Header Ads

বাংলা প্রকাশনা শিল্পে নতুন সময়ের সূচনা || প্রথম পর্ব


বাংলা প্রকাশনী জগতের জানা-অজানা গল্প। বাংলা বইয়ের পাঠক কমছে নাকি বাড়ছে? অনলাইনের যুগে বই পড়ার মানুষ কী একেবারেই কমে যাচ্ছে? একদমই না, যুগ বদলালেও বই পড়ার গুরুত্ব এতটুকুও কমে যায়নি বাঙালি  পাঠকদের মধ্যে। এ প্রজন্মের বিভিন্ন লেখকদের নতুন নতুন বই পাঠকদের মুগ্ধ করছে। পুরানো বাংলা বইয়ের নতুন সংস্করণ যেমন টিকে আছে তেমনই বাজারে নতুন বইয়েরও আগমন ঘটছে। বাংলা প্রকাশনার জগতে শুরু হয়েছে নতুন সময়। আজকে বাংলা বই শুধু পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা বা বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় সারা বিশ্বব্যাপী বাঙালির কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমের সহায়তায় বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলা বইয়ের মার্কেট শেয়ার। 


বাংলা প্রকাশনা জগতে অনেক অভিযোগ শোনা যায় যে আজকাল বাংলা বই বিক্রি  হচ্ছে না। বাংলা বই প্রকাশ করে প্রকাশকদের মোটা টাকা রোজগার হচ্ছে না। বাংলা প্রকাশনার ডাউন মার্কেট চলছে। নতুন নতুন লেখক উঠতে পারছে না। নতুন লেখকদের প্রকাশকরা সুযোগ দিচ্ছেন না। একটা বই এক বছরের বেশি টিকছে না প্রভৃতি নানান অভিযোগ শোনা যায় অনেক মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু এই ধারণাগুলো একেবারে ভুল। 

বাংলা বই ও বাঙালি প্রকাশনী সংস্থার ঠিক ভুল নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের দেখতে হবে কোন প্রকাশনী কীভাবে কাজ করছে? অনেকের মুখে যেমন একটা কথা প্রায় শোনা যায় যে অনেক প্রকাশনী টাকা নিয়ে বই ছাপিয়ে পুরো টাকা আত্মসাৎ করে নেয়। এর প্রধান কারণগুলো নিয়ে আমরা ভাবনাচিন্তা করিনা৷ একটা বিষয় ভুলে যায় যে প্রকাশনা একদিকে যেমন সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যম অন্যদিকে এটা ব্যবসারও মাধ্যম। কাজেই সাধু ও অসাধু দুই ব্যবসায়ী প্রতিটি ব্যবসাতে থাকে। প্রকাশনীর ক্ষেত্রে সাধু বা অসাধু ব্যবসায়ীর ব্যাপারটা আলাদা। কিছু পাবলিশার্স যেমন টাকা নিয়ে বই করে, আবার কিছু পাবলিশার্স ফ্রীতে বই করে। প্রকাশনা জগতে অসাধু কাদের বলা হয়? যে সমস্ত প্রকাশনী বুক পাবলিশিং এর যে নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে সেই নিয়ম থেকে বেরিয়ে নিজেদের মতো করে কেবল টাকার লোভে মার্কেটে বই নামায়। যাদের মার্কেটিং, সেলস্ বা হিউম্যান সাইকোলজি সম্পর্কে কোনো ধারনা নেই বা জানার আগ্রহ থাকেনা। কেবল লেখককে প্রাপ্য সম্মান না দিয়ে কিংবা লেখককে ভুল বুঝিয়ে বই ছাপানো৷ এই টাইপের প্রকাশনীরা অসাধু। যাদের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে তুলনামূলক ভাবে কম৷ টাকা নিয়ে বই ছাপানো কখনোই খারাপ নয় কিন্তু টাকার বিনিময়ে লোক ঠকিয়ে বই প্রকাশটা খারাপ জিনিস। প্রতিটি ব্যবসাতেই ভালো বা খারাপ সংস্থা থাকে। তাই আমরা নজর রাখবো প্রকাশনী জগতে কারা ভালো কাজ করছে?  

বাংলা বইয়ের উন্নতির জন্য জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন প্রকাশনী। যারা সমানে বড় প্রকাশনী সংস্থাকে টক্কর দিচ্ছে। ছোট-বড় ও মাঝারি মিলিয়ে অসংখ্য পাবলিশার্স বাংলা বইকে নতুন দিশা দেখাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে যেমন জনসংখ্যার পরিবর্তন ঘটেছে। বই পড়ার ধরণ বদলেছে। মানুষের জীবনযাত্রা বদলেছে। মানুষের চিন্তাভাবনাতে পরিবর্তন এসেছে। যোগাযোগ মাধ্যমের বিকাশ ঘটেছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিটি জিনিসের মতো প্রকাশনা শিল্পেও বিশেষ পরিবর্তন ঘটাতে হয়েছে। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলা প্রকাশনা শিল্প অনেকটাই উন্নতি করে ফেলেছে। বছরের পর বছর বইমেলাতে যে হারে পাঠকের ভিড় ও বাংলা বইয়ের বিক্রি বাড়ছে তাতে বাংলা বই আরো সমৃদ্ধ হচ্ছে। সারা বাংলা জুড়ে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলা প্রকাশনীগুলো এগিয়ে চলেছে। 

লিটারেসি প্যারাডাইস বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থা ও দু-একজন এ প্রজন্মের জনপ্রিয় লেখক-লেখিকার কাছ থেকে বাংলা বই, বাংলা প্রকাশনী সংস্থাগুলো কীভাবে কাজ করছে, কীভাবে বাংলা বই উন্নতি করছে, বাংলা বইয়ের ভবিষ্যৎ প্রভৃতি বিষয়ে বেশ কিছু বিবৃতি তুলে আনার চেষ্টা করেছে। যে বিবৃতিগুলো প্রমাণ দেয় বাংলা প্রকাশনা শিল্প অনেকটাই এগিয়ে চলেছে।

বুকফার্ম পাবলিশার্সের সহ-সম্পাদক শান্তনু ঘোষ বলেন "বাংলা বইয়ের যারা পাঠক তারা শুধু তো বাংলা জুড়ে নয় সারা পৃথিবী জুড়ে অবস্থান করেন৷ বাংলাদেশ হলো বৃহৎ অংশ বাংলা বইয়ের পাঠকদের জন্য। এতো বড়ো বাংলা বইয়ের বাজারে সত্যি কথা বলতে আমরা খুবই একটা ছোটো ট্র্যাক শুরু করেছি৷ ফলে আমি জানিনা এই বক্তব্যটা রাখার মতো আমাদের যোগ্যতা আছে কিনা। তবুও বলছি কিছু কথা। আমি সেলস্ ও মার্কেটিং ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলে। যে-কোনো ধরনের ব্যবসা প্রথমে আমরা সেলসের অ্যাঙ্গেল থেকে ভাবি। এটাই হচ্ছে বুকফার্মের ভাবনাচিন্তার বেসিক। আর যে-কোনো ব্যবসার মতো বই ব্যবসা করতে গেলে সবার আগে যেটা লাগে সেটা হলো একটা কোয়ালিটি প্রোডাক্ট। তুমি যেটাকে নিয়ে মার্কেট করবে বা সেলস্ করবে সেটা যেন হয় কোয়ালিটি প্রোডাক্ট। এই কোয়ালিটি শব্দটা নির্ভর করে কনজিউমারের ওপরে। কনজিউমারের অ্যাঙ্গেল থেকে এক এক রকম টার্গেট কনজিউমারের জন্য এক এক দিকে ভালো। প্রথম কথা হচ্ছে  আমরা যেটা করি, আমরা কেবল আমাদের প্রকাশনের কথাই বলছি। আমরা অন্য কোনো প্রকাশনের বিষয়ে মন্তব্য করার মতো জায়গাই নেই। অনেক বড় বড় প্রকাশনা আছে তাদের বিভিন্ন  ইস্যু নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবনা আছে৷ লেখক নির্বাচন, লেখক পরিচিতি, লেখকের ভাবনা, এবং তার মেধা সবকিছু মিলিয়ে তার মননগত লেখনীটাই হচ্ছে আমাদের এ ক্ষেত্রে একটা প্রোডাক্ট। সেই প্রোডাক্টটাকে আমরা খুঁটিয়ে সার্চ করি, খুঁটিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা-পর্যালোচনা করি তার জন্য আমাদের একটা অভিজ্ঞ টিম আছে। লেখক নিজের মতো করে তার মননজাত লেখা বা সম্পদ দিলেন আর আমাদের এডিটিং টিম সেটা সুন্দর করে এডিট করে বেসিক প্রোডাক্ট তৈরি করলো৷ এই প্রোডাক্টটাকে আমরা যেটা করি আমাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে প্যাকেজিংটা যত্নের সাথে করার চেষ্টা করি। তারপর আমরা যেটা পরিকল্পনা করি সেটা হলো আমরা কীভাবে বইটিকে মার্কেট করবো। যে-কোনো সেগমেন্টেই চ্যালেঞ্জ আছে, কম্পিডিশন, ডাউনফল, সাফল্য এগুলো থাকে। কিন্তু সেগুলোর সঙ্গে সঙ্গে যেটা থাকে তা হলো নতুন নতুন লে-আউট বের করার রাস্তা। নতুন মার্কেট এক্সপ্লোর করা যেতে পারে, নতুন ভাবে বলা যেতে পারে, নতুন করে প্রেজেন্ট করা যেতে পারে। সেটা আমরা দীর্ঘ সময় ধরে হোমওয়ার্ক করি। একটা প্রোডাক্টকে নিয়ে নারচার করি। নারচারিংটাই হয়তো আমাদের কোম্পানির আরেকটা বড়ো বৈশিষ্ট্য। একটা ডিম থেকে যখন একটা ছানা বের হয় তার আগে তাকে ওম নিতে হয়। তাকে ইনকিউবিশন করতে হয়। এই ওম দেওয়া বা তাকে নারচার করবার জন্য তার একটা সময় যেটা আমরা দিই, যাতে কিনা একটা ভালো প্রোডাক্ট পাঠকের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারে৷ তার ফিজিক্যাল ডিস্ট্রিবিউশন, প্রাইভেসি পলিশি, ওয়েবসাইট পলিশি আমরা সেটার ওপর ওয়ার্কআউট করি৷ আমরা লজিস্টিক্সের ওপর ওয়ার্কআউট করি। আমরা স্কিলস ও সেলস্ ম্যানেজমেন্টের ওপর ভরসা করি৷ আমরা ভালো প্রিন্ট, ভালো কোয়ালিটির পেপারে ছাপা, তার হরফ নির্মাণ, হরফ নির্বাচন এগুলোকেও সমান গুরুত্ব দিই৷ এখন পর্যন্ত যেটুকু জার্নি হয়েছে কম-বেশি কী মাঝারি সে বিচারের ভার আমি পুরো পাঠকের ওপরই ছেড়ে দিলাম৷ এরপর কেউ যদি বলে মার্কেটিং এ অপারচুনেটি কী আছে? আমি তাদের বলবো মার্কেটিং এ অপারচুনেটির কোনো শেষ নেই৷ খোঁজার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে৷ আমরা সর্বদা চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি বা পারিনি জানিনা। তবুও চেষ্টা করে গেছি৷ আমরা চেষ্টা কখনো ছেড়ে যাইনি৷ 

এখনো আমাদের অনেক বই আছে যেগুলো আমরা সর্বপ্রকার পাঠকদের কথা ভেবে বানিয়েছি৷ কিছু বইয়ের ক্ষেত্রে হয়তো নারচার বা ওম দিতে পারিনি। কিন্তু পাঠকের কাছে থেকে গেছে৷ ফলে সেগুলো আমাদের ড্রব্যাকস। আমরা সেই ড্রব্যাকসগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করি। আমরা চেষ্টা করি সেই ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন কিছু করবার চেষ্টা করি। যে কজন লেখক প্রথমদিন থেকেই আমাদের সাথে রয়েছেন৷ আমরা তাদের কারও হাত কখনো ছাড়িনি৷ যে বন্ধুরা প্রথমদিকে যাদের আপনারা কেউ চিনবেন না, আমাদের সাথে তারা কাজ করেছেন। আমরা চিরকাল তাদের জন্য দায়বদ্ধ। তাদের হাত আমরা ধরেই চলবো। আমাদের হাত হয়তো কেউ ছাড়বেন। আমরা তাদেরকেও হাত ধরে ফেরৎ এনে বলবো যে আমরা একসাথে কাজ করবো৷ আমাদের হাত কেউ ছাড়বেন না৷ যারা নতুন লেখক আছেন তারা এই ভাবনাটা দেখেই এগিয়ে আসতে চাইছেন। এরা এই ভাবেই ভাবে। যাদের পছন্দ হয় তারা মনে করেন আমাদের টিমে কাজ করবেন৷ এটার জন্য আমরা তাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আমরা অতীতের কোনো বন্ধুদের হাত ছাড়বো না৷ যদি নতুন কোনো বন্ধুর হাত ধরি সেই হাতও শক্ত করে ধরবো৷ এটাই আমাদের শিল্প সাধ্যের মধ্যে ইচ্ছে ও প্রকাশনা।"

মুখার্জি পাবলিশিং এর কো-অর্ডিনেটর রাখাল রাজ মুখার্জি বলেন "বাঙালির সংস্কৃতি, বাঙালির মনন, বাঙালির চিন্তাভাবনা এগুলো যত আধুনিক হবে, যত সর্বোচ্চগামী হবে এটা ধরে রাখার জন্য স্থায়ী মাধ্যম হচ্ছে  বই। যুগের সঙ্গে যুগের যে পরিবর্তন ঘটছে আমার সাথে আমার ঠাকুরদার বা আমার সাথে আমার সন্তানের চিন্তাভাবনার যে পরিবর্তন হচ্ছে। চেতনার যে পরিবর্তন ঘটছে। সেগুলো সব স্থায়ীভাবে রেখে দেওয়ার মাধ্যম হলো বই। যা যুগের পর যুগ চলে। আমরা মারা যাই কিন্তু বই যুগের পর যুগ চলে। বইয়ের যুগ ও বইয়ের যে ধারাবাহিকতা তাকে আমরা রেখে যেতে চাই৷ বইয়ের যে ব্যাপারগুলো সেটা আমরা জাতির কাছে, সমাজের কাছে ও দেশের কাছে তুলে ধরতে চাই। এটাই হচ্ছে আমাদের মোটো৷ এবার সৃষ্টিশীল প্রবাহধারা চলে সাহিত্যের, বিজ্ঞানের, দর্শনের ও চিন্তাভাবনার। কখনোই আমরা আজগুবি জিনিস, অযৌক্তিক জিনিস, সমাজের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক হয়, পুরুষ বা নারীর অসম্মান হয় এরকম বই আমরা প্রকাশ করিনা৷ কোনোরকম লিঙ্গ বৈষম্য, অদ্ভুত ও অযৌক্তিক জিনিস, অবিশ্বাস্য জিনিস যা বিজ্ঞাননির্ভর নয় এমন জিনিস আমরা প্রকাশ করিনা৷ তার মানে আমরা কী কী করি বা করছি তাতে মানুষের চিন্তাভাবনার উপকার হবে, মানুষের মননের উপকার হবে, মানুষের যুগের যে ধারাবাহিকতা তাকে রক্ষা করবে। এরকম সৃষ্টিশীল বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ও ভারতীয় সংস্কৃতিকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছি।"

সপ্তর্ষি প্রকাশনের কার্যনির্বাহী প্রকাশক সৌরভ মুখোপাধ্যায়  বলেন "আমরা কী বই নিয়ে কাজ করছি না করছি সেটা তো বলতে পারবো না।এটা বলবে আমাদের পাঠক৷ গত কুড়ি বছর ধরে সপ্তর্ষি প্রকাশন বাংলায় প্রায় পাঁচশো থেকে সাড়ে পাঁচশো বই প্রকাশ করেছে। তার মধ্যে বেশ কিছু বই জনসমাদর পেয়েছে৷ কিছু পুরষ্কৃত বইও রয়েছে। যা দেখে বোঝা যায় পাঠকের কাছে সপ্তর্ষি প্রকাশনীর একটা অ্যাকসেপ্টেন্স রয়েছে বইয়ের ক্ষেত্রে। সেটা কলকাতা বইমেলা বা অন্যান্য জায়গাও হতে পারে৷ পাঠক সমাজকে এমনিতেই দেখে বোঝা যায়।আমরা যদি কিছু না করতাম তাহলে পাঠকেরা আমাদের ডেকে নিতেন না৷ আর প্রসারের জন্য কী করবো? আমরা তো নিজেদের মতো প্রসারের জন্য কাজ করছি৷ আর বাংলা ভাষার প্রসার করবো বা বাংলা সংস্কৃতির প্রসার করবো এভাবে তো কাজ করা যায়না৷ আমরা মূলত দুরকম কাজ করি৷ একটা হচ্ছে যে রকম অনেক বই এখন আর ছাপা পাওয়া যায়না। কিন্তু সেই বইটি হয়তো খুব মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বই। সেই বইটিকে নতুন করে ফিরিয়ে আনার কাজ আমরা করি৷ তাতে আমাদের মনে হয় বাংলা সংস্কৃতির প্রসারে একটা অন্যতম ভূমিকা পালন করবে। আমাদের ট্যাগলাইন যেহেতু ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার, নেচারেলি ঐতিহ্যের জন্য পুরানো বাংলা বইকে নতুন করে প্রডিউস করা এই কাজটি আমরা করি এবং সেটি একটি অন্যতম মূল্যবান জায়গা৷ তার সাথে সাথে নতুন লেখকদের খুঁজে বের করা৷ কিংবা এই সময় যারা লেখালেখি করছেন বিভিন্ন বিষয়ে বা অনেকে সরাসরি লেখক নন কিন্তু তাদের কথা বলতে চান৷ এরকম মানুষদের লেখা নিয়েই আমরা কাজ করে চলেছি৷ সেইগুলো দেখে স্বাভাবিক ভাবে আমার মনে হয় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসারের ক্ষেত্রে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে থাকে।

এ প্রজন্মের জনপ্রিয় লেখিকা দেবারতি মুখোপাধ্যায় বলেন "আমরা বই লিখি। এটা একটা সৃষ্টি। বই প্রকাশ করেন প্রকাশক৷ লেখকের কাজ হচ্ছে বই লেখা, কোনো একটা রচনা এবং সেই রচনা থেকে পাঠকের কাছে পৌঁছানো ছাপার অক্ষরে৷ আর ডিস্ট্রিবিউশনের কাজ হচ্ছে প্রকাশকদের। বুকফার্ম ভীষণই নতুন একটি প্রকাশনী সংস্থা।পাঁচ বছরও হয়তো ওদের হয়নি কাজ শুরু করার৷ কিন্তু ওদের টিমের অ্যাট্রিবিউট এতোটাই প্রসংশনীয় যে কারণে আমি মনে করি যে ওরা লম্বা রেসের ঘোড়া৷ এক নম্বর হচ্ছে তাদের বইয়ের ডিস্ট্রিবিউশন নতুন পাবলিকেশন হয়েও ভীষণই ভালো৷ অনলাইনে বলুন, অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট বা রিডবেঙ্গলির মতো বুক পারচেসিং সাইট বলুন বা কলেজ স্ট্রিট বা বিভিন্ন জেলার বইমেলা সমস্ত জায়গায় ওদের বই যথেষ্ট ভালো অ্যাভেলেভেল রয়েছে কনটিনিউয়াস বেসিসে৷ দুই নম্বর হলো ওদের প্রোডাকশন৷ ওদের প্রতিটি বইয়ের ছাপা অক্ষর, নাম থেকে শুরু করে প্রচ্ছদ সবই খুব চোখে পড়ার মতো৷ তিন নম্বর হচ্ছে একজন লেখককে তার প্রাপ্য সম্মান সুষ্ঠুভাবে প্রদান করে থাকেন৷ তো এই তিনটি কাজের জন্যই আমার মনে হয় বুকফার্ম অনেক দূর যাচ্ছে। আরেকটা কথা হচ্ছে যে শুধুমাত্র মার্কেটের দিকে না তাকিয়ে ব্যতিক্রমী কাজও তারা করে। প্রকাশক তো চাল, ডাল বা আলুর ব্যবসাদার নয়। তাদের একটা সামাজিক বদ্ধতা থেকেই যায়। সমাজে একটা বেটার কিছু হলো বইয়ের জন্য। সেই বইটা কর্মাশিয়ালি হয়তো বাজারে খুব বেশি বিক্রি হয়নি৷ সেখানে কিন্তু একটা কাল্ট বই হলো৷ এরকম ব্যাপারে ইমেজ করতেও তারা পিছোপা হননা৷ 

বাংলা প্রকাশনার অবস্থা যথেষ্টই এখন অসাধারণ। কারণ গত এক দেড় বছরে প্রচুর ছোটো-ছোটো প্রকাশনা উঠে এসেছে যারা ভীষণভাবে ডেডিকেটেড। তারা সকলেই অত্যন্ত অল্প বয়সী৷ তারা সকলেই প্রচন্ড পরিশ্রমী। তাদের বাংলা ভাষার প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা রয়েছে। আগে যেমন লেখকদের লিটিল ম্যাগাজিনে লিখতে হতো এমনটা কিন্তু এখন আর নেই। এখন ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে লেখক লেখা প্রকাশের জন্য নতুন করে আলো দেখতে পাচ্ছে। কাজেই বাংলা প্রকাশনীকে নিয়ে আমি প্রচন্ড আশাবাদী।"

হাওয়াকল পাবলিশার্সের সম্পাদক বিতান চক্রবর্তী বলেন "প্রকাশনীর ক্ষেত্রে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সঠিক বই বানানো, সঠিক বিষয় নির্বাচন, সঠিক পাঠককে বেছে নেওয়া মানে আপনি কোন পাঠকদের উদ্দেশ্য করে বইটা বানাচ্ছেন বা আপনার টার্গেট কে বা কারা? প্রকাশকের কাছে নির্বাচনটাই সবচেয়ে বড়ো কাজ৷ সেই মতো করে বইকে ইনভাইট করা, সেই বইগুলো এডিট করা যাতে সেই বইগুলো পড়তে পাঠকদের সমস্যা না হয়। আমরা যখন কাজ শুরু করি তখন বাংলা প্রকাশনা সংস্থাতে এডিটিং নামক বস্তুটাই উঠে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে। সেখানে তখন পয়সা দিয়ে বই হতো, বই লোকে পয়সা দিয়ে করছে, বই নিয়ে লোকে চলতে যাচ্ছে, পাঠককে ফ্রীতে বিলিয়ে দিচ্ছে। সেই বইগুলোর বয়স তখন মিনিমাম তিন থেকে চার মাস। ঐ মার্কেটে এসে সমস্যা তো আমাদের অবশ্যই হয়েছিল৷ লেখকদের কিছু ইগোও থাকে যে কেন ইডিডটা করবো, আমি তো একজন বড় লেখক, আমি কেন এডিটটা করাবো। তো কিছু লেখকদের ইগোর সাথেও আমাদের লড়াই করতে হয়েছে। তাকে বোঝাতে হয়েছে যে কেন এডিটিং দরকার৷ আমরা বিশ্বাস করি, যে-কোনো ভালো জিনিসের মার্কেট আছে। সেটাকে বিক্রি করা যায়৷ এমনকি বিক্রি করা জানতে হয়৷ 

বাংলা বই বিক্রি বেড়েছে না কমেছে এই হিসেব কারোর কাছে নেই৷ আগের বলতে কতো আগের বলা হচ্ছে? পঞ্চাশ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে যে হারে বাঙালি বসবাস করতো, আজকে পঞ্চাশ বছর পরে বাঙালির জনসংখ্যা তো অনেক বেশি স্বাভাবিক ভাবে। এবার তুলনা হতে পারে আজকে এন্টারটেইনমেন্টের সময় কতজন বই পড়ছেন বা বইকে নিয়েছেন কতজন৷ একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে যে বরাবরই বইয়ের পাঠক কিন্তু কম৷ সারা পৃথিবীতে বইয়ের পাঠক খুবই কম৷ যাকে আমরা পাঠ করা বলি। বাজারে বই কেনার লোক প্রচুর৷ এখন আর আমাদের কখনো মনে হয়না যে পাঠকের সংখ্যা কম। আমরা বিভিন্ন বইমেলাতে যাচ্ছি বা সারা বছর বই বিক্রির কাজ দেখছি।অনলাইন হোক, কলেজ স্ট্রিটে হোক, অন্যান্য জেলাগুলোতে বা ভারতের অন্যান্য ছোটো-ছোটো শহরগুলোতে বইয়ের স্টলগুলো হোক সেখানে নিয়মিত বই বিক্রি হচ্ছে। পাঠকের এমনিতে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে লেখক যে বইটি বের করছেন সেই বইটা কতজন পাঠক পড়ছেন বা কতজন পড়ছেন না। ঐ বইটির কোয়ালিটি কেমন। আসল কথা হলো বইয়ের কোয়ালিটি৷ আর প্রত্যেকটি বইয়েরই নির্দিষ্ট পাঠক থাকে। সিনেমাতে যেমন নির্দিষ্ট অডিয়েন্স থাকে তেমনই বইয়েরও নির্দিষ্ট পাঠক থাকে৷ সেই অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছাতে পারছি কিনা৷ আজকে মার্কেটিং পার্টে বাংলা প্রকাশনা জগৎ অনেকটা এগিয়ে এসেছে৷ বাংলা প্রকাশনা মার্কেটিং এ জোর দিচ্ছে। একটা কথা হচ্ছে মার্কেটিং শুধু প্রকাশনা নয়, এটা লেখকেরও কাজ৷ ফলে সেদিক থেকে তো কোনো কোনো লেখক ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এগিয়ে আসেন। হয়তো কোনো লেখক বুঝতে পারেন নি৷ অদূর ভবিষ্যতে পাঠকদের মাধ্যমে তিনি সেটা বুঝে যাবেন এবং তারাও এগিয়ে আসবেন৷ এই কাজটা যদি আদৌ করা যায় তাহলে বাংলা বইয়ের পাঠকের অভাব ঘটবে না।"




No comments