিনি শহীদ হন। 

হিতেশ বিশ্বাস- বয়স ২৩ বছর। পিতা স্বর্গীয় হরিশচন্দ্র বিশ্বাস এবং মাতা কিরণবালা বিশ্বাস। ১৯৫০ সালে উদ্বাস্তু হয়ে মা-বাবা এবং হিতেশ তাঁর ছোটো ভাই ও দুই বোন সহ ত্রিপুরার উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। পরে দুই ভাইই কাজের সন্ধানে ত্রিপুরা ছাড়েন। হিতেশ শিলচরে একটি দোকানে বিক্রেতার কাজ নিয়ে অম্বিকাপট্টিতে ভগ্নিপতির বাড়িতে বাড়িতে আশ্রয় নেন। ভাষা আন্দোলনে সাড়া দিয়ে শিলচরে পুলিশের গুলিতে তিনি শহীদ হন৷

চন্ডীচরন সূত্রধর- বয়স ২২ বছর। পিতা শ্রী চিন্তাহরণ সূত্রধর। পিতামাতার একমাত্র পুত্র ছিলেন তিনি। অল্প বয়সে পড়াশোনা ছেড়ে তিনি শৈশবেই কাঠমিস্ত্রীর কাজে যোগ দেন। থাকতেন শিলচর রাঙ্গিয়া-খাড়িতে। একমাত্র বোন বিবাহিতা তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকতেন। তাঁর মা বাবাও সেখানেই থাকতেন। চন্ডীর অমায়িক ব্যবহারে পারিপার্শ্বিক সবার কাছেই তিনি খুব প্রিয় ও স্নেহের পাত্র ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে সামিল হয়ে শিলচর স্টেশনে আসাম পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি।

সুনিল দে সরকার- পিতা শ্রী সুরেন্দ্র চন্দ্র দে সরকার ও মাতা শ্রী সুভাষিণী দে সরকার। তাঁরা ছিলেন চার ভাই ও তিন বোন। ভাইদের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছিলেন সুনীল দে সরকার। তিনি এম ই পর্যন্ত পড়ে শিলচর সেন্ট্রাল রোডে ব্যবসা শুরু করেন। ভাষা আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে শিলচর রেল স্টেশনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি। 

কুমুদ রঞ্জন দাস- বয়স ১৮। পিতা শ্রী কুঞ্জমোহন দাস। ত্রিপুরায় মামার বাড়িতে থেকে এম ই পর্যন্ত লেখাপড়া করে গাড়ি চালক হন তিনি৷ পিতা-মাতা, চার বোন ও এক ভাই শিলচরে এসে এক চা দোকানে কাজ নেন। ভাষা আন্দোলনে সাড়া দিয়ে একমাত্র উপার্জনশীল কুমুদ ১৯ শে মে, ১৯৬১ তে পুলিশের গুলিতে মাতৃভাষার বেদীমূলে প্রাণ উৎসর্গ করে শহীদ হলেন। 

কানাইলাল নিয়োগী- বয়স ৩৭। পিতা স্বর্গীয় দ্বিজেন্দ্রলাল নিয়োগী ও মাতা শ্রীমতি মনোরমা এবং স্ত্রী শ্রীমতি রশান্তিকনা নিয়োগী। কানাইলাল নিয়োগীর ছোট দুই ভাই মানবেন্দ্র ও প্রশান্ত। তিন বোন বিবাহিতা। শহীদ কানাইলালের দুই পুত্র শেখর ৭ ও জহর ৫ বছরের। দুই কন্যা ইলা ১১ বছরের ও শিলা ৯ বছরের। ১৯৪০ সাল থেকে তিনি রেলে কর্মরত ছিলেন। ১৯ শে মে তিনি ছুটিতে ছিলেন। পুলিশের গুলিতে ভাষাবেদীমূলে আত্মত্যাগ করে তিনি শহীদ হন। 

তরণী দেবনাথ- বয়স ২১ বছর। পিতা শ্রী যোগেশচন্দ্র দেবনাথ ও মাতা শ্রীমতি জগতিবালা দেবনাথ। সদ্য বিবাহিত বড়ভাই শ্রী রমণী মোহন সহ মোট পাঁচজন একসাথে রাঙ্গিরখাড়িতে থাকতেন। তরণী ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছিলেন। শহীদ হবার প্রায় ছয় মাস আগে একটি নতুন হ্যান্ডলুম যন্ত্র কিনে বাড়িতে স্থাপন করেন। সামাজিক কাজেও তার যোগদান থাকায় রাঙ্গিখাড়ী বয়ন সমিতির সভাপতি ও স্থানীয় ক্ষুদিরাম ক্লাবের সম্পাদক হয়েছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি ১৯ শে মে শিলচর রেল স্টেশনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। 

শচীন্দ্র পাল- বয়স সেদিন ১৯ বছর। শিলচর শহরের সে সময়কার অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী পরিবারে শচীন্দ্র পালের জন্ম হয়। পিতা শ্রী গোপেশ চন্দ্র পাল ও মাতা স্বর্গীয় সুবর্ণ পাল। পাঁচ ভাই ও এক বোনের পরিবারে শচীন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। বড়ভাই শ্রী গঙ্গেসচন্দ্র পাল কলেজ পড়ুয়া ও সংগ্রামে সক্রিয় ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। বোন সুলেখা ও অন্য তিন ভাই অরবিন্দ, গীতেশ ও গৌতম। শচীন্দ্র ১৯৬১ সালে শিলচর কাছাড় হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ভাষা সংগ্রামে যুক্ত হয়ে রেল স্টেশনে অবস্থান ধর্মঘটে সামিল হন এবং পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।  

বীরেন্দ্র সূত্রধর- বয়স তখন ২৪ বছর। পিতা নীলমণি সূত্রধর। তিনি কাঠমিস্ত্রীর কাজ করতেন আইজলে। শহীদ হবার কিছুদিন আগে তিনি শিলচরের মেহেরপুরে এসে ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। বীরেন্দ্র সূত্রধর শহীদ হবার দিন ওনার স্ত্রী শ্রীমতি ধনকুমারীর বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর এবং একমাত্র কন্যা রানীর বয়স ছিল ১ বছর। মাতৃভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি শিলচর রেল স্টেশনে আত্মবলিদান করে শহীদ হন। 

প্রতিবেদন- নিজস্ব সংবাদদাতা  

তথ্যসূত্র- কালি কলম ও ইজেল


No comments