কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য সচিব রূপে দীর্ঘ আট বছর কর্মরত ছিলেন কবি অমিয় চক্রবর্তী
"ওরা কারা বুনো দল ঢোকে, এরই মধ্যে (থামাও; থামাও), স্বর্ণশ্যাম বুক ছিঁড়ে, অস্ত্র হাতে নামে সান্ত্রি কাপুরুষ, অধম রাষ্ট্রের রক্ত পতাকা তোলে, কোটি মানুষের সমবায়ী সভ্যতার ভাষা এরা রদ করবে ভাবে, মরু-পশু।" মনে কী পড়ে এই কবিতার কথা? কবিতার নাম বাংলা দেশ। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পুরানো বাংলা সিলেবাসে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা সহায়ক পাঠ নামের পাঠ্যবইতে অতিরিক্ত কবিতার মধ্যে রাখা হয়েছিল এ কবিতাকে৷ যিনি এ কবিতার জন্মদাতা। আজ তাঁর ১১৯ তম জন্মবার্ষিকী। তিনি হলেন বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম কবি অমিয় চক্রবর্তী। যার কাব্যে রয়েছে বিজ্ঞান ও কল্যাণের সন্ধি ঘটানোর প্রচেষ্টা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন "বিষয়ের গৌরব বিজ্ঞান-দর্শনে, কিন্তু রূপের গৌরব রসসাহিত্যে। কবিও বিজ্ঞান ও সাহিত্যকে একসূত্রে গ্রথিত করতে উদ্যত হয়েছেন। কবির কাব্যে তাই বিজ্ঞান ও মঙ্গল এক ভাবনায় ভাবিত। 'পালাবদল' কাব্যের 'নারীমূর্তি' কবিতার সেই চিত্র বিধৃত। কবির কাব্যে প্রকৃতিও খুব স্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে। তিনি টুকরো-টুকরো ছবিগুলিকে একটি সামগ্রিক রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন। আসলে কবি প্রকৃতিকে নিছক বর্ণনার মধ্যে রেখে কবি প্রকৃতি ভাবনাকে কাব্যে স্থান দিতে চেয়েছেন। কবি অমিয় চক্রবর্তী একজন আন্তর্জাতিক কবি৷ সমস্ত মানুষের প্রতি কবির দৃষ্টি ছিল গভীর, তাই কাব্যে দেশ-বিদেশের সীমা মুছে গিয়ে একাকার হয়ে গিয়েছিল অর্থাৎ ভূগোল-দর্শনকে এক সূত্রে মেলাবার চেষ্টা করেছিলেন।"
১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ১০ ই এপ্রিল হুগলির শ্রীরামপুরে জন্মগ্রহণ করেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। যার আসল নাম ছিল অমিয় চন্দ্র চক্রবর্তী। পিতা দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন পেশায় একজন দেওয়ান ও মাতা অনিন্দিতা দেবী পেশায় ছিলেন সাহিত্যিক, যিনি 'বঙ্গনারী' ছদ্মনামে প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশ করতেন। তিনি তাঁর মায়ের কাছ থেকে অতি শৈশবেই বাংলা ও সংস্কৃত ব্যাকরণে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।
অমিয় চক্রবর্তীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার হেয়ার স্কুলে। এখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি সেন্ট্ কোলাম্বাস কলেজ থেকে আই.এ পাস করেন। এরপর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ পাস করে শান্তিনিকেতনে গবেষণা বিভাগে যোগদান করেন। তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে দর্শন, সাহিত্যে ও বোটানিতে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন৷ পরবর্তীকালে তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯২৬ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত প্রায় আট বছর ধরে এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৩৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে যোগ দেন। ১৯৩৭ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিফিল ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৪০ থেকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। এরপর ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ২৯ বছর সপরিবারে আমেরিকায় তিনি বসবাস করতেন৷ এই সময়ের মধ্যে তিনি হাওয়ার্ড, বস্টন ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক প্রাচ্য ধর্ম ও সাহিত্যে অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কবি ইয়েটস, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, বোরিস পান্তেরনাক, জর্জ বার্নাড'শ, পাবলো কাসালস্ প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসেন তিনি।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কবিগুরুর সচিব হিসেবে কাজ করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন "একান্ত উৎসাহে ভাস্বর সেই অভিজ্ঞতা আজ পর্যন্ত আমার মানসিক অধিকারের বাইরে রয়ে গেছে। শালবীথির তপ্ত ছায়াবৃত মর্মর, ছাতিমতলার শুভ্র স্তব্ধ পাথর এবং উৎকীর্ণ মন, রবীন্দ্রনাথের গভীর বাক্যালাপ এবং অজস্র আতিথ্য, প্রমথবাবুর হাস্যকৌতুকময় প্রখর মননশীল আলোচনা ও বন্ধুত্বের অযাচিত দান একটি অপরিণত, অজ্ঞাত বাঙালি ছেলের সাহস আশা কল্পনাকে ছাপিয়ে অপরূপ হয়ে দেখা দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গভীর বাক্যালাপ এবং অজস্র আতিথ্য, প্রমথবাবুর হাস্যকৌতুকময় প্রখর মননশীল আলোচনা ও বন্ধুত্বের অযাচিত দান একটি অপরিণত, অজ্ঞাত বাঙালি ছেলের সাহস আশা-কল্পনাকে ছাপিয়ে অপরূপ হয়ে দেখা দিয়েছিল৷ আজও বুকে জেগে আছে আকাশ মাঠ খোয়াইয়ের পাণ্ডুর উজ্জ্বল বলয়-চক্র, দারুণ গ্রীষ্মে উৎফুল্ল আমলকী-সারি এবং বহু দূরে পাড়-বসানো সবুজ তালতড়ি। আশ্রমেরই অভিন্ন অন্তর্গত রূপে সেই দৃষ্টি আমার কৈশোর জীবনে প্রসারিত।"
কবি অমিয় চক্রবর্তীর বয়স যখন অল্প তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মারা যান। যার শোকে তিনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তাঁর শরীরের মধ্যে ভর করে চঞ্চলতা। তিনি হয়ে ওঠেন ক্রীড়ানুরাগী। তাঁর মামা নিখিলনাথ মৈত্র তাঁকে হেয়ার স্কুলে ভর্তি করে দেন৷ তাঁর মামার অনুপ্রেরণায় তিনি সাহিত্যের প্রতি প্রচন্ড উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তাঁর মামা নিখিলনাথ মৈত্র ছিলেন তার চিন্তা-কল্পনার প্রধান অধিনায়ক। তাঁর মামা তাঁকে বীরবল ও সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন। এখান থেকেই তাঁর কবিতা লেখার সূচনা হয়।
দীর্ঘকাল প্রবাসে থাকার জন্য তাঁর কবিতার মধ্যে লক্ষ্য করা যায় পাশ্চাত্য দর্শন। তাঁর কবিতায় রয়েছে আন্তর্জাতিকতা ও দেশের গভীর একাত্মবোধ। আন্তসংগীতের প্রতিও ছিল তাঁর নিবিড় আকর্ষণ। কলেজে পাঠরত থাকাকালীন তিনি কিছুকাল সেতার শেখেন৷ বিথোফেন ও রাশিয়ান সংগীতের প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। ছাত্রাবস্থায় মিশনারিদের সাথে গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন আর্তপীড়িতদের সেবা করবার জন্য। তাঁর কবিতার মধ্যে রয়েছে বিশ্ববৈচিত্রের পরিচয় ও অনন্য রূপরসে তাঁর কবিতাগুলো হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তাঁর কবিতার রীতি বৈশিষ্ট্য ছিল গদ্যসাহিত্য। তিনি রচনা করেন অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ। তাঁর সৃষ্টি করা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো খসড়া, একমুঠো, মাটির দেয়াল, অভিজ্ঞান বসন্ত, পারাপার, পালাবদল, ঘরে ফেরার দিন প্রভৃতি। এছাড়াও তিনি চলো যাই, সাম্প্রতিক, পুরবাসী ও পথ অন্তহীন শিরোনামের কিছু গদ্য রচনা করেন। আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে তাঁর কবিতার যথেষ্ট অন্তর্নিহিত যোগাযোগ ছিল।
সাহিত্যচর্চার জন্য তিনি অর্জন করেন ইউনেস্কো পুরস্কার, পদ্মভূষণ ও সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার৷ কবি অমিয় চক্রবর্তী কবিগুরুর সচিবরূপে কাজ করার ফলে তাঁর কাব্যে রবীন্দ্র প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গিয়েছিল৷ কিন্তু তিনি তাঁর মনের অদম্য প্রচেষ্টায় স্বাতন্ত্র্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন৷ তাই তাঁর কাব্যে প্রাচ্য পাশ্চাত্য সাহিত্যলব্ধ জ্ঞান, দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতার ছাপ, বিজ্ঞানভাবনা প্রভৃতি প্রতিফলিত হয়েছে। সমাজচেতনা প্রখর ছিল কবির৷ তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সামাজিক চিত্রগুলি ধরা পড়েছে তাঁর কাব্যে। কবির 'একমুঠো' কাব্যে মধ্যবিত্ত সমাজের ছবি ধরা পড়েছে। তাঁর '১৩৫০' ছোটো কবিতাটিতে মন্বন্তরের চিত্রের ভাব বিধৃত। 'সত্যাগ্রহ' কবিতাটিতে কবি তৎকালীন ইতিহাসকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন৷
ঋণ-কয়াল-বন্দোপাধ্যায় উচ্চমাধ্যমিক বাংলা সহায়িকা, উইকিপিডিয়া, দৈনিক আজাদী, বাংলাপিডিয়া
Post a Comment