Header Ads

বাঙালি নারী মুক্তিযোদ্ধা মেহেরুন্নেসা মীরার জীবনের কিছু সংক্ষিপ্ত গল্প



-ভিক্ষা দিবা গো?

পাক সেনাদের শিবির আজ কদিন আগে লেগেছে। ওরা এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের ফতেহ করতে৷ ওদের কাছে এখানকার বাগের হাটের লোকগুলি বড় ভয়ানক। 

- ভিক্ষা দিবা গো?

-কৌন হায়?

-ভিক্ষা চাই বাবু-- আইজ কিছু খাইতে পাই নাই বাবু! 

- ক্যায়া বোলতী হায়-- খানা নেহী মিলা উসকো? এক পাকসেনা বলে ওঠে। সে তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে থেকে ভিখারিনীর দিকে-- বড়া গন্দা চেহেরা-- বয়স কম হলে কি হোবে-- গন্দী আওরত-- শালী বহুত... এবার রমজানের দিকে তাকিয়ে বলে, যা যা উকে কুছ দেকে ভাগা-- 

শিবিরের মধ্যে সাজ-সাজ রব চলছে বলে মনে হচ্ছিল। ওদের কোথাও দাঙ্গা ফ্যাসাদ করার প্রস্তুতি হবে। 


রমজান স্থানীয় গ্রামের লোক, পাক সেনারা জবরদস্তি ওকে শিবিরের কাজে লাগিয়েছে। বিনা পয়সায় দু বেলা খেতে দেয় এটাই নাকি খুব বেশি। এসব রহমান চাচার থেকে জেনেছিল মীরা। রহমান চাচা লোক খারাপ না। 

ভিখারিনীর ছদ্মবেশী মীরা এবার জিজ্ঞেস করলো, কি গো চাচা, ওরা খুব ব্যস্ত মনে হইতাসে?

--হ-- হেরা মুক্তিযোদ্ধার খোঁজ পাইসে-- এখন ঐ বাইরৈব বাগের হাটের গ্রামের দিগে--

আচ্ছা চাচা আইজ যাই-- আর মুহূর্ত দাঁড়ায় নাই মীরা। গ্রামের লোকেদের আর মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দিতে সে ছুটে চলে। মীরা জানত কোন কোন বাড়িতে থাকত মুক্তি যোদ্ধারা৷ সে সব বাড়ির বাইরে থেকেই চীৎকার করে ডেকে ওঠে, শুন তুমরা, এখনি তুমরা পালাও, আর এক মুহূর্ত দেরী না - পালাও, তুমাগ মারার জন্যে পাকসেনার দল আইতাসে-- 

এই ছিল মীরার দেশ মুক্তির কাজের এক ধরন। এমনি সংবাদ বাহকের কাজ করে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের জনগণকে তিনি বহুবার বাঁচিয়েছেন।

সেদিনের ঘটনাও মীরার ভাবনায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। সে ছিল সাধারণত মুক্তিযুদ্ধ শিবিরের কথা। কিছুদিন আগেই মীরা এখানে এসেছে। ইতিমধ্যে সে জেনেছে দেশ ও দশের কথা। মুক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের কথা। কেন এই আয়োজন, কেন এই প্রাণ বিসর্জন, দেশ তো মানুষের মা, দেশের জনগণ দেশ মাতার সন্তান। সেই দেশ মাকে বাঁচানো মানে নিজেদের ও নিজের মাকে বাঁচানো। দেশ বাঁচাতে হাতিয়ার, মারণাস্ত্র সে হয় তো ধরবে না। কিন্তু অন্য অনেক পথই তো আছে যে পথে সে দেশের সেবা করতে পারে! 

তাই সে সাধারণত মুক্তিযুদ্ধের শিবিরে রান্নাবান্নার, মুক্তি দলের সেবা শুশ্রূষারা কাজে হাত দিলো। সেই সঙ্গে খালি ঘরের অস্ত্র গোলা-বারুদের রক্ষণাবেক্ষণের ভারও নিজের হাতে তুলে নিলো।

সে দিনের কথা। মুক্তি বাহিনীর সবাই বেরিয়েছে অভিযানে। মীরা একা শিবির ঘরে। এমনি সময় দূরে শুনতে পেল গুলিগোলার আওয়াজ। তার মনে হল, নিশ্চয় পাক সেনারা হামলা করতে এসেছে। এবার কি করবে সে? শিবিরে রয়েছে অনেক অস্ত্র-শস্ত্র, গোলা বারুদ। কি ভাবে বাঁচানো যাবে এসব?

দেরী না করে মীরা এগুলি যতটা পারল নিজের হাতে বয়ে নিয়ে গেল খালের পারে। সেগুলি এক এক করে উঠাল নৌকায় আর হোগলা বনে ঘেরা সে খালের জঙ্গলে নিজেকে লুকিয়ে নিলো। সময়টা ছিল শীতকাল। তার ওপর খালের জলে ভেজা তার শাড়ি। এমনি অবস্থায় সে পাকসেনাদের হাত থেকে লুকিয়ে রইল দিন ভর৷ শরীরে তার শীতের কাঁপন, সারা দিনের অনাহারী দুর্বলতা, জীবনের ভয়- সব মিলিয়ে তার অবস্থা ছিল সঙ্গীন৷ কি করবে আর কিছুই তো তার করার নেই! এভাবে সারা দিন গড়িয়ে বিকেল এলো, বিকেল পার হয়ে সন্ধ্যে এলো। গোলাগুলির আওয়াজ থেমে গেছে অনেক সময় আগে। চারিদিক তখন সম্পূর্ণ নিরাপদ বলে মনে হচ্ছিল। মীরা ফিরে আসার জন্যে চেষ্টা করেও নৌকা সরাতে পারছিল না। যেদিকেই ঠেলে সে দিকেই মাটিতে গিয়ে ঠেকে যায়। ঠিক এমনি সময় মুক্তি বাহিনীর দবির খুঁজতে খুঁজতে মীরার দেখা পায়। 

দবির বলেছিল- 'তুমারে অনেক খুজ্জি। আমরা ত ভাবছি তুমি আর বাইচ্চা নাই!'  

দবিরের সেদিনের কথার উত্তরে মীরার ভাষা ছিল- 'আল্লা যারে বাঁচাইয়া রাখে তারে মারে কে?' তারপর ওরা দুই জনে সেই নাউ ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসে ঘাটে৷ মীরার জন্যে মুক্তি বাহিনীর অনেক অস্ত্র-শস্ত্র গোলা-বারুদ সেদিন বেঁচে গিয়েছিল। 

দীর্ঘ নয়মাস মীরা এখানকার শিবিরে থেকেছিলেন। 

১৯৫২ সালের ১০ ই মার্চ বাগের হাট জেলার সরই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মীরা মেহেরুন্নেসা। পিতা তাহেরুদ্দিন শেখ, মাতা হাজেরা বেগম। আর্থিক অবস্থার জন্যে তিনি লেখাপড়া বিশেষ একটা করে উঠতে পারেননি৷ সংসারে সাহায্যের জন্য তিনি যাত্রাদলে অভিনেত্রী শিল্পী হিসাবে যোগ দেন। সে যাত্রাদল মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে ভেঙে যায়। তারপর থেকেই মীরা মুক্তির কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথায় উদ্বুদ্ধ হন। তিনি স্বয়ং দেশমুক্তির যোদ্ধার দলে যোগ দেন। দেশের জন্য কৃত মীরার কাজ বা সেবার অনেক ঘটনা আছে। তাই আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আমরা স্মরণ না করে পারছি না। 

মুক্তিযোদ্ধারা চলেছে তাঁদের অভিযানে। মীরা চলেছে তাদের সবার বেশ অনেকটা আগে আগে। তার তখন ছদ্মবেশ। মুক্তির উদাত্ত ভাবনা ওদের সবার বুকে ভরা। নির্ভীক চেতনায় দৃঢ় ওদের পদক্ষেপ। ওরা এগিয়ে চলেছে শত্রু দলনে। স্বজন ও দেশ উদ্ধারে। 
আর কিছুটা এগোলেই বিষ্ণুপুরের উচ্চ বিদ্যালয়। মীরা কিছু পা এগিয়েই দেখতে পেল খাল পাড়। আর এ কি দূর থেকে খালের ওপারে দেখা যাচ্ছে পাক সেনাদের জমায়েত। ওদের প্রস্তুতিতে বেশ বোঝা যাচ্ছিল ওরা খাল পার করে এ পারেই আসবে। মীরা বুঝলো বিপদ আসন্ন। পাকসেনা আর মুক্তিযোদ্ধার দল যদি সামনা সামনি হয় তবে সে লড়াই হবে বৃহদাকার। আর তাতে মুক্তি কর্মীদের প্রাণ নাশের আশঙ্কাই থাকবে অনেক বেশী। মীরার মনে হঠাৎ এক বুদ্ধি এসে গেল, সে ভেবে নিলো আসন্ন কাজের প্রস্তুতির কথা। সে খালের স্থানীয় যোগাযোগের একমাত্র বাঁশের সাঁকো নিজের হাতে খুলতে লাগলো। আর এক সময় সে সাঁকোর যোগাযোগ ছিন্ন করে দিতে পারলো। পাক সেনাদের খালের এপারে আসার সহজ অবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়ে সেদিন দেশের অনেক জনমানবকে বাঁচাতে পেরেছিল মীরা। 

মীরা নিজের হাতে হয়তো অস্ত্র চালনা করেননি, প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হননি কিন্তু তাঁর সেবা, বুদ্ধি চতুরাই অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। পাকসেনার আগমন বার্তা ছদ্মবেশে জেনে নিয়ে তিনি গ্রামবাসী আর মুক্তি বাহিনীদের আগেভাগে জানিয়ে দিতেন৷ 

এমনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মীরা মেহেরুন্নেসা। বীরাঙ্গনা। 

এত বছর পরে মীরার ব্যক্তিগত জীবনের ফলাফলের দিকে না তাকালে আজের কাহিনী তো শেষ হতে পারে না।

গ্রাম গাঁয়ে এক বুড়ি শাপলা আর সবজি বিক্রি করতে আসত, কখনও তার গলা আমরাও হয়তো শুনে থাকব, সব্জি নিবা গো? সব্জি? কেউ কি আমরা সেই বুড়ির কথা ভেবেছি। ভেবেছি কি এই বুড়িই হতে পারে সেই মীরা, এক বুদ্ধিমত্তা, মুক্তিযোদ্ধা নারী?

শুনেছি সরকার থেকে তিনি ভাতা পান। নদী ধারে ঘর বানাবার এক টুকরো জমিও পেয়েছেন৷ কিন্তু সে ভাতা, সে ঘরের ভীতের জমিনটুকু কি তাকে সহজ স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট? প্রতিদিনের জোয়ারের জলে নাকি সে জমি জলের তলে ডুবে যায়। জানিনা ভীতের মাটি ভরে ঘর বানাবার সামর্থ্য তাঁর হয়েছে কি না। তাঁর শাপলা শাক বিক্রির কথা মনে পড়লে আমাদের মন আত্মগ্লানিতে ভরে ওঠে। তাঁর সহজ সচ্ছল জীবনের কামনা আমাদের প্রত্যেকের দোয়া হওয়া উচিত।

No comments