Header Ads

দিগম্বর ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস বাংলার ২৫ লক্ষ চাষীকে কৃষক বিদ্রোহে নামিয়েছিলেন


ঐতিহাসিক নীল বিদ্রোহের কথা আমরা সবাই জানি।  সেই বিদ্রোহের অন্যতম দুজন নেতা হলেন দিগম্বর বিশ্বাস এবং বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস। দিগম্বর বিশ্বাসের জন্ম নদীয়ার গোবিন্দপুর গ্রামে ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাসের জন্ম চৌগাছাতে। একটা কথা আছে কঠিন পরিস্থিতি মহান মানুষের জন্ম দেয়। ইংরেজরা কৌশলে পাতিদার জমিদার শ্রেণী সৃষ্টি করে সাধারণ কৃষকদের অত্যাচার করে এ নীল চাষ করাতো। যারা নীল চাষ করতে অনিচ্ছুক ছিল তাদের সুন্দরী কন্যাদের জোর পূর্বক ধরে এনে রাত্রির বিলাসনে ভোগ উপভোগ করে এক সপ্তাহ পরে ছেড়ে দেওয়া হত। আর সেই কৃষক কন্যারা বিভিন্ন স্থানে আত্মহত্যা করতো। ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেন যারা নীল চাষে অনিচ্ছুক বা ঠিকমতো উৎপাদনে ব্যর্থ হত তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হত। তাদের কুঠিতে মাথায় কাঁদা লেপ্টে নীল বীজ রোপন করা হত। যত দিন চারা না গজাতো ততদিন খাবার না দিয়ে বন্দি রাখা হত।


নীল গাছ দেখাতো অড়হর গাছের মতোই। এর পাতা চিক, হরিৎবর্ণ, অনেকটা সিদ্ধি পাতার মতো। খারিপ এবং রবি দু মৌসুমেই নীল চাষের উপযোগী সময়। এটা চাষের জন্য উষ্ণ আবহাওয়া প্রয়োজন। যার জন্য যশোর তথা চৌগাছা অঞ্চল ছিল উপযোগী। এক বিঘা জমি থেকে গড়ে ১০ রাতিল নীল গাছ পাওয়া যেত। এ থেকে দু সের নীল হত। যার বাজার মূল্য ছিল ১০ টাকা। কিন্তু কৃষকদের দেওয়া হত মাত্র আড়াই টাকা। প্রতি বিঘা জমিতে নীল চাষ করতে সর্ব সাকুল্যে খরচ হতো ৪ টাকা। অর্থাৎ এক বিঘা জমিতে নীল চাষ করে একজন নীলকর নীট মুনাফা পেতেন ৬ টাকা। দুটি প্রথায় নীলকররা নীল চাষ করত। এর প্রথম প্রথা হচ্ছে নিজ জমিতে ক্ষেতমুজুর নিয়োগ করা। আর এর জন্য বীরভূম, বাঁকুড়া, সিংভূম, মানভূম ও মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলা থেকে সাঁওতালদের নিয়ে আসা হত।
 
সেই সময় নীল চাষ করার জন্য ভারতীয় কৃষকদের ওপর ইংরেজদের অত্যাচার ক্রমশ বাড়ছিল, কৃষকরা দিশেহারা। কমিক্স বইয়ের হিরোর মতন উদয় হলো দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাসের। ওনাদের পেশা ছিল নীল কুঠির পাহারা দেওয়া। কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাঁরা দুজনে সেই চাকরি ছাড়লেন। তারপর সমস্ত বিদ্রোহী কৃষকদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু সশস্ত্র ইংরেজ বাহিনীর সাথে লড়াই করা গরীব কৃষকদের দ্বারা সম্ভব ছিলোনা, কারণ কৃষকরা অস্ত্র চালানো জানতেন না। তাঁরা নিজেদের অর্থ ব্যয় করে বরিশাল থেকে লাৎজিয়াল এনিয়ে কৃষকদের বল্লম ও লাঠিচালনা শেখান এবং গড়ে তোলেন প্রতিরোধ বাহিনী। নদীয়া ও যশোরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তাঁদের নেতৃত্বে নীল বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল। সেই সময় দিগম্বর বিশ্বাস এবং বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ১৭ হাজার টাকা কৃষকদের জন্য ব্যয় করে সর্বশান্ত হয়েছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে তিন পর্বের বিদ্রোহের মধ্যে সংগঠিত বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন ২৫ লক্ষ কৃষক।

তিনি গ্রামে গ্রামে রাত্রির আধারে বের হতেন কৃষক বিদ্রোহ করার জন্য। তাঁরা যাদের ঘরে খাবার থাকতো না তাদের খাবার দিতেন, যাদের বস্ত্র থাকতো না তাদের বস্ত্র দিতেন, যাদের অস্ত্রের প্রয়োজন তাদের অস্ত্র দিতেন। আর বিদ্রোহের দাবানলদাহ প্রজ্জলিত করতো কুঠিতে কুঠিতে। আর এ বিদ্রোহ করতে গিয়ে শত শত কৃষক শহীদ হন। আসলে নীল বিদ্রোহের বিদ্রোহী বারুদ ছিল অর্থনৈতিকভাবে মুক্তির জন্য। রাজনৈতিকভাবে মুক্তির জন্য, ধর্মীয় ও সংস্কৃতির মুক্তির জন্য আর বেঁচে থাকার জন্য এ বিদ্রোহ ছিল অবশ্যম্ভাবী।

১৮৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই বিদ্রোহের প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে৷ এই সময় নদীয়ার বাঁশবেড়িয়ার কুঠির ম্যানেজার ছিলেন উইলিয়াম হোয়াইট। যিনি নীলকর সাহেবদের সাথে নীল চাষের জন্য পরামর্শ করতেন। দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস নীল চাষের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ করে আন্দোলন শুরু করলেন। এ আন্দোলনকে থামানোর জন্য উইলিয়াম হোয়াইট ৫০০ লাঠিয়াল ও কয়েকটি হাতি নিয়ে গোবিন্দপুর আক্রমণ করেন। দক্ষ সেনাপতি দিগম্বর বিশ্বাসের পরিচালনায় একদল বর্ষাধারী কৃষক তাদের বাধ্য করেন পিছু হটতে। এই বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস বর্তমানে চৌগাছা নামে একটি গ্রামের মানুষ ছিলেন। ফলে চৌগাছার বিদ্রোহরূপেই এর পরিচিতি। কিন্তু ইতিহাসের তথ্য এই যে চৌগাছার কৃষকরা বিদ্রোহে অংশ নিলেও প্রতিরোধটি শুরু হয় গোবিন্দপুরে, বর্তমান হাঁসখালি ব্লকে যার অবস্থান।

তৎকালীন নদীয়ার নতুন ম্যাজিস্ট্রেট এল.আর টোটেনহাম এ ঘটনার তদন্তভার গ্রহণ করেন। তিনি তদন্ত করে দেখেন উইলিয়াম হোয়াইট দোষী। তাই তিনি হোয়াইটের কাছে ৩০০ টাকা জরিমানা করেন। ওদিকে নীলকররাও ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তারা যথেষ্ট ক্ষমতাবান ছিলেন৷ এদেরই চাপে পড়ে ব্রিটিশ সরকার টোটেনহামকে অন্যত্র বদলি করে দেয়। সুযোগ বুঝে হোয়াইট পোড়াগাছা ও চৌগাছা আক্রমণ করে বসেন। এবার গ্রামবাসীরা তাদের তাড়াতে পারলো না। একজন কৃষক শহীদ হলেন ও বহু মানুষ আহত হলেন। নীলকরের লাঠিয়ালরা গ্রামে লুঠপাট চালিয়ে গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়। বহু কৃষককে গ্রেপ্তার করা হলো। বহু কৃষকের নামে মিথ্যা মামলা ঠোকা হলো। বহু কৃষকের কারাদণ্ড হলো। দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস সমস্ত খরচ দিয়ে তাদের মুক্ত করেছিলেন। 

দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ভালো করেই বুঝলেন নীলকরদের লড়াই করে তাদের পরাস্ত করতে না পারলে গ্রামে কারোর পক্ষে বসবাস করা সম্ভব হবে না। অতএব গ্রামের মানুষদের সংঘবদ্ধ করা প্রয়োজন৷ কেবল গ্রামের মানুষদের সংঘবদ্ধ করলেই হবে না, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। তাই তাঁরা নতুন করে কতগুলো পরিকল্পনা তৈরি করেন। চৌগাছা ও পাশ্ববর্তী গ্রামগুলো থেকে মেয়ে ও বাচ্চাদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হলো৷ তাঁরা বরিশাল থেকে নামকরা সব লাঠিয়াল ভাড়া করে আনলেন। কৃষকেরা দল বেঁধে লাঠি চালানো শিখতে থাকেন। কয়েকদিনের মাথায় তারা ওস্তাদ লাঠিয়ালে পরিণত হন। 

উত্তেজিত ইংরেজ বিদ্রোহ দমনার্থে ও কৃষকদের শিক্ষা দিতে ১৫০০ লাঠিয়াল নিয়ে লোকনাথপুর আক্রমণ করে চৌগাচার কতিপয় কুটি গুলো রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশায়। ম্যাকেংঞ্জি, লার্মার, ফরলংরা সৈনিক সামন্ত নিয়ে কৃষকদের বিদ্রোহ চিরদিনের মতো ধুলিসাৎ করে দেওয়ার প্রত্যয়ে বিদ্যমান। তারই বিপরীত বীরতর্প সূর্য সন্তান দিগম্বর বিশ্বাস। চৌগাছার তাহেরপুরের কপোতাক্ষ পাড়ের পাশে বর্তমান হাকিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরহাদুর রহমানের বাড়ির তল্লাটে বাইরের বহুগ্রামের মানুষেরা ও হাকিমপুর, তাহেরপর, আরাজীসুলতানপুর,  দেবীপুর, মাঠচাকলা, স্বরূপপুরের মহাবীরেরা যোগদান করেছিলেন। প্রচন্ড বিদ্রোহের কথা ঘোষণা করেন, কৃষকরা শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণ করেন এ এলাকার বীরাঙ্গনাপারীরাও।এরপর দিগম্বর বিশ্বাস নারায়নপুর মাঠে কৃষক ও দশটি গ্রামের মানুষদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে মিলিত হন।  আর শপথ বাক্য পাঠ করেছিলেন যে জীবন গেলেও সৈন্যদের হাতে পরাজয় বরণ করবেন না। এভাবে বিভিন্ন স্থানে দিগম্বর বিশ্বাস মিটিং  করে বিপুল সংখ্যক জনতাকে আরো প্রকম্পিত ও একত্রিত করতে সক্ষম হন। 

অবশেষে ১৮৬১ সালের ২৫ শে জানুয়ারী শুরু হয় ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে চৌগাছা- ঝিকরগাছার বিদ্রোহ কৃষক কূলের মুখোমুখি যুদ্ধ। লর্ড ম্যাকেংঞ্জির হুকুমে সৈন্যরা গুলি চালায় সাধারণ নিরন্ন ও বঞ্চিত বিদ্রোহী কৃষককূলের দিকে। উত্তেজিত কৃষককূল লাঠি সোটা নিয়ে ম্যাকেংঞ্জির সৈন্যদের দিকে এগোতে থাকে চৌগাছার সেনাপতি দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে।

ঐতিহাসিকদের আলোচনা থেকে দেখা যায়, ইংরেজ সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণে হাজার হাজার কৃষক ঐদিন জীবন দিয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। রক্তের বিনিময়ে বন্যায় ভেসে গিয়েছিল। ঝিকরগাছার এ অঞ্চল হাহাকার চিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে এসেছিল। বাতাসে লাশের গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বহু কৃষক সেদিন মারা যান ঠিকই তবে  কৃষককূল লাঠি দিয়ে মেরেও ফেলেছিলেন অনেককে আর অনেক ব্রিটিশ সৈন্য পালিয়ে যেতেও বাধ্য হয়। বিদ্রোহ হয়, বিজয়ের মিছিল হয়- শহীদ হয় চৌগাছার ঝিকরগাছাসহ অনেক এলাকার সাধারণ মানুষ। অবশেষে রক্তের গঙ্গা বেয়ে আসে সাধারণ কৃষককূলের স্বাধীনতা। এ বিদ্রোহ সফল হওয়া সম্ভবপর ছিল না, যদিনা দিগম্বর বিশ্বাসের মতো সুতীব্র নেতৃত্বদানকারী না থাকতো। না থাকতো বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট ডব্লিই জি হারসেল, চুয়াডাঙ্গার জমিদার, শ্রীপুরের জমিদার, ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব আব্দুল লতিব তিতুমীরের জীবন দান। চৌগাছার জমিদার হেমেন্দ্রপ্রসাদ বলেন "বাংলার কৃষকরা ক্রীতদাস নয় যে তারা নীল চাষ করবে"। হাজার হাজার কৃষকদের জীবনদান, রক্তের স্রোত ধারায় নেমে আসে এ বিশাল বিজয়। পরিশেষে বলা যায়, নীল বিদ্রোহে সাধারণ কৃষককূল একত্রীকরণে, বলবৃদ্ধিকরণে যে প্রবল দিক দর্শন দর্শিয়েছিল তা তার শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার চৌগাছার দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস।

ভারতের ইতিহাসে দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাসদের নাম চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

তথ্যসূত্র- যশোর-খুলনার ইতিহাস (শিশির কুমার ঘোষ), কৃষক বিদ্রোহের নিরব সাক্ষী (দৈনিক জনকণ্ঠ)।  

প্রতিবেদন- শুভজিৎ নস্কর  

No comments