বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে কেন আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছিল?
কেউ তাঁকে সম্মান দেয়নি। কেউ তাঁকে মনে রাখেনি। তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম ও বিশ্বের দ্বিতীয় টেস্টটিউব বেবির আবিষ্কর্তা। মেডিকেল বিজ্ঞানের অগ্রগতি হলো তাঁর হাত ধরে। তারপরেও জীবনের সমস্ত হিসেব তাঁর থেমে যায় মাত্র পঞ্চাশ বছরে। তিনি বাধ্য হয়েছিলেন আত্মঘাতী হতে। আজ সেই দিন ১৯ শে জুন। ১৯৮১ সালের ১৯ শে জুন তিনি বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তাঁর প্রতি অনীহা ও তাঁর প্রতিটি কাজে বাঁধা দান আত্মহত্যার মূল কারণ।
বিজ্ঞানী সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা তথা ভারতের সম্পদ। ভারতের মতো দেশে যেখানে মেডিক্যাল অনেকটাই অনুন্নত সেখানে দাঁড়িয়েও সুভাষ মুখোপাধ্যায় টেস্ট টিউব বেবির মতো উন্নত প্রযুক্তির আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর আবিষ্কৃত ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবির নাম দুর্গা। যার বয়স বর্তমানে চল্লিশ বছর। বিজ্ঞানী সুভাষ মুখোপাধ্যায় হলেন দুর্গার সৃষ্টিকর্তা।
অনেকে বলেন কলকাতায় বসে বিজ্ঞানচর্চা হয়না। কলকাতায় বসে গবেষণা সম্ভব নয়। এমন হাজারো অভিযোগ আমাদের রোজগার জীবনে অনেকের মুখেই শোনা যায়৷ অথচ সুভাষ মুখোপাধ্যায় কলকাতার বুকেই টেস্ট টিউব বেবির জন্ম দিয়েছিলেন। যার ৬৭ দিন পূর্বে দুই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী প্যাট্রিক স্টেপটো ও রবার্ট জিওফ্রে এডওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে জন্ম নিয়েছিল বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব বেবি। তাই পৃথিবীর দ্বিতীয় টেস্টটিউব বেবির আবিষ্কর্তা তিনিই। এই আবিষ্কারের পরীক্ষার ফল তিনি বিদেশের বৈজ্ঞানিক মহলকে জানাতে চাইলে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেছিল৷ তাঁকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি৷ এই গবেষণার স্বীকৃতি না দিয়ে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য দফতর তাঁর গবেষণা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে৷ ক্ষোভে-অপমানে মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে লাগলেন তিনি।
নলজাত শিশু আবিষ্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আবিষ্কারের পরও প্রশাসনের কূ মনোভাব পোষণ করা হয় তাঁর ওপর। সরকার প্রশ্ন তুলেছিল যে আবিষ্কার আমেরিকা পারেনি, সেই আবিষ্কার কলকাতায় বসে তিনি কীভাবে আবিষ্কার করলেন? এর উত্তর খুঁজতে এক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যার ফলে প্রশাসনের সাথে তাঁকে জবাবদিহি করতে হয়। প্রশাসনের তরফে এও বলা হয়, ডাক্তারের অপরাধ হলো কোনো আমলাদের না জানিয়ে নিজে আবিষ্কার করে দূরদর্শনে প্রচার করা। প্রশাসনের তদন্ত কমিটি আবিষ্কারের কোনো সত্যতা যাচাই না করে সরাসরি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আবিষ্কারকে ভ্রান্ত বলে ঘোষণা করে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় চিকিৎসা সূত্রে কর্মরত ছিলেন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে। এখানে বসে চিকিৎসার উন্নতির জন্য তিনি রাতদিন এক করে গবেষণা করতেন। কিন্তু প্রশাসনের কাছে তাঁকে বারবার অপমানিত হতে হয়। তিনি যাতে বিদেশ না যেতে পারেন তার জন্য বাতিল করা হয় তাঁর ভিসা। এমনকি গবেষণার সবরকম সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে তাঁকে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। এতো অপমান-লাঞ্ছনা কার সহ্য হয়? জীবনে সুখে বাঁচার স্বপ্ন দেখার আর কোনো সুযোগ রইল না তাঁর৷ তিনি ক্ষোভে-অপমানে ও অভিমানে আত্মহননের পথ বেছে নেন।
তাঁর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ১৯৮৬ সালের ১৬ ই আগস্ট বিজ্ঞানী টি.সি.আনন্দ কুমারের গবেষণার ফলে হর্ষবর্ধন রেড্ডি বুরি জন্মগ্রহণ করেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁকে ভারতের নলজাত প্রথম শিশু বলে ঘোষণা করা হয়৷ ১৯৯৭ সালে কলকাতার এক বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ করে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আবিষ্কৃত নথিগুলি তাঁর হাতে আসে৷ এই নথিগুলি যাচাই করে ও দুর্গার মা-বাবার সাথে আলোচনা করে তিনি বুঝতে সক্ষম হন যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই হলেন ভারতের টেস্টটিউব বেবির জনক। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে সব কথা স্পষ্টভাবে বোঝাতে শুরু করেন। সবশেষে তৎকালীন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দেয়। সেই থেকে তিনি পরিচিত হলেন ভারতের টেস্টটিউব বেবির জনক হিসেবে। তিনি যদি নিজের জীবদ্দশায় এই স্বীকৃতি পেতেন তাহলে তাঁকে আমরা অকালে হারাতাম না। তিনি হয়তো বেঁচে থাকলে দেশের মেডিক্যালের চিত্র অন্যরকম হতো।
Post a Comment