Header Ads

বাংলা কবিতায় ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক শাশ্বতী কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত


রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলা কাব্যের আকাশে মধ্যাহ্ন সূর্যের তেজে ভাস্বর তখনই আবির্ভূত হয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি ছিলেন বিংশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁর মতো নানা গুণ সমন্বিত মানুষ রবীন্দ্রনাথের পর আর কেউ আছে বলে মনে হয়না৷ বিংশ শতাব্দীর তিরিশ দশকে যে পাঁচজন কবি রবীন্দ্র প্রভাব কাটিয়ে আধুনিকতার সূচনা ঘটান তাদের মধ্যে অন্যতম কবি ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁকে বাংলা কবিতায় 'ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক' বলা হয়৷ কবি সুধীন্দ্রনাথ রাবীন্দ্রিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠলেও তাঁর মানস প্রকৃতি বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতাকে অনুভব করে কবি ব্যক্তিত্বকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে প্রকাশ করেছিল। সমকালীন নানান ঘটনা ও পাশ্চাত্য সাহিত্য, সেই যুগের বাস্তব চিত্র প্রত্যক্ষ করে নিঃসঙ্গ যন্ত্রণা অনুভব করতেন সুধীন্দ্রনাথ। তাই তাঁর কাব্যে কালের তীব্রগতি ও সর্বগ্রাসী মনোভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় 'যযাতি', 'উজ্জীবন', 'সংবর্ত' প্রভৃতি কবিতায়।


সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতাগুলো মূলত বিরামহীন ও নিরন্তর ভাবনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে লেখা হয়েছে। তাঁর কবিতায় অদ্ভুতভাবে ভাষায় ব্যবহার ও ছন্দের মিল লক্ষ্য করা যায়৷ অগ্রজদের শিথিল ও অতিভাষী বাংলা কবিতাকে অভাবনীয় সংহতি প্রদান তাঁর এক অসাধারণ কৃতিত্ব। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'অর্কেস্ট্রা' বাংলা কবিতার ইতিহাসে বিষয়ে ও বিন্যাসে দিয়েছে নতুনত্বের সন্ধান৷ তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু জীবনের মৌল সত্য-প্রেম, কাল, ভগবান প্রভৃতির অনুসন্ধান। কবির প্রেমচেতনা বাস্তব দেহতত্ত্বের ওপরে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর প্রেম বিষয়ক কবিতাবলিতে একটি সুস্থ সুন্দর লিরিকাল মেজাজ পাওয়া যায়। 

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ হলো 'তন্বী' ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ হলো 'অর্কেস্ট্রা'। এরপর ধাপে ধাপে শুরু করলেন অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ লেখার কাজও। তাঁর উল্লেখযোগ্য অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ  হলো 'ক্রন্দসী', 'উত্তর ফাল্গুনী', 'সংবর্ত', 'প্রতিধ্বনি' এবং 'দশমী'৷ তাঁর কাব্যে তৎসম শব্দের সঙ্গে চলিত শব্দের ক্রিয়াপদ, ছন্দের বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রয়োগ, অলংকার প্রয়োগে ও চিত্রশিল্প নির্মাণে কৃতিত্ব লক্ষ্য করা যায়৷ 

রূপসী বাংলার আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন "সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে বেশি নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা। সর্বব্যাপী নাস্তিকতা, দার্শনিক চিন্তা, সামাজিক হতাশা এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবাদ তাঁর কবিতার ভিত্তিভূমি৷ কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পর্কে বলেছেন "তাঁর মতো বিরাট প্রস্তুতি নিয়ে আর কেউ বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতে অগ্রসর হননি। আমার সমবয়সী বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনিই একমাত্র যিনি উত্তরজীবনে বাংলা ও বাংলায় ব্যবহারযোগ্য প্রতিটি সংস্কৃত শব্দের নির্ভুল বানান জানতেন।" 

কলকাতা শহরের হাতিবাগানে ১৯০১ সালের ৩০ শে অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্যকাল কেটেছে কাশীতে। তাঁর পিতার  নাম হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও মায়ের নাম ইন্দুমতি বসুমল্লিক। তিনি কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং স্কটিশ কলেজ থেকে স্নাতক হন৷ তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য ও আইন বিভাগে ভর্তি হন। তবে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এরপর ছবি বসুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন৷ কিন্তু তাদের সম্পর্ক এক বছরেরও বেশি স্থায়ী হয়নি৷ এরপর রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী রাজেশ্বরী বসুর সঙ্গে দ্বিতীয় বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি৷ ১৯৬০ সালের আজকের দিন অর্থাৎ ২৫ শে জুন নিঃসন্তান অবস্থায় তিনি অমৃতলোকে পাড়ি দেন। 

তাঁর মৃত্যুর এতো বছর পরও অনেক বাঙালি তাঁকে মনে রাখেন নি৷ কোথাও না কোথাও গিয়ে আজকে তাঁকে নিয়ে চর্চা কমে যাচ্ছে। আমরা কী পারিনা 'উটপাখি' কবির স্রষ্টা শাশ্বতী কবির কবিতাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে। যুগের সাথে মানানসই এমন কবিতা কজনই বা লেখেন। তিনি হয়তো বিস্তৃত কিন্তু তাঁর কবিতা আজও চিরনতুন। 


তথ্যসূত্র- কালি ও কলম, বিকাশপিডিয়া, আনন্দবাজার, কয়াল-বন্দোপাধ্যায় রচিত আধুনিক বাংলা সাহিত্য

No comments