Header Ads

টুসু উৎসব বাংলার সম্পদ। এর ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হবে যুগ যুগ


মকর সংক্রান্তি যা গ্রাম বাংলায় মকর পরব নামে পরিচিত। এই সময় বাংলার দিকে দিকে চলে উৎসবের সমারোহ। বাংলার দক্ষিণে গঙ্গাাগর মেলা, বাংলার পশ্চিম প্রান্তের জেলা যথাক্রমে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, মানভূম ও সিংভূমের টুসু উৎসব, গ্রামে গঞ্জে গঙ্গামেলা, মকর স্নান, বনভোজন ইত্যাদিতে মেতে ওঠে বাঙালি। 



টুসু উৎসব বা মকর পরব একটি লোকউৎসব, যা বাংলা অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিনে শুরু হয় আর শেষ হয় পৌষ সংক্রান্তি বা মকর-সংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে। টুসু এক লৌকিক দেবী যাকে কুমারী হিসেবে কল্পনা করা হয় বলে প্রধানত কুমারী মেয়েরা টুসুপুজার প্রধান ব্রতী ও উদ্যোগী হয়ে থাকে। সাথে সাথে চলতে থাকে টুসু গান গাওয়া। মকর সংক্রান্তির টুসু গান বাংলার বহু প্রাচীন ঐতিহ্য। ঝাড়খণ্ড ও পুরুলিয়া জেলার অধিকাংশ স্থানে পুরাতন প্রথা অনুযায়ী টুসু উৎসবে কোন মূর্তির প্রচলন নেই, কিন্তু পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ান থানা এবং বাঁকুড়া জেলার খাতড়া থানার পোরকুলের টুসু মেলায় টুসু মূর্তির প্রচলন রয়েছে। বিভিন্ন ভঙ্গীতে অশ্ব বাহিনী বা ময়ূর বাহিনী মূর্তিগুলির গায়ের রঙ হলুদ বর্ণের ও শাড়ি নীল রঙের হয়ে থাকে। মূর্তির হাতে কখনো শঙ্খ, কখনো পদ্ম, কখনো পাতা বা কখনো বরাভয় মুদ্রা দেখা যায়। 

টুসু উৎসব অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে পালিত হয়। ধানের ক্ষেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে পিঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো লাগিয়ে তাতে তুষ রাখেন। তারপর তুষের ওপর ধান, কাড়ুলি বাছুরের গোবরের মন্ড, দূর্বা ঘাস, আল চাল, আকন্দ, বাসক ফুল, কাচ ফুল, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে পিড়ি বা কুলুঙ্গীর ওপর রেখে স্থাপন করা হয়। পাত্রের এই পুরো ব্যবস্থা প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী হিসেবে পূজিতা হন। পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর নিকট তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সুর করে নিবেদন করেন ও দেবীর উদ্দেশ্যে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করেন।

টুসু উৎসব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ চারদিন চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত। চাঁউড়ির দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নিকিয়ে পরিষ্কার করে চালের গুঁড়ো তৈরী করে। বাঁউড়ির দিন অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কোণাকৃতির পিঠে তৈরী করে তাতে চাঁছি, তিল, নারকেল বা মিষ্টি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়। স্থানীয় ভাবে এই পিঠে গড়গড়্যা পিঠে বা বাঁকা পিঠে বা উধি পিঠে ও পুর পিঠা নামে পরিচিত। বাঁউড়ির রাত দশটা থেকে টুসুর জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়েরা জাগরণের ঘর পরিষ্কার করে ফুল, মালা ও আলো দিয়ে সাজায়। এই রাতে কিশোরী কুমারী মেয়েরা ছাড়াও গৃহবধূ ও বয়স্কা মহিলারাও টুসু গানে অংশগ্রহণ করেন। এই রাতে টুসু দেবীর ভোগ হিসেবে নানারকম মিষ্টান্ন, ছোলাভাজা, মটরভাজা, মুড়ি, জিলিপি ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। 

পৌষ সংক্রান্তি বা মকরের ভোরবেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে টুসু দেবীকে বাঁশ বা কাঠের তৈরী রঙিন কাগজে সজ্জিত চৌডল বা চতুর্দোলায় বসিয়ে নদী বা পুকুরে নিয়ে যান। সেখানে প্রত্যেক টুসু দল একে অপরের টুসুর প্রতি বক্রোক্তি করে গান গাইতে দেবী বিসর্জন করে থাকেন। টুসু বিসর্জনের পরে মেয়েরা নদী বা পুকুরে স্নান করে নতুন বস্ত্র পরেন। ছেলেরা খড়, কাঠ, পাটকাঠি দিয়ে ম্যাড়াঘর বানিয়ে তাতে আগুন লাগান। 

টুসু উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ টুসু সংগীত। এই সংগীতের মূল বিষয়বস্তু লৌকিক ও দেহগত প্রেম। এই গান গায়িকার কল্পনা, দুঃখ, আনন্দ ও সামাজিক অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করে। কুমারী মেয়ে ও বিবাহিত নারীরা তাদের সাংসারিক সুখ দুঃখকে এই সঙ্গীতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। গানের মাধ্যমে মেয়েলি কলহ, ঈর্ষা, অভীপ্সা, দ্বেষ, ঘৃণা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করা হয়। এছাড়া সমকালীন রাজনীতির কথা ব্যাপক ভাবে এই গানে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এই সমস্ত গানে পণপ্রথা, সাক্ষরতা সম্বন্ধে সচেতনতা, বধূ নির্যাতনের বিরুদ্ধতা প্রভৃতি সামাজিক দায়িত্বের কথাও বলা হয়।

টুসু গীতকে ভনিতাযুক্ত ও ভনিতাবিহীন এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। ভনিতাবিহীন টুসু গীতকে মূল টুসু পদ এবং টুসু পদের রঙ এই দুইটি অংশে ভাগ করা যায়। টুসু পদের রঙ অংশটি কখনো মূল পদের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে রচনা করা হয়, কখনো বা স্বতন্ত্র ভাবে রচিত হয়। ভনিতাবিহীন টুসু পদ মূলতঃ চার চরণে বাঁধা থাকে, যার মধ্যে রঙের জন্য মাত্র দুইটি চরণ নির্দিষ্ট থাকে।

টুসু গানের মধ্যে তৎকালীন মেয়েদের অবস্থা, চিন্তাধারা এসবের একটা পরিচয় পাওয়া যায়। তখনকার মেয়েদের গহনা, অলঙ্কার, পোশাক, সংসারের অশান্তি, দুঃখ দুর্দশা অভাবের কাহিনী ফুটে ওঠে। সমাজের এক সুন্দর রূপদর্শন রয়েছে এর মধ্যে। 



গ্রাম গঞ্জের মেয়েদের গহণা, অলঙ্কার এসব ফুটে ওঠে বিভিন্ন গান যেমন-

‘টুসু সিনাচ্ছেন,গা দলাচ্ছেন
হাতে তেলের বাটি
নয়ে নয়ে চুল ঝাড়ছেন
গলায় সোনার কাঠি...’

বা গ্রামের মেয়েদের শহরে পড়তে গেলে গ্রামের প্রতি টান কমে যাওয়ার কাহিনী যেমন-

‘না রহিবেন গাঁয়ে টুসু যাবেন ইবার শহরকে
আলতা চরণ জুতায় ঢেকে দিবে না পা ডহর কে
গীত গাহিবেন অবাক কলে,পান কিনিবেন দোকান লে
বছর বছর সাধ জাগিলে আসতে পারেন উখান লে
গঙ্গা সিনান, সিনেমা টকি,গড়ের মাঠ আর কালীঘাট
বতর পাইলে লেখাপড়ায় হরেক কিসিম লিবেন পাঠ’

বা সংসারে অশান্তি, ঝগড়া এসবের বর্নণাও পাওয়া যায় যেমন-

‘আমার টুসু মুড়ি ভাজে, চুড়ি ঝনঝন করে গো
উয়ার টুসু হ্যাংলা মাগি, আঁচল পাইত্যে মাগে গো’

কখনও বা বিভিন্ন গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার কাহিনী পাওয়া যায় যেমন-

‘চল টুসু খেলতে যাবো রানীগঞ্জের বটতলা
অমনি পথে দেখাই আইনব কয়লাখাদের জল তুলা
উলোট পালট ফুলুট বাঁশিতে
আমার মন মানে না ঘরেতে ...’ 

কিংবা জীবিকার সন্ধানে শহর যাওয়ার ঘটনা-

‘চল টুসু চল টাটা যাবো
ধান হইল না কি খাবো ’

মেয়েদের রোদ জল বৃষ্টিতে ভিজে জঙ্গলে পাতা ও বিভিন্ন রকম রসদ সংগ্রহের কথা যেমন-

‘বড় বোনের লতা পাতা
ছোটো বোনের শাল পাতা
কুন বনে হারালো টুসু
সোনার বরণ লালছাতা
চিড়কা রোদে ধরেছে মাথা’

কোনো গানে বা ফুটে ওঠে প্রচন্ড শীতের কথা-
“এমন জাড় ভাই দেখি নাই আগে
গেল বুড়াবুড়ির দাঁত লাইগে
সু হামার জাড়ের গ্যাঁদাফুল। 
মকর সিনান করে বাঁধব চুল।”

কোনো গানে শীতে মকর সংক্রান্তিতে মানুষের আনন্দের বর্নণা-

‘মকর মকর মকর পরবে
ছোঁড়িদের পা পড়ে নাই গরবে…’

দেশের অবস্থা, আন্দোলন এসবও থাকে এই গানে যেমন তৎকালিন মানভূম ভাষা আন্দোলনের কথা-

‘আমার মনের মাধুরী
সেই বাংলা ভাষা করবি কে চুরি?
আকাশ জুড়ে বৃষ্টি নামে মেঠো সুরের কোন চুয়া।।
বাংলা গানের ছড়া কেটে আষাঢ় মাসে ধানরুয়া
বাংলা গানে টুসু আমার মকর দিলে সাঁকরাতে
টুসু ভাসান পরব টাঁড়ে টুসুর গানে মন মাতে’

কিন্তু বর্তমানে ভাদু পূজো, টুসু গান হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হতে বসেছে এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে বাঙালিকে উদ্যোগ নিতে হবে। যদিও নতুন প্রজন্ম এসব সংরক্ষণে জোর দিয়েছে যা আমাদের আশা জাগায়। গ্রাম গঞ্জে এই গানের জনপ্রিয়তা বেশ রয়েছে। আরো অনেক মানুষকে এগিয়ে এসে বাংলার সংস্কৃতির হাল ধরতে হবে তবেই বাঁচবে বাংলার প্রাণ।।


No comments