Header Ads

হারবার্ট থেকে কাঙাল মালসাট, মৃত্যু উপত্যকার অস্থির কবি নবারুণ ভট্টাচার্য


"বাঙালির তরে যদি বাঙালি না কাঁদে, চুতিয়া বলিয়া তাকে  ডাকো ভীমনাদে"। আজকের সমাজে দাঁড়িয়েও এ কথা বলার সাহস দেখালেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম প্রতিবাদী কবি ছিলেন তিনি৷ এই দেশকে তিনি মৃত্যু উপত্যকার সাথে তুলনা করে লিখেছেন "এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না"। রাষ্ট্রসত্ত্বার দ্বারা সৃষ্ট আতঙ্ক ও সাধারণ মানুষের জীবনকে অমানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি করে দেওয়ার বিরুদ্ধে রাগ এবং যুদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। তাঁর কবিতা উপন্যাসে তিনি অঙ্কিত করেছেন মানুষের পরাজয়, দুর্ভোগ, অন্ধ রাজনীতির গল্প, মানবিক অবক্ষয় ও আত্মহননকে। সমাজের আর্তপীড়িত, অসহায়, সহায় সম্বলহীন মানুষের যাপনচিত্র, তাদের অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম বা নতুন করে স্বপ্ন দেখার কৌশল অদ্ভুত ভাবে তিনি উপস্থাপন করেছিলেন কবিতার মধ্য দিয়ে৷ তিনি হলেন বিপন্ন সময়ের একজন অস্থির কবি। নাম তাঁর নবারুণ ভট্টাচার্য। 


বাংলা সাহিত্যের প্রথা বিরোধী  কথাসাহিত্যিক ছিলেন তিনি। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত হতো বীভৎস সব ভাষা। প্রতিবাদের দগদগে আগুনের মতো উঠে এসেছে তাঁর কবিতার প্রতিটি চরণ৷ "যে সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে ভয় পায় আমি তাকে ঘৃণা করি। যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে আমি তাকে ঘৃণা করি৷ যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না আমি তাকে ঘৃণা করি।" বর্তমান যুগেও দাঁড়িয়ে কার ক্ষমতা আছে এমন কবিতা লেখার। অগ্নির স্ফুলিঙ্গের মতো ফুলে ফেঁপে তিনি সৃষ্টি করেছেন এসব কবিতা। যুগের সঙ্গে সমান প্রাসঙ্গিক তাঁর কবিতা। কেবল কবিতাই নয় তাঁর লেখা গল্প কিংবা উপন্যাসও আজকের যুগে সমান প্রাসঙ্গিক। 

নবারুণ ভট্টাচার্য রচিত 'হারবার্ট' বা 'ফ্যাতাড়ু ও চোক্তার' ও 'কাঙাল মালসাট' এই তিনটে উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাই তরুণ সমাজ তাঁকে 'ফ্যাতাড়ু কবি' বলে সম্বোধন করতে শুরু করে। এই তিনটে উপন্যাসের স্থান ছিল অধিক জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তবে তাঁর অন্যান্য উপন্যাসও যে জনপ্রিয় নয় এ কথাও বলা ভুল হবে কারণ 'লুব্ধক', 'খেলনা নগর', 'যুদ্ধ পরিস্থিতি',   'অটো ও ভোগী', 'মবলগে নভেল' প্রভৃতি উপন্যাস পাঠক সমাজে বেশ প্রশংসিত। তাঁর প্রিয় চরিত্র ছিল ফ্যাতাড়ু। উপন্যাসের পাশাপাশি ছোটোগল্পেও তাঁর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কয়েকটি ছোটো গল্পের নামও তিনি রেখেছিলেন ফ্যাতাড়ু দিয়ে যেমন 'ফ্যাতাড়ুর কুম্ভীপাক', 'ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক' ও 'ফ্যাতাড়ু বিংশতি'। 

নবারুণ ভট্টাচার্যের ছোটো গল্প, উপন্যাস থেকে এ সমাজের অনেক কিছু শেখার আছে। পিছিয়ে নেই তাঁর লিখিত কাব্যগ্রন্থও। তাঁর সৃষ্টি করা কাব্যগ্রন্থ সভ্যতার জীবন্ত নিদর্শন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো 'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না', 'পুলিশ করে মানুষ শিকার' ও 'রাতের সার্কাস'৷ তাঁর 'হারবার্ট' ও 'কাঙাল মালসাট' এর মতো তির্যক উপন্যাস, তাঁর প্রতিটি তির্যক কাব্যগ্রন্থ গড়ে তুলেছিল তাঁর প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভাবমূর্তি। ব্যক্তি জীবনেও তিনি ছিলেন অনাড়ম্বর। 

কবিতা, ছোটোগল্প, উপন্যাস তাঁকে একজন সৃজনশীল ব্যক্তি হিসেবে রাজ্যকে চিনিয়েছিল ঠিকই তবে মাতা প্রখ্যাত মহিলা সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী ও পিতা প্রখ্যাত নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের সন্তান হিসেবেও একটা পরিচিতি প্রথম থেকেই তাঁর বিদ্যমান ছিল। সমাজে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় অভিনেতার ছেলের অভিনেতা হওয়া সহজ, কবির ছেলের কবি হওয়া সহজ, নাট্যকারের ছেলের নাট্যকার হওয়া সহজ। এই ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ প্রতিভা না থাকলে প্রতিভাবান হওয়া যায়না। নবারুণ ভট্টাচার্য এমন ভ্রান্ত ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছেন। সকল প্রতিভাবান ব্যক্তিকে পরিশ্রম করেই জায়গা তৈরি করতে হয়। পৃথিবীতে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে রাজি নন। এই পৃথিবীতে সব মানুষকেই লড়াই করে বড়ো হতে হয়৷ সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর ছেলে হয়তো সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য। কিন্তু সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে সাহিত্যিক হতে পারেননি৷ অতএব প্রতিভা সর্বদা প্রতিভার জায়গাতেই বিরাজমান। 

আজ ২৩ শে জুন তাঁর জন্মদিন। ১৯৪৮ সালের ২৩ শে জুন মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক এই তিনটি পরিচয়ের মিশেলে তিনি গড়ে তুলেছিলেন স্বকীয় একটি ধারা। তিনি লিখে গেছেন রাষ্ট্রের আসল সত্ত্বা মানে সশস্ত্র সৈন্যবাহিনী, পুলিশ বাহিনী, কারাগার এবং বলপূর্বক অন্যের ইচ্ছেকে আয়ত্তে আনার অন্যান্য উপায়। মৃত্যু উপত্যকার বুকে তিনিই প্রথম ছুঁড়েছিলেন কবিতার অক্ষরকে৷ যে অক্ষর জমা হয়ে থেকে যাবে বাংলার আকাশ-বাতাস ও মাটিতে।


তথ্যসূত্র- বিকাশপিডিয়া, প্রভাস পত্রিকা

No comments