Header Ads

নদীয়ার একটি প্রাচীন জনপদ চাকদহের কিছু ইতিহাস উপাখ্যান



চাকদহ বা চাকদা নদীয়ার একটি প্রাচীন জনপদ। চাকদহ নামকরণের পিছনে নানা রকম ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় আবেগ মিশে আছে। ধর্মীয় আবেগ ও জনশ্রুতি অনুযায়ী এই স্থানের পূর্বে নাম ছিল 'চক্রদহ' বা 'চক্রদ্বীপ'। মর্তে গঙ্গা আনায়নের সময় নাকি ভগীরথের রথের চাকায় গভীর খাত সৃষ্টি হয় এবং সেটি গঙ্গা জলে পূর্ণ হলে স্থানটির নাম হয় চক্রদহ। আবার অন্য মতে গঙ্গাদেবীকে আনয়নকালে রথের চাকা প্রথিত হয়ে যায় এইস্থানে এবং এখানকার নাম হয় চক্রতহ, অপভ্রংশে চাকদহ। কারও কারও মতে সুদূর অতীতে চাকদহের নাম ছিল 'প্রদ্যুম্নগর', এটা আরও একটি পৌরাণিক মত।

ভৌগলিক মতে গঙ্গা নদীর বিভিন্ন সময়ে গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলে চক্রাকারে বিরাট একটি দহের সৃষ্টি হয়। সেই অনুযায়ী এ অঞ্চলের নাম হয় 'চক্রদহ' বা 'চাকদহ'। চাকদহের নিকট পালপাড়ায় (অতীতে প্রদ্যুম্ননগর) একটি টেরাকোটা মন্দির বর্তমান। চাকদহের কাজীপাড়ায় প্রথম বিলাতগামী বাঙালি মির্জা মির্জা শেখ ইতেশামুদ্দীনের (এহতেশামুদ্দিন) বসতবাড়ি ও জন্মস্থানটি জীর্নপ্রায়। এটি কাজীপাড়া মসজিদ নামে খ্যাত। চাকদহ অঞ্চলে নানাবিধ মূর্তি, বিগ্রহ, শিলা প্রভৃতির বাৎসরিক ও নিত্য পুজার ব্যবস্থা রয়েছে। কোথাও কোথাও বিগ্রহকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা কিংবদন্তি ও ছোট বড়ো মেলা কখনও কখনও আবার দেবমন্দিরটিই হয়ে উঠেছে পুরাকীর্তির স্মারক। এই গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্থানের মধ্যে একটি হল জগন্নাথ বিগ্রহ। চাকদহের একটি বিশেষ  দ্রষ্টব্য স্থান হল যশরা জগন্নাথ মন্দির।


যশরায়  চৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ জগদীশ পণ্ডিত প্রতিষ্ঠিত প্রায় পাঁচশ বৎসরের সুভদ্রা বলরাম বিহীন দারু নির্মিত জগন্নাথ বিগ্রহ স্থাপিত আছে। সুভদ্রা বলরাম বিহীন এই বিগ্রহের উচ্চতা প্রায় চার ফুট। সুভদ্রা বলরাম বিহীন এই জাতীয় জগন্নাথ মূর্তিই পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও নেই। বেদিতে আবস্থিত জগন্নাথ বিগ্রহের সামনে রয়েছেন রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তি। মূল মন্দিরে প্রবেশ পথের এক পাশে একটি উঁচু স্তম্ভের উপর করজোড়ে বিগ্রহমুখিগরুড়মূর্তি রয়েছে। এখানকার জগদীশ পণ্ডিতের শ্রীপাটে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রায় কোন অনুষ্ঠান হয় না; এটি এখানকার জগন্নাথের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ সম্পর্কে প্রচলিত অভিমত এই যে, রথযাত্রার অনুষ্ঠান জগন্নাথ দেবের ই অভিপ্রেত নয়। রথযাত্রার পরিবর্তে বিপুল সমারহে বার্ষিক স্নানযাত্রা উৎসব ই এখানে পালিত হয়। 

চাকদহের ইতিহাসে জগদীশ পণ্ডিত প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথ মূর্তি ও এই জগন্নাথ বিগ্রহ কে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত স্নান যাত্রার উৎসব ও মেলা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় পালিত জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রার উৎসব এখানকার সর্ববৃহৎ ও সুপ্রসিদ্ধ অনুষ্ঠান। জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রা উৎসবের পূর্ব দিন রাত্রে মন্দিরে বিগ্রহের পুজা, আরতি, অধিবাস, ধর্ম সভার অনুষ্ঠান পালিত হয় । এতে স্থানীয় ও বহিরাগত মানুষেরাও অংশগ্রহণ করেন। পর দিন অর্থাৎ স্নান যাত্রার দিন সকালে ধর্ম আলোচনা, পুজা প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র মন্দির প্রাঙ্গন ও স্নানবেদি অবিরাম হরিনাম সংকীর্তনে মুখর হয়ে ওঠে। স্নান যাত্রার দিন সকালে মাটির ছোট ছোট ১০৮ টি ঘটের গঙ্গা জল তামার একটি বৃহৎ কলসিতে পূর্ণ করে একজন ভক্ত মাথায় নিয়ে বাদ্যযন্ত্র ও হরিনাম সহযোগে গঙ্গা থেকে মন্দিরে বহন করে নিয়ে আসেন, এর পর জগন্নাথ বিগ্রহকে পূজারী পুরাতন বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়ে নতুন ধুতি , উপজাত প্রভৃতি পরিধান করান। এই সব কাজ শেষ করার পর জগন্নাথদেব ভক্তের কাঁধে চড়ে মন্দির গৃহ পরিত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে স্নান বেদিতে নিয়ে আসা হয়। সঙ্গে চলে অবিরাম হরিনাম কীর্তন। উক্ত বিগ্রহ বেদিতে পুজার্চনাদির পরে গঙ্গা থেকে আনিত ১০৮ ঘট জলে জগন্নাথ দেব কে স্নান করানো হয়। জল ছাড়াও স্নানের কাজে দুধ ব্যবহৃত হয়। স্নানের পরে জগন্নাথদেব কে সারা দিন বিগ্রহ বেদিতে রাখা হয়। সন্ধের পর পুনঃরায় তাঁকে মন্দির গৃহে আনা হয়। স্নানের পর জগন্নাথদেবের প্রবল জ্বর আসে বলে একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে। জগন্নাথের সুভদ্রা বলরাম বিহীন মূর্তি হওয়া ও যশরা গ্রামে জগদীশ পণ্ডিতের জগন্নাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে লোক মুখে একাধিক গল্প প্রচলিত আছে। 


স্থানীয় কিছু বয়স্ক ব্যক্তির কাছে শোনা গল্প অনুযায়ী, একদা স্বপ্নে জগন্নাথ দেব জগদীশ পণ্ডিত কে দেখা দিয়ে পুরীধাম এ পাণ্ডাদের অত্যাচারে তাঁর দুর্দশার কথা জানান এবং অচিরেই  পুরীধাম ত্যাগ করে জগদীশ পণ্ডিত এর সাথে গঙ্গা তীরবর্তী  জগদীশ মনোনীত যে-কোন স্থানে একাই চলে আসার মনবাসনা ব্যাক্ত করলে তদানীন্তন পুরীর রাজা প্রতাপচন্দ্র রায় কে জগন্নাথদেব স্বপ্নে দেখা দিয়ে পুরীধাম ত্যাগ করে তাঁর চলে যাওয়ার কথা বলেন ও জগদীশকে এই ব্যাপারে সাহায্য করবার জন্য তাঁকে নির্দেশ দেন। স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশ অনুযায়ী জগদীশ পণ্ডিত জগন্নাথ বিগ্রহ পুরীধাম থেকে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহন করেন। জগদীশের মনে পড়ে যে স্বপ্নে জগন্নাথ দেব পুরীধাম থেকে তাঁর সঙ্গে চলে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও একটি শর্ত আরোপ করে ছিলেন যে, ওই শর্তে প্রভু জগন্নাথ কে পথের মধ্যে কোন স্থানে মাটিতে নামানো যাবে না। নামালে সেই জায়গাতেই তিনি থেকে যাবেন। জগদীশ পণ্ডিত নদীয়ার গঙ্গার তীরবর্তী কোন মনোরম স্থানে জগন্নাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে একটি পুটুলির মধ্যে জগন্নাথ বিগ্রহ ঝুলিয়ে পুরীধাম থেকে রওনা হন। পুরীধাম থেকে জগন্নাথ বিগ্রহ নিয়ে আসার সময় দীর্ঘ পথ ক্লান্ত জগদীশ পণ্ডিত চাকদহ এর নিকটে গঙ্গা তীরবর্তী যশরা গ্রামে কিছুক্ষণ যাত্রা বিরতি করে পূর্বশর্ত ভঙ্গ করে বিশ্রাম করেন। অচিরেই তিনি উপলব্ধি করেন তাঁর পুটুলিটি অত্যন্ত ভারী হয়ে উঠেছে এবং সেটি মাটি থেকে তোলাও তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। সেই জগন্নাথ বিগ্রহ এক বৃহৎ বিগ্রহ এ পরিনত হয়েছে। বিপন্ন জগদীশপণ্ডিত অতঃপর নিরুপায় হয়েই যশরা গ্রামে জগন্নাথ বিগ্রহ স্থাপন করেন এবং পুজাদি করতে লাগলেন। এই সংবাদ ক্রমশ ওই স্থানের মালিক কৃষ্ণনগরাধিপতির কর্ণগোচর হয়। তিনি সেই সংবাদ এর সত্যতা যাচাই করার জন্য তার দেওয়ানকে পাঠালেন। দেওয়ান সেই স্থানে এসে জগদীশকে জগন্নাথ বিগ্রহ টি সঙ্গে নিয়ে ওই স্থান পরিত্যগ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু জগদীশ তাকে বলেন যে বিগ্রহটি নিজের ইচ্ছায় এই এখানে স্থিত হয়েছে। ইহাকে স্থানান্তরিত করার ক্ষমতা তার নেই। দেওয়ান মহাশয় ঐ বিগ্রহ দর্শন করে ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে কৃষ্ণনগরে প্রত্যাবর্তন করে রাজসভায় এই সংবাদ নিবেদন করলেন। পরে কৃষ্ণনগরাধিপতি সেই স্থানে এসে জগদীশ পণ্ডিত এর মুখে সমস্ত কথা শুনে ওই বিগ্রহ এর জন্য ঠাকুর বাড়ি নির্মাণ এর ব্যাবস্থা করলেন এবং প্রচুর জমি বিগ্রহ এর সেবার জন্য দান করলেন। 

ঠাকুরবাড়ি নির্মাণ হলে বিগ্রহ কে ঐ স্থানে স্থাপিত করে পণ্ডিত জগদীশ নিজ ভ্রাতা মহেশ পণ্ডিত কে নবদ্বীপ ধাম থেকে এনে রেখে দিলেন পুজার জন্য এবং দুই ভাই মিলে জগন্নাথ দেব এর সেবায়  নিযুক্ত থাকলেন। অনুসন্ধান থেকে জানা যায় পরে জগদীশ পণ্ডিত ও মহেশ পণ্ডিত দুই ভাই তাদের জীবনের শেষ দিকে এক স্থানীয় বিশ্বনাথ গোস্বামীর উপর সেই মন্দিরের দায়িত্ব দিয়ে বৃন্দাবন চলে যান। পরবর্তী কালে বিশ্বনাথ গোস্বামীর বংশধরগন দীর্ঘদিন এই মন্দিরের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তী মন্দির পরিচালনাকে কেন্দ্র করে সংকট দেখা দিলে স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দের অনুরোধে শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় মঠ মন্দির পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সর্বশেষ জানা যায় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আগমন ঘটেছিল এমন ১০৮টি স্থান বেছে নিয়ে সেই সমস্ত স্থানে মন্দির গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন গৌড়ীয় মঠ যার মধ্যে চাকদহের যশরা জগন্নাথ মন্দির অন্যতম।

 
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : নদিয়া কথা, নদীয়ার ইতিবৃত্ত, চাকদহের ইতিহাস ও সংস্কৃতি (ডঃ  পবিত্র চক্রবর্তী )


No comments