Header Ads

আদর্শ শিক্ষক বরুণ বিশ্বাসের হত্যার বিচার হয়নি আজও


সালটা ২০০০ খ্রীস্টাব্দ। উত্তর ২৪ পরগণার সুঁটিয়া গ্রাম উত্তপ্ত। শকুনের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে কয়েকজন রাজনৈতিক দুষ্কৃতি। চাঁদাবাজি, জোরজুলুম, তোলাবাজির মতো জঘন্য কাজকর্ম করে বেড়াচ্ছে তারা। কেউ প্রতিবাদ করলেই তার পরিবারের মেয়েদের ওপর নেমে আসে ধর্ষণের বিষবাষ্প। মেয়েদের ধর্ষণের ভয় দেখিয়ে রাজত্ব শুরু করে দুষ্কৃতিরা। ঐ এলাকার ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতা সুশান্ত চৌধুরী ও বীরেশ্বর ঢালীর পোষা দুষ্কৃতিদের আখড়া হয়ে ওঠে সুঁটিয়া। এই দুই রাজনৈতিক নেতার ছায়াতলে থাকা বিশ-পঁচিশ জনের পিশাচদল প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের তালিকা বানিয়ে নির্যাতন করতে থাকে তাদের। 


সাধারণ মানুষকে মুখ বুজে সহ্য করতে হতো শত অন্যায়। ক্ষোভে-অপমানে ফুঁসলেও প্রতিবাদ করার সাহস পায়না কেউ৷ প্রতিবাদ করলেই তার ওপর চরম বিপদ নেমে আসতো। বাড়িশুদ্ধ লোকদের পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। সকলের মনে কাজ করতো একটা চাপা ভয়। এমতাবস্থায় ২০০২ সালের ১ লা আগস্ট সুঁটিয়া বাজারে ডাক দেওয়া হলো এক প্রকাশ্য প্রতিবাদসভার। ভিড়ে গমগম করছে গোটা বাজার। বক্তৃতা দেওয়ার সাহস নেই কারও। হঠাৎ মাইক হাতে এগিয়ে এলেন এক তরতাজা যুবক। ঝমঝম করে আকাশ থেকে নেমে এলো বৃষ্টিধারা। বিশাল জমায়েতের মাঝে শত্রুদের চোখে চোখ রেখে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গর্জে উঠলেন তিনি। 

জনসমুদ্রের মাঝে তিনি বললেন "যদি এখনও মা-বোনেদের সম্মান রক্ষা করতে না পারি, তা হলে আমরা সভ্য সমাজে থাকার যোগ্য নই৷ আমাদের যদি ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস না থাকে, তাহলে আমাদের তাদের থেকেও বেশি শাস্তি পাওয়া উচিৎ। তাই আসুন, আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমাদের নারীদের সম্মান রক্ষা করুন।" তিনি হলেন বাংলার এক মহান আদর্শ শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস।

সুঁটিয়া গ্রামে নারীদের সম্মান ফেরাতে বাইকে করে গোটা গ্রাম পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন তিনি৷ দুঃস্বপ্নের গ্রাসে ডুবে থাকা নিজ জন্মস্থানকে অপরাধ জগতের নাগপাশ থেকে উদ্ধার করতে শুরু করলেন এক স্বপ্নের লড়াই। কিছুদিনের মধ্যেই গ্রামবাসীদের সাহসের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠলেন বরুণ বিশ্বাস। অন্যায়ের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের শক্তি জোগাতে লাগলেন তিনি। 

বরুণ বিশ্বাসের নির্ভিকতা লক্ষ্য করে সুঁটিয়াবাসীও জেগে ওঠে। গ্রামবাসীদের নিয়ে বরুণ বিশ্বাস গড়ে তুললেন 'প্রতিবাদী মঞ্চ'। নারী ধর্ষণকারী শয়তানদের হিংস্রতার বিরুদ্ধে গোটা গ্রাম গণবিদ্রোহ শুরু করে৷ সুশান্ত চৌধুরী ও তার পোষা গুন্ডাদের গ্রেপ্তারের দাবীতে এসডিও, এসডিপিও, ওসির কাছে ডেপুটেশন প্রদান করে গোটা গ্রাম। ২০০২ সালের ১৬ ই আগস্ট ১৮ টি গাড়ির কনভয় এসে গ্রেপ্তার করে সুশান্ত চৌধুরী ও তার পোষা গুন্ডাদের। সুশান্ত চৌধুরীকে জেলে ঢোকানোর সময় তার হাতে 'রামকৃষ্ণ কথামৃত' তুলে দিলেন বরুণ বিশ্বাস। এই বইটি তুলে দেওয়ার সময় তিনি বলেন "জেলে বসে এই বইটি পড়িস।" 

লড়াইয়ের ময়দান থেকে কখনো সরে আসেন নি বরুণ বিশ্বাস। সুঁটিয়া গ্রামের ত্রাতা হয়ে তিনি গ্রামের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। পেশায় বরুণ বিশ্বাস ছিলেন একজন শিক্ষক। মাসের শেষে স্কুল থেকে যে মাইনে পেতেন তা অকাতরে বিলিয়ে দিতেন গ্রামের দরিদ্র মানুষদের। তাঁর মেজদার মুখে শোনা যায় "বরুণ যে খাটটিতে ঘুমোতেন সেই খাটটি গ্রামের এক দরিদ্র বুড়ির মাটিতে শুতে কষ্ট হচ্ছে দেখে তাকে দিয়ে দেয়।"  

কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউশনে তিনি শিক্ষকতা করতেন। গ্রামের সকলে তাঁকে 'মাস্টারমশাই' বলতো। তিনি পারতেন আভিজাত্য জীবন বেছে নিতে কিন্তু সামাজিক উন্নয়নের তাগিদে আভিজাত্য জীবনের স্বাদ ত্যাগ করেন। তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও পেশা হিসেবে শিক্ষকতা বেছে নেন। 

মিত্র ইন্সটিটিউশনের বেশিরভাগ ছাত্রের পছন্দের শিক্ষক ছিলেন বরুণ বিশ্বাস। তিনি নদী-খাল সংস্কারের আন্দোলনে নেমে এলাকার ইটভাটার মালিকদের ত্রাস হয়ে ওঠেন। তিনি স্পষ্টই বুঝতে পারেন তাঁর জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই সুঁটিয়া গ্রামে৷ তবুও সুঁটিয়াবাসীদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভুলে যেতেন নিরাপত্তার কথা। অপরাধীদের জেলে ঢোকানোর পরও শান্তি পেলেন না তিনি। কদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যায় অপরাধীরা। প্রশাসনের আদেশ অনুযায়ী বদলি করা হয় সুঁটিয়া থানার ওসিকে। 

২০১২ সালের ৫ ই জুলাই বরুণ বিশ্বাস রাত্রিবেলায় স্কুল থেকে ট্রেন করে ফিরে গোবরডাঙা স্টেশনে বাইক স্ট্যান্ডের দিকে ধাবমান হলেন। অকস্মাৎ দুজন দুষ্কৃতি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বরুণ বিশ্বাস জিজ্ঞেস করলেন "কিছু বলবি, বল কী বলবি?"। দুষ্কৃতিরা কোনো উত্তর না দিয়ে বরুণ বিশ্বাসের বুকে গুলি চালিয়ে দেয়। বরুণ বিশ্বাস মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন৷ প্রায় আধঘন্টা পড়ে রইলেন স্টেশনের সামনে। কেউ এলেন না তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাঁকে গুলি করার দশ মিনিট পরও যদি কেউ হাসপাতালে নিয়ে যেতেন তাও তিনি বেঁচে যেতেন। কিন্তু তাঁর বেঁচে ওঠা আর হলো না। তিনি আধঘন্টা মাটিতে পড়ে থাকার পর তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর নিথর দেহ থেকে ঝরা রক্ততে ভেসে যায় স্টেশন চত্বর। 

বরুণ বিশ্বাসের হত্যার খবর পেয়ে তাঁর বাড়িতে ছুটে আসেন গ্রামবাসীরা। তাঁর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জনতা। একদল নারী থানাতে ভাঙচুর চালায়। প্রায় দশ ঘন্টা ধরে পথ অবরোধ করা হয়। তাঁর অন্তিমযাত্রাতে সামিল হয়  চল্লিশ হাজার মানুষ। বরুণ বিশ্বাসের মৃতদেহ ছুঁয়ে গ্রামবাসীরা শপথ নেয় বরুণ বিশ্বাসের হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে। সেই প্রতিশোধের আগুন এখনও দাউদাউ করে জ্বলছে। আমাদের একটাই সংশয় যে দীর্ঘ আট বছর পরও বিচার বরুণ বিশ্বাসের হত্যাকারীদের। কোর্ট আট বছর ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে বরুণ বিশ্বাসের কেশটা৷ খুনীদের দোষী সাব্যস্ত করে জেল হলেও সিআইডি আজও চার্জসিট দিতে পারেনি যে কার নির্দেশ ও অর্থে বরুণ বিশ্বাস খুন হয়েছেন। বরুণ বিশ্বাস বিচার ব্যবস্থার আড়ালেই থেকে গেছেন। সুঁটিয়াবাসী বরুণ বিশ্বাসের জাস্টিসের প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছে। 

২০১৩ সালে পরিচালক রাজ চক্রবর্তী বরুণ বিশ্বাসের জীবনীর প্রেক্ষাপটে তৈরি করলেন বাংলা ছবি 'প্রলয়।' রাজ চক্রবর্তী এই ছবি তৈরি না করলে আমরা জানতে পারতাম না বরুণ বিশ্বাসকে। বাংলার এক দামাল সন্তান বরুণ বিশ্বাসের অকাল প্রয়াণ হলেও তিনি মারা যাননি কারণ বরুণদের মৃত্যু হয়না, তাদের মৃত্যু হতে পারেনা। বাংলার ঘরে ঘরে জন্ম হোক কোটি কোটি বরুণের। যারা বরুণ বিশ্বাসকে এ বিশ্বছাড়া করেছেন শুধু তারা শাস্তি পেলেই তাঁর আত্মা শান্তি পাবেনা, আমাদেরও অপরাধ মুক্ত বাংলা গড়তে শপথ নিতে হবে তাহলেই বরুণ বিশ্বাসের আত্মা শান্তি পাবে। অতএব বরুণ বিশ্বাসের বিশ্বাসটা আমাদের বুকেই থাকুক। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments