Header Ads

প্রথম বিধবাবিবাহের বাড়ি হিসেবে চিহ্নিত ৪৮ কৈলাশ বোস স্ট্রিট



কলকাতার ৪৮ কৈলাশ বোস স্ট্রিটে অবস্থিত বিধবাবিবাহের প্রথম বাড়ি। বিধবা বিবাহ আন্দোলনের অন্যতম মাইলফলক হলো এই বাড়িটি। যে বাড়িতে সূচনা হয়েছিল ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়ের। দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন করেন। উনবিংশ শতক বা তারও আগে থেকে ভারতে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীরা ছিল বঞ্চিত। নারীদের হাজার অপমান-লাঞ্ছনা সইতে হতো। নারীদের সম্পূর্ণ অন্য চোখে দেখা হতো৷ নারীদের গৃহের বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিল। নারীদের জন্য পর্দাপ্রথারও প্রচলন ছিল। তাদের পুরুষদের সাথেও মেলামেশা করার উপায় থাকতো না। ফলে নারীদের বাড়ির এক কোণে একা একা দিন কাটাতে হতো।



একজন কম বয়সী নারীর অল্প বয়সে তার স্বামীর মৃত্যু হলে তাকে বিধবা বেশে একাকী দিন কাটাতে হতো। সমাজে সেই বিধবা মেয়েকে দেখা হতো নোংরা চোখে। বীভৎস ভাষাতে তাদের কটুক্তিও করা হতো। বিধবা নারীদের কেউ বলতো চরিত্রহীন মেয়ে, লগ্নভ্রষ্টা মেয়ে, ডাইনি, বেশ্যা, দজ্জাল আরো কত কী। যা সহ্য করা একজন নারীর পক্ষে অত্যন্ত যন্ত্রণার৷ বিধবা নারীদের বেঁচে থাকা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছিল। সমাজের কিছু কুসংস্কার তাদেরকে মানতে বাধ্য করা হতো৷ তারা চাইলেও সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারতো না। এছাড়াও সতীদাহ প্রথার মাধ্যমে স্বামীর মৃত্যুর পর একজন অসহায় নারীকে জ্বলন্ত চিতায় ফেলে দেওয়া হতো। নারীর যেন কোনো মূল্যই ছিলনা প্রাচীন ভারতে।  
        
সমাজের অন্ধ নিয়মকানুনের বেড়াজাল থেকে বিধবা নারীদের স্বাধীনতা দিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন। তিনি দেখেছিলেন সমাজে যখন বহুবিবাহ সম্ভব হতে পারে তাহলে বিধবা বিবাহ কেন হতে পারেনা? তিনি নারী জাতির সম্মান বৃদ্ধির জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। একজন মেয়েকে খেলনা হিসেবে ব্যবহার করার তিনি বিশেষ বিরোধী ছিলেন। তিনি বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহকে ঘৃণা করতেন। একজন নারী বিধবা হলেই তার জীবনের সব স্বাদ শেষ হয়না বরং সে যদি পুরানো সব স্মৃতি মুছে দিয়ে নতুন করে সংসার গড়ে তোলে তাহলে সে নতুন করে বেঁচে থাকার আস্বাদন জোগাবে। এসবেরই পরিপ্রেক্ষিতে বিধবা বিবাহের সূত্রপাত ঘটে। 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বদলে যেতে থাকে নারীদের জীবনযাপনের চিত্রটা। তারা কিছুটা হলেও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সুযোগ পেতে থাকে। তাই বিদ্যাসাগরকে নিয়ে সেকেলে প্রচলিত হয় একটা ছড়ার। যে ছড়াটির দুই লাইন আপনাদের বলা যাক। 'বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে, সদর করেছে রিপোর্ট, বিধবার হবে বিয়ে'।    

উত্তর কলকাতার ৪৮ বোস কৈলাশ স্ট্রিটের প্রাচীন নাম সুকিয়াস স্ট্রিট। আর্মেনিয়ান পিটার সুকিয়াসের নামানুসারে নামকরণ হয়েছিল সুকিয়াস স্ট্রিটের। ঐ রাস্তাটির পাশে বারো নম্বর বাড়িটি ছিল বিদ্যাসাগরের আ-যৌবন সুহৃদ রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি। তিনি প্রায়শই সংস্কৃত কলেজে পড়িয়ে এই বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজন করতে আসতেন। রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্কের সুবাদে প্রথম বিবাহের মন্ডপ হিসেবে এই বাড়িটিকে বেছে নেওয়া হয়।     
   
১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ই ডিসেম্বর রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে পটলডাঙ্গানিবাসী লক্ষ্মীমণি দেবীর দশ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতির সঙ্গে প্রসিদ্ধ কথক রামধন তর্কবাগীশের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিবাহ হয়। তৎকালীন বাংলার 'প্রভাকর' সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় বিধবা বিবাহের এই খবরটি। এই বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রমাপ্রসাদ রায়, বাবু রামগোপাল ঘোষ ও দিগম্বর মিত্রের মতো মহান ব্যক্তিগণ। বিবাহে পুরো বাড়ি শুদ্ধ রাস্তাঘাট লোকেদের ভিড়ে গমগম করেছিল। বিবাহ অনুষ্ঠানে লোক সামাল দেওয়ার জন্য পুলিশেরও ব্যবস্থা করতে হয়।    

বিধবাবিবাহের প্রথম বাড়ির স্মৃতিপট সভ্যতার অতলগর্ভে হারাতে বসেছে। এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িটির সাথে গভীরভাবে জড়িত বাংলার ইতিহাস। বিদ্যাসাগর, রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়দের মতো মহান ব্যক্তিদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি ৪৮ কৈলাশ বোসের স্ট্রিটের এক কোণায় সংস্কারের অভাবে ধুঁকছে। বিধবাবিবাহের ফলকও উধাও আজকে বাড়িটি থেকে৷ ২০১৯ এ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশতজন্মবার্ষিকী উপলক্ষেও এ বাড়িটি নিয়ে সংরক্ষণের কোনো প্রশ্নই ওঠেনি৷ সবাই চুপ। বিস্তৃতির অকাল গ্রাসে আজকে মৃতপ্রায় প্রথম বিধবাবিবাহের বাড়িটি।


No comments